ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

রাঙিয়ে দিয়ে যাও গো...

হোসাইন মোহাম্মদ সাগর, ফিচার রিপোর্টার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৮
রাঙিয়ে দিয়ে যাও গো... ছবি- বাংলানিউজ

ঢাকা: 'জু মা গঙ্গী, ম-র পুরোন বঝরর আপদবলা ফিবলা বেগ ধোয় নে যা'। চাকমা সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন ফুল পূজো করে। 

উৎসবে গঙ্গা নদীতে ফুল ভাসানোর সময় গঙ্গার কাছে এ মন্ত্র পড়ে প্রার্থনা করে তারা। যার অর্থ, প্রণাম হে মা গঙ্গা, আমার পুরনো বছরের যাবতীয় আপদ বিপদ সব ধুয়ে নিয়ে যাও।

সব বাঙালি আদিবাসী নয়, কিন্তু তারপরও নতুন বছরের সূচনা লগ্নে সবার প্রার্থনা তাদের সঙ্গে মিলে যায়, ‘ম-র পুরোন বঝরর আপদবলা ফিবলা বেগ ধোয় নে যা। ’ আর রাঙিয়ে দিয়ে যাও নতুন বছরের নব প্রভাতের রাঙা আলোয়।

কবি যেমন করে কল্পনা করেন, তেমন করে এক রাত্রির মধ্যেই আমাদের জীবন থেকে অবসান হয় না পুরনো বছরের জীর্ণতা ও ক্লান্তির অবসাদ। নববর্ষের দিনটিতে নতুন হয়ে দেখা দেয় না কিছুই! আমরাও নতুন হয়ে উঠি না রাতারাতি। তবে একটি রাত অনন্ত হয়ে উঠতে পারে নানা পরিপ্রেক্ষিতে।  

সংবেদনশীল মননে, প্রতিটি কর্মে-চিন্তায় ও কল্পনায় কিছু একটা তৈরি করে সুন্দরের ইমেজ। আর তাই বছরের প্রথম দিনটির আবির্ভাব সম্পর্কে যে সচেতন, তার কাছে সেদিন সকলই শোভন, সকলই নবীন, সকলই বিমল আকাশ সুনীল, কানন শ্যামল, জোছনা বিশদ, কুসুম কোমল। নববর্ষের দিনটি ঠিক তেমনি। এতো গান, এতো ফুল, এতো আলো, সবকিছুতেই নতুনের অভ্যর্থনা।

মনের গহিনে নিরন্তর বহমান ‘ধানসিঁড়ি’র চোরা স্রোত- ‘যেন এই গাঙুরের ঢেউয়ের আঘ্রাণ লেগে থাকে চোখেমুখে, /রূপসী বাংলা যেন বুকের ওপর জেগে থাকে। ’ সে জন্যই তো নির্ভেজাল প্রাণের টানে একান্ত নিজস্বতায় প্রতি ঘরে ঘরে উৎসবের এই পরিপাটি আয়োজন।

আবহমানকাল থেকেই আমাদের সত্ত্বায়, চেতনায় ও অনুভবের জগতে এক গভীরতর মধুর সম্পর্ক নিয়ে বিরাজ করছে বৈশাখ। পহেলা বৈশাখ পুরনো জীর্ণকে ঝেড়ে ফেলে আমাদের যাপিত জীবনে নতুন সম্ভাবনা ও নতুন প্রত্যাশা জাগিয়ে তুলতেই শুধু নয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে একাকার হওয়ার প্রেরণাও জোগায়।  

পহেলা বৈশাখই বাঙালির জীবনে সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক সার্বজনীন উৎসব। বাংলা ও বাঙালির লোকজ সংস্কৃতির মূল বিষয়টি হলো, উৎসবের মধ্য দিয়ে আনন্দের বহিঃপ্রকাশ। আর সে উৎসবের মধ্য দিয়েই প্রকাশ পায় বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাস, লোকজ ঐতিহ্য ও গৌরব।

নাগরিক জীবনের প্রয়োজন মেটাতে এখনও মানুষকে গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির শরণাপন্ন হতে হয়, তবু বাংলা বর্ষপঞ্জির অনুসরণ একেবারে বিলুপ্ত হয়নি বাঙালির জীবন থেকে। কৃষিনির্ভর এই দেশের গ্রামাঞ্চলের মানুষ চাষাবাদ, ঋতু গণনা, নানা তিথি-পার্বণ, আচার-অনুষ্ঠান পালনের দিনক্ষণ নির্ধারণে এখনও বাংলা বর্ষপঞ্জিই অনুসরণ করে থাকেন।  
নগর-গ্রাম উভয় জীবনেই দৈনন্দিন কাজকে ছাপিয়ে উৎসবের ক্ষণ হিসেবে বাঙালির নিজস্ব বর্ষটি আদায় করে নিয়েছে অগ্রাধিকার। পহেলা বৈশাখ পরিণত হয়েছে বাঙালির জীবনে সর্ববৃহৎ উৎসবে।  

আমরা বাঙালিরা উৎসব প্রিয়। ইংরেজি নববর্ষের প্রথমদিনে (নিউ ইয়ারস্ ডে) যেমন প্রাণভরে আনন্দ করি, তেমনি অন্যান্যদের অন্যসব উৎসবেও মেতে উঠতে পারি। কিন্তু অন্তরের অন্তস্থলে জানি, সেটা আমার নয়, অন্যের। আমি তার কাছে অভ্যাগত, আগন্তুক। তাকে আমি বরণ করতে পারি; কিন্তু তাও বাইরের মানুষ হিসেবেই। অন্যপক্ষে, আমার নববর্ষটি একান্তই নিজের, আমার সত্ত্বার সঙ্গে তা জড়িয়ে আছে। তাইতো তাকে বরণ করার জন্য এতো আয়োজন। হবে নাই বা কেন? সে যে নতুনের উৎসব, সারা বছরের ধুসর-ধুলোমাখা দিনগুলোকে রাঙিয়ে তোলার উৎসব।

বছর শেষে লাল-হলুদ ফুল বিছানো পথে পুরনোকে সঙ্গে নিয়ে নতুনকে বরণ করতে পরিশ্রান্ত পথিক যে ছায়াপথ এঁকে যায়, আগামীর সূর্য সেই পথেই নতুন আলো ঝরায়। সেই পথেই পাখি গান গায়, আকাশী-নীল ছেলেদের সঙ্গে গোলাপী-হলুদ মেয়েরা পথে নামে, আবার ভালোবাসা উপচে পড়ে। এ ভালোবাসা শুধুমাত্র নতুনের জন্যই। তাইতো প্রাণ খুলে বছরের প্রথম দিনটিতে গাইতে ইচ্ছে করে- 'রাঙিয়ে দিয়ে যাও.. যাও.. যাও গো'।

বাংলাদেশ সময়: ০০২৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৪, ২০১৮
এইচএমএস/এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।