ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

আর্থিক দৈন্য ঘোচাতে মাটির চুলাই আমেনার ভরসা

জিএম মুজিবুর, সিনিয়র ফটো করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ১, ২০২০
আর্থিক দৈন্য ঘোচাতে মাটির চুলাই আমেনার ভরসা মাটির চুলা বানাচ্ছেন আমেনা বেগম/ ছবি: জিএম মুজিবুর

ঢাকা: কাক ডাকা ভোর হলেই শুরু হয় আমেনা বেগমের (৫৫) জীবন যুদ্ধ। সকালে কোনো দিন না খেয়ে বা আধপেট খেয়েই ছুটে চলে আসেন রাজধানীর গুলশানের শাহজাদপুর ঝিলপাড়ে।

 

আমেনা বেগম বাংলানিউজকে বললেন ‘দুপুরে প্রায়ই না খেয়ে থাকতে হয়। আর রাতে গিয়ে যা জোটে তাই খাই। কিন্তু ঔষধ কিনতে পারি না, সারা রাত জ্বালা-যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে পার করতে হয়। ’

‘৪/৫ বছর ধরে এখানে চুলা বানাই আমি, সিটি কর্পোরেশনের বড় স্যারদের হাতে পায়ে ধরে ঝিল পাড়ে মাত্র ২০ হাত জায়গা নিয়ে মাটির চুলা তৈরি করি। পাশাপাশি কচু আর শাক পাতা লাগাই। ' 

ইট-পাথরের এই রাজধানীতে যেখানে প্রত্যেকের ঘরে ঘরে আছে গ্যাসের চুলা কিন্তু যেখানে নিতান্তই গ্যাস নেই, যেমন বস্তি ও ফুটপাতে বিভিন্ন পিঠা তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয় এই মাটির চুলা। এটাই অসুস্থ আমেনা বেগমের বেঁচে থাকার উপার্জনের একমাত্র উৎস। বিগত চার বছর ধরে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে অসুস্থ স্বামী ও নিজেও জীবন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হচ্ছে কোনো প্রকার সাহায্য- সহযোগিতা ছাড়াই। এমন যুদ্ধে টিকে থাকা কতদিন সম্ভব কে জানে। আমেনা বলেন, ‘শীত আসলেই মাটির চুলার বেচাকেনা বেশি হয়, তার জন্য আগে থেকে বানিয়ে শুকিয়ে রাখতে হয়। বেচাকেনা বেশি হওয়ার কারণ হচ্ছে শীতের সময় রাস্তাঘাটে অনেক নারী পিঠা তৈরি করে বিক্রি করেন, তখন এখান থেকে চুলা কিনে নিয়ে যান তারা। এবং যে সমস্ত এলাকায় গ্যাস নাই অথবা শীতের সময় গ্যাস কম থাকে তারাও আমার এই চুলাগুলো এখান থেকে নিয়ে যায়। ’ 

‘সারা মাসে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা বেচাকেনা হলে কিভাবে আমি সংসার চালাবো?’ একথা বলে কেঁদে বুক ভাসিয়ে দিচ্ছিলেন আমেনা বেগম।  

২০০ টাকায় ৩০ বস্তা মাটি কিনলে সাতটা চুলা বানানো যায়। একটি চুলা ২৩০ থেকে ২৮০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়।  

আমেনা বেগম বলেন, ‘জন্ম আমার এই ঢাকাতেই। পিতা-মাতার সংসারে অভাব থাকার কারণে অল্প বয়সে বাবা-মা আমাকে বড় ফ্যামিলি দেখে বিয়ে দিয়েছিলেন। আমার স্বামীরা চার ভাই, চার বোন। শশুরের জমি ছিল মাত্র ১ কাঠা। তারই উপর সবাই একসঙ্গে বসবাস করতাম। ’

‘একদিন সেই জমিটা বিক্রি করে যে যার মতো এক এক দিকে চলে গেল, আমরা যাই একটু পেয়েছিলাম তা দিয়ে ছেলে-মেয়ের পড়াশোনা করানোর চেষ্টা করি। কিন্তু ওদের বাবার চিকিৎসার পেছনেই বেশিরভাগ টাকাই খরচ হয়ে যায়। তারপর যখন কোনোভাবেই সংসার চলে না অভাবও আমাদের পিছু ছাড়েই না। ছোটখাটো কাজ করতাম। ’

‘স্বামীর পাশাপাশি সংসারের সহযোগিতা করতে গিয়ে আমি আয়ার চাকরি নিয়েছিলাম ২০০০ সালে। আইসিডিআরবিতে আমার চাকরি আর স্বামীর ছোটখাট কাজের মধ্য দিয়ে সংসার মোটামুটি ভালোই যাচ্ছিল। ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা করানোর পাশাপাশি সংসারের টুকটাক খরচ মিলে আল্লাহর রহমতে ভালোভাবেই পার করছিলাম। ’ 

‘হঠাৎ একদিন অফিসে ময়লার বালতি উঠাতে গিয়ে পেটের নাড়িতে টান লাগে। তারপর থেকে অসুস্থতা শুরু হয়, আজও রক্ষা পাইনি। আমাকে হসপিটাল কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের সহযোগিতা ছাড়াই আমার চাকরীচ্যুত করে দেওয়া হয়। বড় বড় স্যারদের কাছে বার বার গিয়েছি, দরখাস্ত করেছি, এমনকি বলেছি আমার অপারেশনটা একটু করিয়ে দেন। কেউ আমার কথা শুনল না। দশ বছর চাকরি করলাম দশটা টাকাও আমাকে কেউ দিল না। ’ 

চারিদিকে হাত পেতে অনেক কষ্ট করে অপারেশনটা করিয়েছিলাম। ঠিক তার কিছুদিন পরেই ধরা পড়ল একটা কিডনি নষ্ট। সারাজীবন বলদের মতো খাটতে খাটতে শরীরের সমস্ত হাড়গুলো ক্ষয় হয়ে গেছে, উঠলে বসতে পারি না, বসলে আর উঠতে পারি না। তারপরও একদিনও বসে থাকতে পারিনা  অভাবের তাড়নায়। ’

‘অন্যদিকে স্বামী অসুস্থ। তারও ডায়াবেটিস ও কিডনি নষ্ট। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারলাম না। বিছানায় পড়ে আছে ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ। বড় ছেলেকে বিয়ে দিয়েছি বউ নিয়ে চট্টগ্রামে থাকে, কোনো খবর রাখে না। ছোট ছেলেকে বিয়ে দিয়েছি। তার সংসার হয়েছে। সেও ছোট চাকরি করতো। করোনাকালে তার চাকরি চলে গেছে। তার কোনো ইনকাম নেই। মেয়েটাকেও বিয়ে দিয়েছি স্বামীর সংসারে থাকে। জামাই গাড়ির ড্রাইভার। জামাই মেয়ে আমাকে আর কতটুকু উপকার করতে পারবে? তবুও মাঝে মধ্যে খোঁজ রাখে। ’ ‘রোজা করি ও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি আর আল্লাহকে বলি, হে আল্লাহ তুমি আমাকে ও আমার স্বামীকে সুস্থ করে দাও না হলে আমাদেরকে নিয়ে যাও,’ এ কথা বলতে বলতে আমেনা বেগম বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন।

করোনাকালীন সময়ে কীভাবে দিন পার করছেন এমন প্রশ্নের জবাবে আমেনা বেগম বলেন, ‘তিন-চার মাস বাসা থেকে বের হতে পারি নাই। তারপরেও চুরি করে করে আমাকে এখানে আসতে হয়েছে চুলাও বানিয়েছি, গাছের যত্ন নিয়েছি। কারণ দুই কেজি পেঁপে বিক্রি করতে পারলেই ১ কেজি চাউল আর ডাল কিনে বাসায় নিয়ে যেতে পারতাম। আর এলাকাবাসী ও কমিশনার কিছু ত্রাণ দিয়েছিল, তাই সবার সহযোগিতায় আল্লাহর রহমতে এখনো পর্যন্ত বেঁচে আছি। ’

সরকারের কাছে বা অন্য কারো কাছে কোনো সহযোগিতা চান কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘লাখ লাখ মানুষের বসবাস এই রাজধানীতে। এমন কোনো সহৃদয় একজন ব্যক্তি কি নাই যিনি আমার ছেলেটাকে একটা চাকরি দিবেন অথবা এই এলাকার আশেপাশে কোনো একটা জায়গায় আমাকে একটা দোকান নিয়েও বসার মতো ব্যবস্থা করে দিবেন। ছোট ছেলেটা এসএসসি পাস, বহুত কষ্ট করে ড্রাইভিং লাইসেন্স করে দিয়েছি, ওর একটা ভালো চাকরি হলে  অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে দুবেলা দুমুঠো ডাল-ভাত খেয়ে বাঁচতে পারতাম। এর বেশি আর চাওয়া-পাওয়ার কিছু নাই। ’

বাংলাদেশ সময়: ১২৩৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ০১, ২০২০
এমএইচএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।