বাউত উৎসব পালন করেছেন স্থানীয় মৎস্যপ্রেমীরা। ছবি: বাংলানিউজ
পাবনা: ভোরের আলো ফোটেনি, ঘন কুয়াশা ও কনকনে ঠাণ্ডা। বিলের দিকে মানুষের ঢল।
যেন কী এক বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস আর আনন্দের হাসি। কারও কাঁধে পলো, আবার কারও হাতে ঠোলা জাল, খুইরা জাল, বাদাই জালসহ মাছ ধরার নানা উপকরণ। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ জড়ো হচ্ছে একই স্থানে। শিশু থেকে বৃদ্ধ সববয়সী মানুষের উপস্থিতিতে বিলপাড়ে যেন উৎসবমুখর পরিবেশ। দলবেঁধে বিলের পানিতে নেমে মাছ শিকারের আনন্দে মেতে ওঠেন তারা। প্রতিবছরের মতো মঙ্গলবার (১ ডিসেম্বর) কাকডাকা ভোর থেকে বেলা গড়িয়ে দুপুর পর্যন্ত এ চিত্র পাবনার ভাঙ্গুড়া ইউনিয়নের পাটুলিপাড়া গ্রামের ‘রুহুল বিলের’। বাউত উৎসবকে কেন্দ্র করে এই চিত্র। গ্রামীণ ঐতিহ্য হিসেবে পাবনার ভাঙ্গুড়া-চাটমোহরের মধ্যবর্তী চলনবিল অঞ্চলজুড়েই প্রতিবছর এ সময়টিতে ধাপে ধাপে চলে এ বাউত উৎসব। জানা গেছে, পাবনার দুইটি উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে রয়েছে চলনবিলের বেশকিছু অংশ। এর মধ্যে বিল ‘রুহুল’ অন্যতম। ‘রুহুল বিলের’ পশ্চিমে চাটমোহর উপজেলার পার্শ্বডাঙ্গা টেংগজানি, বোয়ালিয়া, উত্তরে পাটুলিপাড়া রঙ্গালিয়া দক্ষিণে লাউত কান্দি মধুরগাতি, আলমনগর, পূর্বে হাটগ্রাম, কালিকাদহ অবস্থিত। এরই মাঝখানে ঐতিহ্যবাহী রুহুল বিল অবস্থিত। বন্যার পানি নেমে গেলে বিল রুহুলে প্রচুর দেশীয় প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। এর মধ্যে রয়েছে, বোয়াল, রুই, কাতলা, গজার। প্রতিবছরের মতো এবারও শুরু হলো এই উৎসব। এই উৎসবে মেতেছেন এবার টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, নাটোর পাবনার আটঘরিয়া, চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুরসহ চলনবিলের মানুষ। পাবনার বিভিন্ন উপজেলা ছাড়াও আশপাশের জেলার মানুষও যোগ দিয়েছিলো বাউত উৎসবে। ভোর থেকে বিভিন্ন জেলা থেকে নসিমন, করিমন, মোবাইলফোনে যোগাযোগ করে দলবেঁধে মাছ ধরার বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে তারা এসে হাজির হয় শৌখিন মাছ শিকারিরা। সরেজমিন মঙ্গলবার ভোরে বিল রুহুলে গিয়ে দেখা যায়, পাবনা, নাটোর, সিরাজগঞ্জ জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে শীত উপেক্ষা করে শত শত শৌখিন মাছ শিকারি দলবেঁধে পলো, জালি (ছোট জাল), বাদাই জাল, ঠেলা জাল, ধর্মখরা ইত্যাদি নিয়ে মাছ ধরার উপকরণ নিয়ে জড়ো হয় রুহুল বিলের পাড়ে।
কথা হয়, মাছ ধরতে আসা জেলার ফরিদপুর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী শিক্ষক আরমান হোসেনের সঙ্গে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন,‘অনেকটা শখের বশে এখানে মাছ ধরতে এসেছি। ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে এখানে মাছ শিকার করতে এসেছি। এখন বাবাকে নয়, বরং ছেলেকে নিয়ে মাছ এসেছেন।
গজার মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন পঁয়ষট্টি বছর বয়সী ফরিদপুর উপজেলার সোনাহারা গ্রামের হাজী আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, এখন বয়স হয়েছে, পলো দিয়ে মাছ ধরতে গেলে দম লাগে। আগের মতও পারি না। বাউত উৎসবে আসা সেই যৌবন বয়স থেকে, না এসে থাকতেই পারি না। ভাঙ্গুড়া পাথরঘাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রেজাউল করিম বাংলানিউজকে বলেন ‘২০ বছর আগের থেকে বাবা-বড় ভাইদের সঙ্গে রুহুলবিলে মাছ ধরতে আসি। আগে ১০/১৫ কেজি ওজনের বড়-বড় মাছ পাওয়া যেতো এই বিলে। কিন্তু এখন বিলটি প্রভাবশালীদের দখলে চলে যাচ্ছে। গড়ে উঠছে তাদের মাছের অভয়াশ্রম। বিল-জলাশয় খনন করে মাছের অভয়াশ্রম না বাড়ালে কিছুদিন পর আর মাছও থাকবে না, মাছ ধরার এই উৎসবও আর থাকবে না’।
ভাঙ্গুড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দ আশরাফুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, ‘ভাঙ্গুড়া ও চাটমোহর উপজেলা কিছু অংশ মিলে অবস্থিত বিল রুহুলে এই মাছ ধরার উৎসব হয়। শৌখিন মাছ শিকারিরা প্রতিবছর এ উৎসব পালন করে থাকেন। এই অঞ্চলের বাসিন্দারা বাউত উৎসব এই অঞ্চলের বড় একটি উৎসব। এ উৎসবে বিভিন্ন উপজেলার মানুষ মিলিত হয়ে মাছ শিকার করেন। এটা বাংলার একটি ঐতিহ্য’। ইউএনও সৈয়দ আশরাফুজ্জামান আরও বলেন, ‘আমরা যেহেতু মাছে-ভাতে বাঙালি। তাই যুগের পর যুগ ধরে টিকে থাকুক এ ঐতিহ্যটা। যা আজও এই অঞ্চলবাসী ধরে রেখেছে। দেশীয় মাছ রক্ষার্থে বর্তমান সরকার বিভিন্ন কাজও করছে। সুতরাং এই ঐতিহ্য যেন বিলুপ্ত না হয়ে যায়, সবাইকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য হিসেবে বাউত উৎসবকে টিকিয়ে রাখতে এবং এর পক্ষে জনমত তৈরি ও বাউত উৎসবকে সরকারি স্বীকৃতি দিতে উদ্যোগ নেওয়া হবে’।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০১, ২০২০
এএটি
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।