ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

৮ ডিসেম্বর হানাদার মুক্ত হয় নাটোরের খোলাবাড়িয়া   

মামুনুর রশীদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০০১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৮, ২০২১
৮ ডিসেম্বর হানাদার মুক্ত হয় নাটোরের খোলাবাড়িয়া 
 

নাটোর: ৮ ডিসেম্বর। খোলাবাড়িয়া হানাদারমুক্ত দিবস।

১৯৭১ সালের এ দিনে নাটোরের হালতি বিলের খোলাবাড়িয়া গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এদিন পাকিস্তানি বাহিনীর ছোড়া গুলিতে আব্দুর রাজ্জাক পাঠান নামে এক বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।  

হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ চলে টানা চারদিন। তবে এ অসম যুদ্ধে রসদ শেষ হয়ে গেলে বীর মুক্তিযোদ্ধারা অন্য গ্রামে সরে যাওয়ার পর পাকি বাহিনীর দোসর রাজাকাররা খোলাবাড়িয়া গ্রামে ঢুকে লুটপাট ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে।  

পরে তারা ওই গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি জসিম উদ্দিনকে গুলি করে হত্যা করে। ওই দিন রাজাকাররা নিহত জসিম উদ্দিনের মরদেহও তার স্বজনদের দাফন করতে দেয়নি। স্বাধীনতার পর এলাকার মুক্তিকামী মানুষ কয়েকজন রাজাকারকে ধরে পিটিয়ে মেরে ফেলেন। বেঁচে যাওয়া রাজারকারদের দুই-একজন দাপটের সঙ্গে এখনও চলাচল করছে। ১৯৭১-এর সেই সব ভয়াবহ স্মৃতি বয়ে বেড়ানো অনেকেই রাজাকারদের বিচারের দাবি জানিয়ে আসছেন।  

নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার বিশাল হালতি বিলের দ্বীপ গ্রাম হচ্ছে খোলাবাড়িয়া। চারিদিকে আমন ধানের ক্ষেত আর পানিতে থৈ থৈ করা এ গ্রামে ১৯৭১- এর ৪ ডিসেম্বর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল এসে পাশের গ্রামে আশ্রয় নেওয়া পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়।  

কিন্তু রাজাকারদের মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনারা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান জেনে গ্রামের চারিদিকে অবস্থান নেয়। পরে যুদ্ধ শুরু হলে পাক সেনারা বাঁশিলা গ্রাম থেকে মাঝারি ভারি অস্ত্র মর্টার শেল নিক্ষেপ করতে থাকে। বীর মুক্তিযোদ্ধাররা ওই গ্রামের চারিধারে আটটি বাংকার খনন করে সেখান থেকে গুলি করতে থাকেন।  

চারদিন ধরে চলে সম্মুখযুদ্ধ। গ্রামের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা হুজুর আলী ফকির, কাউসার আলী ও স্থানীয় বাসিন্দারা বাংলানিউজকে জানান, ৮ ডিসেম্বর গোলাবারুদ ফুরিয়ে গেলে বীর মুক্তিযোদ্ধারা বাধ্য হয়ে এ গ্রাম থেকে অন্যত্র সরে যান। আর যুদ্ধে আব্দুর রাজ্জাক পাঠান নামে এক বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাকের বাড়ি সদর উপজেলার আগদিঘা গ্রামে। সেই সময় তাকে পানির মধ্যেই দাফন করা হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধারা সরে যাওয়ার পর রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা গ্রামে ঢুকে লুটপাট করার পর বাড়ি ঘর আগুন দিয়ে জালিয়ে দেয়। গুলি করে হত্যা করে গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি জসিম উদ্দিন মোল্লাকে।  

শহীদ জসিম উদ্দিনের ছেলে জিল্লুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, আব্দুল কাদের, করিম শিকদার,খালেক ও ওয়াজেদের নেতৃত্বে স্থানীয় রাজাকাররা তার বাবাকে গুলি করে হত্যা করে। এমনকি তারা বাবার মরদেহ দাফন করতে আত্বীয় স্বজন সহ এলাকবাসীদের বাধা দিয়েছে। পরের দিন তার বাবার মরদেহ দাফন করা হয়।  

নির্যাতিত পরিবারের সদস্য সোলায়মান আলী, ছমির উদ্দিন ও আব্দুল গফুর বাংলানিউজকে জানান, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেয়ার অপরাধে আব্দুল কাদের, করিম শিকদার,খালেক ও ওয়াজেদের নেতৃত্বে রাজাকারা অনেককে নিজের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিতে বাধ্য করেছে। নির্যাতনও করা হয়েছে তাদের। ওই সব পোড়া টিন ৮ ডিসেম্বর আসলেই  খোলাবাড়িয়া গ্রামের ভয়াবহ স্মৃতি মনে করে দেয়। স্বাধীনতার পর গণপিটুনিতে রাজাকারদের অনেকেই মারা যায়। বেঁচে 
থাকা রাজাকারদের বিচার চেয়েও পাওয়া যায়নি।  

খোলাবাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা মামুনুর রশীদ অভিযোগের সুরে বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরেও শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাকের কবর স্থায়ীভাবে 
চিহ্নিত করা হয়নি। তবে যে স্থানে তাকে দাফন করা হয়েছিল, সেই স্থান থেকে দুই বছর আগে স্বজনরা কবরটি স্থানান্তর করে নিজ গ্রাম আগদিঘায় নিয়ে গেছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাকের কবর চিহ্নিত ও খোলাবাড়িয়া গ্রামের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার। যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত খোলাবাড়িয়া ও মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানতে পারে।  

দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে খোলাবাড়িয়া গ্রামে সম্প্রতি একটি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে, যা এরই মধ্যে এলাকায় ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।  

তবে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন না করায় সেখানে ডিসেম্বরে কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা সম্ভব হয়নি।  

তিনি ৮ ডিসেম্বর খোলাবাড়িয়া গ্রামে হানাদার মুক্ত দিবস পালনের দাবি জানান।  

একইসঙ্গে দিবসটির তাৎপর্য তুলে ধরে নতুন প্রজন্মকে খোলাবাড়িয়া গ্রামের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য উপজেলা প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান।    

নলডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুখময় মরকার বাংলানিউজকে জানান, বিষয়টি তার জানা ছিল না। তবে আগামী বছর থেকে খোলাবাড়িয়া গ্রামে হানাদারমুক্ত দিবস পালন করা হবে। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধে জীবন দানকারী সবার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হবে।  

এদিকে সাত বছর আগে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী আব্দুল কাদেরের বিরুদ্ধে মামলা করা হলেও এখনো তার কোনো ব্যবস্থা হয়নি। এ ব্যাপারে আব্দুল কাদের তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে জানান, সুনাম ক্ষুণ্ন করতে রাজনৈতিকভাবে তার বিরুদ্ধে এ মিথ্যা প্রচার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে দায়ের করা অভিযোগও মিথ্যা প্রমাণ হয়েছে।  

খোলাবাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা ও বর্তমানে নাটোর জজ কোর্টের পিপি সিরাজুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, আগে যেসব মামলা তদবিরের অভাবে নষ্ট হয়ে গেছে, তা পুনরায় চালু করে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৮, ২০২১
এসআই
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।