ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

‘ধূমপানের নির্ধারিত স্থান’ অধূমপায়ীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় হুমকি

রেজাউল করিম রাজা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২৮ ঘণ্টা, মে ৩, ২০২৩
‘ধূমপানের নির্ধারিত স্থান’ অধূমপায়ীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় হুমকি

ঢাকা: পাবলিক প্লেস ও গণপরিবহনে ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ (ডেজিগনেটেড স্মোকিং এরিয়া-ডিএসএ) রাখার বিধান অধূমপায়ীদের পরোক্ষ ধূমপান থেকে রক্ষা করতে পারছে না। ফলে অধূমপায়ীরাও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধূমপায়ীদের সুরক্ষায় ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত এলাকা’ কোনো ভূমিকা রাখছে না। হোটেল, রেস্টুরেন্ট এবং ট্রেনে ব্যাপকভাবে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছেন অধূমপায়ীরা। ডিএসএ বিলুপ্ত করার মাধ্যমেই কেবল শতভাগ ধূমপানমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব।

জনস হপকিন্স ব্লুমবার্গ স্কুল অব পাবলিক হেলথ এবং গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) যৌথভাবে ঢাকার ১১৮টি আবাসিক হোটেল ও ৩৫৫টি রেস্টুরেন্ট, ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া ৫৩টি ট্রেনের ওপর একটি গবেষণা চালায়। এ থেকে জানা যায়, মোট ৫২৬টি নমুনার মধ্যে মাত্র ৪১টিতে (৮ শতাংশ) ডিএসএ পাওয়া গেছে, যার একটিও পরিপূর্ণভাবে আইন মেনে করা হয়নি।  

গবেষণায় দেখা যায়, ১১৮টি আবাসিক হোটেলের মধ্যে মাত্র ১৮টিতে ডিএসএ পাওয়া গেছে। সাতটি হোটেলের ডিএসএ ধূমপানমুক্ত এলাকা থেকে আলাদা নয় এবং সাতটিতে সেবা প্রদানের জন্য কর্মীদের ডিএসএ অতিক্রম করতে হয়। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে ডিএসএ ধূমপানমুক্ত এলাকা থেকে পৃথক রাখার বিধান আছে। আইনি বাধ্যবাধকতা থাকলেও ১৭টি হোটেলের ডিএসএতে সতর্কতামূলক নোটিশ দেখানো হয়নি।  

গবেষণায় ৫৩টি ট্রেনের ২১টিতে ডিএসএ পাওয়া গেছে, যার মধ্যে সাতটিতে বিভিন্ন খাবার ও পানীয় বিক্রি হওয়ায় অধূমপায়ীয়দের পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হওয়ার সুযোগ রয়েছে। ডিএসএ থাকা ২১টি ট্রেনের কোনোটাতেই ধূমপানের জন্য ডিএসএ সংক্রান্ত কোনো নোটিশ দেখা যায়নি। একটি ট্রেনেও পরিপূর্ণভাবে আইন মেনে ডিএসএ রাখা হয়নি। ৩৫৫টি রেস্টুরেন্টের মধ্যে মাত্র দুটিতে ডিএসএ পাওয়া গেছে এবং কোনোটিতেই পরিপূর্ণভাবে আইন মানা হয়নি।  

গবেষণা দলের সদস্য এবং প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের বলেন, ধূমপানের জন্য নির্ধারিত এলাকা অধূমপায়ীদের পরোক্ষ ধূমপান থেকে সুরক্ষা দিতে পারে না। এই বিধান চালু রেখে ধূমপানমুক্ত আইনের সুফল পাওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং শতভাগ ধূমপানমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে ডিএসএ বাতিল করা প্রয়োজন।

গ্লোব্যাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) ২০১৭ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে আচ্ছাদিত কর্মস্থলে কাজ করেন এমন প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর ৪২ দশমিক ৭ শতাংশ (৮১ লাখ) পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়। প্রায় ২৪ শতাংশ (২ কোটি ৫০ লাখ) প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ গণপরিবহনে যাতায়াতের সময়, ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ রেস্তোরাঁয় এবং ৩৬ দশমিক ২ শতাংশ চা-কফির স্টলে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়। সবচেয়ে ভয়াবহ তথ্য হলো, প্রায় ৩৯ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ (৪ কোটি ৮ লক্ষ) বাড়িতে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়। প্রতি বছর প্রায় ৬১ হাজার শিশু পরোক্ষ ধূমপানজনিত বিভিন্ন অসুখে ভোগে।  

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, পরোক্ষ ধূমপানের কারণে পৃথিবীতে বছরে ১২ লাখ মানুষ অকালে মারা যান। তামাকের ধোঁয়ায় রয়েছে সাত হাজার রাসায়নিক পদার্থ, যার মধ্যে ৭০টি ক্যান্সার সৃষ্টিকারী। ফুসফুস ক্যানসার, স্ট্রোক ও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারণ পরোক্ষ ধূমপান।  

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, পরোক্ষ ধূমপানের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ মোট তামাকজনিত অর্থনৈতিক ক্ষতির প্রায় ১০ শতাংশ। বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত ‘ইকোনমিক কস্ট অব টোব্যাকো ইউজ ইন বাংলাদেশ: এ হেলথ কস্ট অ্যাপ্রোচ’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পরোক্ষ ধূমপানের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ প্রায় ৪ হাজার ১শ কোটি টাকা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোলের (এফসিটিসি) ধারা ৮ এর গাইডলাইন অনুযায়ী, পরোক্ষ ধূমপানের শিকার থেকে অধূমপায়ীদের রক্ষায় ‘পূর্ণাঙ্গ ধূমপানমুক্ত নীতিমালা’ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে এফসিটিসির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ২০১৬ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের নির্দেশনা দিয়েছেন।  

ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ অনুযায়ী চতুর্দিকে দেয়াল দিয়ে আবদ্ধ রেস্টুরেন্টসহ অধিকাংশ আচ্ছাদিত পাবলিক প্লেস এবং কর্মক্ষেত্রে ধূমপান নিষিদ্ধ। তবে মাত্র কয়েকটি স্থান ছাড়া বেশিরভাগ পাবলিক প্লেস এবং একাধিক কামরাবিশিষ্ট পাবলিক পরিবহনে (ট্রেন, স্টিমার) ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ রাখার সুযোগ রয়েছে। ফলে অধূমপায়ীদের পাশাপাশি এসব স্থানের সেবাদান করা কর্মীরাও পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন। তাই বিদ্যমান আইনটি পরোক্ষ ধূমপান থেকে অধূমপায়ীদের রক্ষায় ভূমিকা রাখছে না। অসংখ্য গবেষণায় এটি স্বীকৃত যে, আচ্ছাদিত ধূমপান এলাকার আশেপাশের স্থানসমূহ কখনো ধোঁয়ামুক্ত হয় না।

তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সমন্বয়কারী এবং স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব হোসেন আলী খোন্দকার বাংলানিউজকে বলেন, ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান (ডিএসএ) বাতিল করার জন্য বিভিন্ন সচেতন মহলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। যারা অধূমপায়ী তারা পরোক্ষ ধূমপানের কারনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিভিন্ন দেশেও ইতিমধ্যে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান বাতিল করা হয়েছে। কিছু হোটেল মালিকও এটা বাতিল হোক চাচ্ছে। যারা ধূমপান করে না, তাদের ক্ষতি করার কোনো অধিকার কারও নেই। আইনে ডিএসএ রাখার বিধান থাকায় মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আইন সংশোধন হলে এটি যেন বাতিল করা হয়।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ (২০১৩ সালে সংশোধিত) অধিকতর শক্তিশালীকরণের লক্ষ্যে খসড়া সংশোধনীতে সকল পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ রাখার বিধান বিলুপ্ত করেছে। বিভিন্ন ধাপ অনুসরণ করে আইনের খসড়া মন্ত্রিসভার অনুমোদনের জন্য কেবিনেট ডিভিশনে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রিসভার অনুমোদনের পর প্রয়োজনীয় ভেটিং শেষে খসড়াটি জাতীয় সংসদে উপস্থাপনের মাধ্যমে চূড়ান্ত করা হবে।  

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ (ডিএসএস) বাতিল এবং ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার পথ আরও সুগম হবে বলে মন করছেন, তামাক বিরোধী বিভিন্ন সংগঠন, ব্যক্তি এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।  

বাংলাদেশ সময়: ১৯১৯ ঘণ্টা, মে ৩, ২০২৩

আরকেআর/আরএইচ 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।