ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

রাজবাড়ীর স্বাস্থ্যসেবা বেহালে: ছাগল চরে খেয়ালে!

কাজী আব্দুল কুদ্দুস, জেলা প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৪৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১২
রাজবাড়ীর স্বাস্থ্যসেবা বেহালে: ছাগল চরে খেয়ালে!

রাজবাড়ী: বহুমুখি সমস্যা আর অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত রাজবাড়ী জেলার স্বাস্থ্যসেবা। এলাকাবাসীর অভিযোগ, রাজরাড়ীর স্বাস্থ্যসেবা চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।

এমনকী হাসপাতালের বারান্দায় রোগীর বদলে ছাগলও চড়ে বেড়ায়।

১৯৬৩ সালে স্থাপিত রাজবাড়ী আধুনিককৃত সদর হাসপাতালে অর্ধশত বছরেও আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি। গুরুত্বপূর্ণ পদে চিকিৎসক না থাকায় স্বাস্থ্যসেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ফলে, জেলার প্রায় ১২ লাখ লোক স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

রাজবাড়ী জেলার ৫টি উপজেলার মধ্যে ৪টিতে সরকারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থাকলেও নবগঠিত কালুখালী উপজেলায় কোনো সরকারি হাসপাতাল গড়ে ওঠেনি।

আর্থিকভাবে সচ্ছল রোগীরা স্থানীয় বিভিন্ন ক্লিনিক ছাড়াও ফরিদপুর-ঢাকায় গিয়ে চিকিৎসা সেবা নিতে পারলেও গরিব রোগীরা ভোগান্তিতে থাকেন। হাসপাতালে জরুরি বিভাগে ৪ জন চিকিৎসকের প্রয়োজন হলেও এখনও কোনো পদই সৃষ্টি করা হয়নি। হাসপাতালে সার্জারি বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট নেই ৮ বছর ও অ্যানেসথেসিয়ার চিকিৎসক নেই ৫ বছর ধরে।
 
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৬৩ সালে স্থাপিত হাসপাতালটিকে ২০০৩ সালে ১০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে উন্নীত করা হয়। কিন্তু, চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন আগের ৫০ শয্যারই। এখানে চিকিৎসকের পদ রয়েছে ১৮টি। এর মধ্যে শূন্য পদ ৭টি।

এ বিষয়ে হাসপাতালের পরিসংখ্যান শাখা থেকে জানা যায়, সিনিয়র কনসালট্যান্ট(সার্জারি) পদ শূন্য ৮ বছর এবং জুনিয়র কনসালট্যান্ট (অবেদনবিদ) ও জুনিয়র কনসালট্যান্ট (রেডিওলজি) পদ ৫ বছর ধরে শূন্য। সিনিয়র কনসালট্যান্ট (শিশু) পদ শূন্য প্রায় ২ বছর এবং ও রেডিওলজিস্ট পদ শূন্য রয়েছে প্রায় ১ বছর ধরে। এছাড়া জরুরি বিভাগে চিকিৎসকের কোনো পদই সৃষ্টি করা হয়নি। এছাড়া ইনডোরে মেডিকেল অফিসারের কোনো পদ নেই।

এ বিষয়ে হাসপাতাল এলাকার পৌর কাউন্সিলর কাজী মাহতাব উদ্দিন তৌহিদ বাংলানিউজকে জানান, হাসপাতালে যে সংখ্যক চিকিৎসক থাকার কথা তা নেই। ফলে, কর্মরত চিকিৎসকদের ওপর চাপ অনেক বেড়ে যাচ্ছে। যাদের আর্থিক স্বচ্ছলতা আছে, তারা ক্লিনিক ও ঢাকা গিয়ে চিকিৎসা করাচ্ছেন। আর বাকিরা চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন। এ কারণে চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়ানো খুবই প্রয়োজন।

এ বিষয়ে সদর হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. এফএম এ হান্নান বাংলানিউজকে বলেন, ‍‌নানা সীমাবদ্ধতা ও লোকবলের স্বল্পতা থাকা সত্ত্বেও আমি নিজের দায়িত্বসহ অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। সব শূন্য কনসালট্যান্ট পদে ও নিয়মিত আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেওয়া খুবই জরুরি।

এছাড়া ১০০ শয্যার জন্য নির্মিতব্য অবকাঠামো নির্মাণের কাজ দ্রুত শেষ করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে ১০০ শয্যার জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদ সৃষ্টি করা প্রয়োজন।

এ বিষয়ে রাজবাড়ীর সিভিল সার্জন ডা. মো. নুরুল আমিন বাংলানিউজকে জানান, চিকিৎসক ও জনবলের বিষয়টি প্রতিমাসেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ডিভিশনার অফিসসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কতৃর্পক্ষকে লিখিতভাবে জানিয়ে আসছি।

বেহাল দশায় বালিয়াকান্দি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স

রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই অবেদিনবিদ (অ্যানেসথিয়াসিস্ট) ও জরুরি বিভাগের কোনো পদই সৃষ্টি করা হয় নি। প্রায় আড়াই লাখ মানুষের ভরসা এই হাসপাতালে ৯ জন চিকিৎসকের স্থলে কর্মরত রয়েছেন মাত্র ৪ জন।

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা যায়, ১৯৮০ সালে স্বাস্থ্যকমপ্লেক্স স্থাপিত হয়। শুরুর সময় ৩১ শয্যাবিশিষ্ট হলেও ২০১১ সালে এটিকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। অবকাঠামোগত সব সুবিধা থাকা সত্ত্বেও জনবল না থাকায় এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

জানা যায়, একমাত্র অ্যাম্বুলেন্সটি ২ বছর ধরে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। ১ বছর ধরে চালকের পদও শূন্য। এক্সরে মেশিন থাকা সত্ত্বেও ফিল্ম না থাকায় ১ বছর ধরে মেশিনটি কোনো কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এর ফলে রোগীরা বাইরে থেকে দ্বিগুণ বা বেশি টাকায় পরীক্ষা করাচ্ছেন।

আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তার অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মে মাস থেকে ৬ মাসের ট্রেনিংয়ে গেছেন। আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা জুলাই মাস থেকে ৩ মাস ছুটিতে আছেন।

কনসালট্যান্ট (গাইনি), চক্ষু, চর্ম, শিশু, ও কনসালট্যান্ট (অ্যানেসথেসিয়া)-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ সৃষ্টিই করা হয়নি। ডেন্টাল সার্জন পদ শূন্য রয়েছে এক যুগ ধরে। মেডিকেল অফিসার ২ জনই গত বছর থেকে জাতিসংঘ মিশনে দেশের বাইরে আছেন। মেডিকেল অফিসার-১ গেছেন অক্টোবরে ও মেডিকেল অফিসার-২ নভেম্বরে ১ বছরের জন্য জাতিসংঘ মিশনে কর্মরত।

এবিষয়ে বালিয়াকান্দি সদরের চেয়ারম্যান খন্দকার মশিউল আজম চুন্নু বাংলানিউজকে জানান, একে তো হাসপাতালে পর্যাপ্ত চিকিৎসক নেই, তারপরে আবার অনেকেই রাজবাড়ীতে থাকেন। ফলে, যাদের টাকা-পয়সা আছে, তারা রাজবাড়ী বা ফরিদপুর গিয়ে চিকিৎসা করাচ্ছেন। এলাকার গরিব মানুষ চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। চিকিৎসা না পেয়ে তারা ফিরে যাচ্ছেন।

এবিষয়ে বালিয়াকান্দি উপজেলার ভারপ্রাপ্ত ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আব্দুল্লাহ আল সাইফ বাংলানিউজকে জানান, চিকিৎসকের শূন্য পদসহ অন্যান্য পদগুলো পূরণ করার জন্য প্রতিমাসেই লিখিতভাবে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়। জরুরি প্রসূতি সেবা ও অ্যানেসথেসিয়া পদটি পূরণ করা খুবই প্রয়োজন।
 
অপারেশন থিয়েটার বন্ধ গোয়ালন্দ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে

১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত গোয়ালন্দ উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। বর্তমানে এ উপজেলায় ১ লাখ ১৭ হাজার ৭৮ জন মানুষের বিপরীতে হাসপাতালটিতে ৯ জন চিকিৎসক কর্মরত রয়েছেন।

উন্নতমানের অপারেশন থিয়েটার থাকার পরও ১ জন জুনিয়র কনসালট্যান্ট ও ১ জন গাইনি ও অ্যানেসথেসিয়া ডাক্তারের অভাবে ১ বছরেরও বেশি সময় ধরে অপারেশন বন্ধ রয়েছে। ফলে, পদ্মা নদী তীরবর্তী এ উপজেলার মানুষ মারাত্মকভাবে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

খুলনা-দৌলতদিয়া মহাসড়ক লাগুয়া হওয়ায় এই হাসপাতালটিতে সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের নিয়ে আসা হলেও তাদের উপযুক্ত চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয় না। জরুরিভাবে রোগীদের পাশের ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসাপাতাল বা রাজধানী ঢাকায় পাঠানো হয়। এতে অনেক রোগী পথিমধ্যে মারা যান বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

অপরদিকে, এ উপজেলার মায়েদের এই হাসপাতলে সিজার করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে, নিরূপায় হয়ে তাদের বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে উচ্চমূল্যে সিজার করাতে হচ্ছে।

এবিষয়ে আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. আহমেদ আল-মারুফ বাংলানিউজকে জানান, এ হাসপাতালটিতে চিকিৎসা সেবার সব ধরনের উপকরণ আছে। শূন্যপদের বিপরীতে চিকিৎসক পেলেই ভালোভাবে চিকিৎসা সেবা দেওয়া সম্ভব।

সেবার মান বাড়েনি পাংশা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে

জেলার বৃহত্তম উপজেলা পাংশায় ৪ লাখ ৫০ হাজার মানুষের বসবাস। তাদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য পদ্মা বিধৌত এ অঞ্চলের মানুষের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পেলেও সে অনুপাতে বাড়েনি স্বাস্থ্য সেবার মান। পায়নি আধুনিকতার ছোঁয়া।

হাসপাতাল অফিস সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৮ সালে ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। এখানে চিকিৎসকের পদের সংখ্যা রয়েছে ৩৬টি। কিন্তু এর মধ্যে হাসপাতালে বর্তমানে ১৭টি পদ শূন্য রয়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের ১০ জনের মধ্যে ৭টি পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য রয়েছে।

আবাসিক মেডিকেল অফিসারের পদটি দীর্ঘদিন ধরে শূন্য রয়েছে। এছাড়া অতি গুরুত্বপূর্ণ গাইনি,  জুনিয়র কনসালট্যান্ট (সার্জারি) পদ শূন্য থাকায় জরুরি সময়ে অপারেশন করা সম্ভব হচ্ছে না।

এতে এ এলাকার গরিব, দুঃস্থ পরিবারের মানুষ তাদের মৌলিক অধিকার হারাচ্ছেন। তারা টাকার অভাবে রাজবাড়ী সদর, ফরিদপুর বা স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে চিকিৎসা সেবা নিতে না পেরে বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মারা যাচ্ছেন।

এবিষয়ে পাংশা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা এএফএম শফিউদ্দিন বাংলানিউজকে জানান, পর্যাপ্ত চিকিৎসক না থাকায় চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে। প্রতিমাসে চিকিৎসকদের শূন্য পদ পূরণের জন্য সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন মহলকে জানানো হচ্ছে।

চিকিৎসক নিয়োগের ব্যাপারে ইতোমধ্যে আশ্বাস পেয়েছি। আশা করি, দ্রুত এ সমস্যা সমাধান হবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৮০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১২
সম্পাদনা: শাফিক নেওয়াজ সোহান, নিউজরুম এডিটর, আশিস বিশ্বাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।