ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

দেশে ভ্যাকসিনের সঙ্কট, রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা

মাসুদ আজীম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০১৯
দেশে ভ্যাকসিনের সঙ্কট, রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা প্রতীকী

ঢাকা: হেপাটাইটিস, চিকেনপক্স ও সার্ভিক্যাল ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধী বিদেশি ভ্যাকসিনের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে দেশে। বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে ভ্যাকসিনগুলোর অন্যতম প্রধান সরবরাহকারী ওষুধ কোম্পানি। সংশ্লিষ্ট আরো অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের আমদানি বন্ধ থাকায় এ সঙ্কট দেখা দিয়েছে। আর এই সঙ্কটের কারণে এ সংক্রান্ত ব্যাধিগুলো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।

দেশের একাধিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভাইরোলজি বিভাগের চিকিৎসক, ভ্যাকসিন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ও টিকাকেন্দ্রে এসে প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন না পাওয়া ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশের বাজারে ১৯টি ভ্যাকসিন বাজারজাত করতো আন্তর্জাতিক কোম্পানি গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন (জিএসকে)।

কোম্পানিটি ব্যবসা বন্ধ করে চলে যাওয়ায় অন্যান্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো চাহিদা অনুযায়ী জোগান দিতে পারছে না। তাছাড়া দেশীয়ভাবে উৎপাদন ঘাটতিও রয়েছে। যদিও দেশের ওষুধ প্রশাসন কর্তৃপক্ষ দাবি করছে ভ্যাকসিনের কোনো সঙ্কট তৈরি হয়নি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ভাইরোলজি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, জিএসকের ব্যবসা বন্ধ হওয়ায় ওই কোম্পানির তৈরি শিশু ও প্রাপ্ত বয়স্কদের হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের জন্য এনজেরিক্স নামে দু’টি, হেপাটাইটিস-এ প্রতিরোধে হেভারিক্স, চিকেনপক্স এর জন্য ভারিলোরিক্স, মাম্ফ-মিজলেস ও রুবেলা ভাইরাস প্রতিরোধে প্রিওরিক্স (এমএমএমআর) সার্ভিক্যাল ক্যান্সার প্রতিরোধে সারভারিক্স ও ডায়রিয়ার জন্য রোটারিক্স ভ্যাকসিন না থাকায় অনেক রোগী ফিরে যাচ্ছে। পাশাপাশি টিটেনাসের জন্য ইনফানরিক্স, বুস্টরিক্স, মেনিনজো-কোক্কাল এর জন্য এসিডাব্লিও ভ্যাক্স, হেপাটাইটিস-এ এর জন্য এমব্রিক্স, হেপাটারিক্স, হেপাটাইটিস-বি এর জন্য ফেন্ডরিক্স, ইনফ্লুয়েঞ্জার জন্য ফ্লুয়ারিক্স ও ফ্লুলাভাল ছাড়াও ইনফানরিক্স আইভিপি, কিনরিক্স, মেনহিবরেক্স, মেনিটোরিক্স, পেডিয়াট্রিক্সসহ ১৯টি ভ্যাকসিনের সরবারহ বন্ধ হয়ে গেছে।

এছাড়া নিউমোনিয়া প্রতিরোধে সনোফির তৈরি নিউমো-২৩, ইনফ্লুয়েঞ্জার জন্য ট্রিমাভ্যাক্স-১০ ভায়াল, জলাতঙ্কের চিকিৎসায় ফ্যাভিরাব সোল ও টিটেনাসের জন্য টেটাভ্যাক্স ০.৫ এমএল বাজারে নেই বলে জানা গেছে। আর জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধে হেলথ কেয়ার লিমিটেডের আমদানিকরা গার্ডাসিল, নিউমোনিয়ার জন্য নিউমোভ্যাক্স-২৩ সরবারহ নাই বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

এ ব্যাপারে ভ্যাকসিন আমদানিকারক কোম্পানি সনোফি বাংলাদেশ লিমিটেডের মার্কেটিং বিভাগের রিসার্চ এক্সিকিউটিভ বাংলানিউজকে জানান, এ মুহূর্তে তাদের কোম্পানির একটি ভ্যাকসিন আছে। যেটা হচ্ছে ইনফ্লুয়েঞ্জার জন্য ব্যবহার করা হয়। এছাড়া তাদের বাকি ভ্যাকসিনগুলো বাজারে নেই। কারণ এগুলো আমদানি করা হয় এবং বিক্রির ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট টার্গেট দিয়ে দেয়। সে সব টার্গেট দেশে সম্পূর্ণ করা সম্ভব হয়নি বলে চুক্তি বাতিল হয়েছে। তবে খুব দ্রুত আরো বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক রোগের সমন্বিত ভ্যাকসিন আমদানি করা হবে।

ভ্যাকসিন সরবরাহ কম থাকার বিষয়ে হেলথ কেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের গ্রুপ প্রোডাক্ট ম্যানেজার মিনহাজ আহমেদ বলেন, আমরা দেশে ভ্যাকসিন উৎপাদন করি না। সাধারণত আমেরিকান একটি কোম্পানির কাছ থেকে ভ্যকসিন আমদানি করতাম। ওই কোম্পানিটি আবার সরকারের পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের অধীনস্ত কিছু ওষুধ সরবরাহ করতো। যে কোন সরকারের সঙ্গে ওই চুক্তিটি বাতিল হয় এবং তারাও বাংলাদেশে ব্যবসা গুটিয়ে নেয়। আমাদের সঙ্গে কথা হয়েছিল এ বছরের মার্চ এপ্রিল নাগাদ আবার ভ্যাকসিনগুলো আসার একটা সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু এখন তাও সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না।  

অন্যদিকে স্থানীয় ভ্যাকসিনের বিষয়ে বিশেজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, আমদানিকৃত ভ্যাকসিন আন্তর্জাতিকভাবে মান নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু কাঁচামাল সংগ্রহ করে স্থানীয়ভাবে বোতলজাত করলে যথাযথ মান নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই সম্ভব হয় না। তাছাড়া বাংলাদেশের ওষুধ বিদেশে রপ্তানি করার সময় সে দেশের বায়ো-ইকিউভ্যালেন্স করা হয়। যেটা দেশে বাজারজাত করার ক্ষেত্রে করা হয়না। তাই সরকার চাইলে স্থানীয়ভাবে আরো বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষার পাশাপাশি এ সংক্রান্ত আইন করে তা বাস্তবায়ন করতে পারে।

এ বিষয়ে বিএসএমএমইউ’র নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অধ্যাপক বাংলানিউজকে বলেন, দেশীয় প্রতিষ্ঠানের ভ্যাকসিন থাকা উচিৎ যেটা নিজেরা প্রমোট করতে পারবো। যদিও দেশীয়ভাবে কিছু ভ্যাকসিন তৈরি হচ্ছে কিন্তু মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ দেশে কোয়ালিটি সম্পন্ন প্লান্ট নাই। ফলে বাইরে থেকে কাঁচামাল এনে শুধু বোতলজাত করা হচ্ছে। যেগুলোর কোনভাবেই পোস্ট ভ্যালু ইভালুয়েশন করা হচ্ছেনা (অর্থাৎ বাজারে বিক্রি পরবর্তি কার্যকরিতা মূল্যায়ন হচ্ছেনা)। এমনকি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ছাড়াই মানুষের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে।

সামগ্রিক বিষয়ে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক রুহুল আমিনের কাছে জানতে চাইলে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, আমদানিকরা ভ্যাকসিনের বেশকিছু ইনসেপ্টা, বেক্সিমকো, পপুলার ডায়গোনস্টিক সরবরাহ করেছে। কিছু ভ্যাকসিন আছে যেগুলো আমদানি করতে হচ্ছে। মূলত বিশ্ববাজারে ভ্যাকসিনের সরবারহ কম থাকায় এমনটা হয়েছে। আর এসব প্র্রোডাক্টের গুণমানের ক্ষেত্রে রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান নিজেরা ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল দিয়ে থাকে। বিদেশের ট্রায়াল ডকুমেন্টসগুলো আমদানিকারকের কাছে দেয়, তারা আবার অধিদফতরে জমা দেয়। সেখানে সেফটি, কার্যকরিতা, বিষক্রিয়া ও উপকারিতার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। আর কিছু কিছু ভ্যাকসিন আছে যেগুলো সরাসরি আমদানি করতে হয় সেসব লটের, ফিলিং পরীক্ষা-নিরীক্ষা সহ কোম্পানিগুলো বায়োলজিক্যাল পদ্ধতিতেও টেষ্ট করে। খুব একটা সংকট না থাকলেও ইতোমধ্যে আমদানিকারকদের এ বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ০৬৪৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০১৮
এমএএম/এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।