ঢাকা: ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ঢাল সিঁড়ি দেখে মনে হয়, ভর্তি রোগীদের মিছিল। যেখান দিয়ে চিকিৎসক, নার্স ও হাসপাতালে আসা সবার চলাচলের স্থান, সেখানে নিউরোসার্জারি অস্ত্রোপচার রোগীদের গাদাগাদি করে রাখা হয়েছে।
রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা ওই ঢাল সিঁড়িতে যাতায়াতকারীদের কখনো রোগীর শরীরে বা কখনো রোগীর বিছানায় অসাবধানতাবশত চলাচলের সময় পারা লেগে যাচ্ছে।
এদিকে ওয়ার্ডে বেড খালি নেই। তাছাড়া ছোট-খাট অস্ত্রোপচারের পর রোগীদেরও মেঝেতে রাখা হচ্ছে। ট্রলির ওপর রোগী নিয়ে যাতায়াতের সময় ট্রলির ধাক্কায়ও স্বজন ও রোগীরা আঘাত পান। এই ঢাল সিঁড়িতে বেশিভাগই মুমূর্ষু রোগীকে দেখা যায়। ওয়ার্ডের ভেতরে বেট খালি না থাকায় ঢাল সিঁড়িতে পাটি বিছিয়ে রোগীকে রেখে সেখানেই চিকিৎসা নেওয়ার চেষ্টা করছেন স্বজনরা।
মঙ্গলবার (১৭ নভেম্বর) দুপুরের দিকে ঢামেকের জরুরি বিভাগের মর্গের পাশে ঢাল সিঁড়ির মেঝেতে রোগীদের গাদাগাদির দৃশ্য দেখা যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের এক কর্মচারী বাংলানিউজকে জানান, এই ঢাল সিঁড়িটি নিচতলা থেকে চতুর্থ তলায় আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) গিয়ে ঠেকেছে। মূলত ট্রলিতে থাকা রোগীদের চলাচলের জন্য এটা তৈরি করা হয়েছিল। হাসপাতালে দুই এক জায়গায় সাধারণ সিঁড়ি থাকলেও এই ঢাল সিঁড়ি একটাই। হাসপাতালে ঢুকলেই ঢাল সিঁড়িটি সবার চোখে পড়ে। ফলে এই সিঁড়িটি দিয়েই সবচেয়ে বেশি ওঠা-নামা করা হয়।
নিচতলায় জরুরি বিভাগে নিউরোসার্জারি দু’টি ভর্তি ওয়ার্ড। ১০০ ও ১০৩ নম্বর ওয়ার্ড। এছাড়া দ্বিতীয় তলায় আছে নারীদের জন্য ২০৪, পুরুষ ২০০ ও ২০১ নম্বর ওয়ার্ড।
ওই কর্মচারি আরও জানান, নিচতলায় ৯৮ নম্বর একটি ওয়ার্ড আছে, সেটা হচ্ছে নিউরোসার্জারি জরুরি বিভাগ। সেখানে গুরুতর রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভর্তির জন্য রেফার করে।
প্রতিদিন কোনো না কোনো ওয়ার্ডে ভর্তির তারিখ থাকে। ভর্তি হতে হলে প্রথমেই জরুরি বিভাগ ৯৮ ওয়ার্ডে চিকিৎসক দেখিয়ে তারপর ভর্তি হতে হয়। যে দিন যেই ওয়ার্ডে ভর্তি থাকে, সে দিন আনুমানিক ২৪ ঘণ্টায় ৫০ জন রোগী ভর্তি হন। এত রোগীর জায়গা তো নেই। তাই যে যেখানে পারেন, জায়গা করে চিকিৎসার জন্য থাকছেন।
তিনি আরও জানান, এছাড়া টাকার বিনিময় বেড মেলে, এটাও কিন্তু সঠিক কথা। কেউ ২০০-৫০০ টাকা দিলে, তাকে আগে বেড দেওয়া হয়। কারণ ওয়ার্ডের ভেতরে একটা বেড খালি হলেই, রোগীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা লেগে যায়। ওয়ার্ডে থাকা দালালরা তখন এই সুযোগটাই নিয়ে নেন। যে বেশি টাকা দেন, তাকেই বেড দেওয়া হয়।
এ ব্যাপারে নিউরোসার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. অসিত চন্দ্র সরকার বাংলানিউজকে বলেন, নিউরোসার্জারি বিভাগে মোট ৩০০ বেড। রোগী আছেন চার শতাধিক। ফলে অন্য রোগীদের জায়গা দেব কোথায়। কিন্তু, গুরুতর রোগীদের তো ভর্তি নিতেই হবে। তাই বেড খালি না থাকলেও, তাদের ভর্তি নিতে হয়।
তিনি আরও বলেন, আমাদের ছোট ধরনের অস্ত্রোপচার রোগীরাও বেড পাচ্ছেন না। তারাও মেঝেতে থাকছেন। বিষয়টি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষরাও জানেন।
ঢাল সিঁড়িতে গিয়ে দেখা যায়, কিশোরগঞ্জ থেকে আসা শরিফ (২৭) নামে এক যুবক অস্ত্রোপচারের পর মেঝেতে শুয়ে আছেন। পাশে থাকা তার স্ত্রী রিনা বাংলানিউজকে বলেন, স্বামীর মাথায় ঘা হওয়ায় গত ০১ নভেম্বর নিউরোসার্জারি ২০০ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি হই। রক্তক্ষরণের কারণে ১২ নভেম্বর আমার স্বামীর অস্ত্রোপচার করা হয়। অস্ত্রোপচারের আগে তো কোনো বেড পাইনি। বেড খালি না থাকায় অস্ত্রোপচারের পরও বাধ্য হয়ে স্বামীকে নিয়ে ঢাল সিঁড়ির মেঝেতেই আছি।
নারায়ণগঞ্জ থেকে মাথায় রক্তক্ষরণের কারণে সোমবার (১৬ নভেম্বর) ভর্তি হন শামসুল হক (৬৫) নামে এক ব্যক্তি। তার অবস্থা গুরুতর হওয়ার কারণে ওইদিন রাতেই তার অস্ত্রোপচার করা হয়। সঙ্গে থাকা তার মেয়ে পারভিন আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, অস্ত্রোপচারের পরপর কোনো বেড না থাকায়, সরাসরি ঢাল সিঁড়ির মেঝেতেই বাবাকে নিয়ে আছি।
ঢামেক হাসপাতালের উপ-পরিচালক আলাউদ্দিন আল আজাদ বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের হাসপাতালে বেড অনুযায়ী রোগী অনেক বেশি। তাছাড়া হাসপাতালের দু’টি ভবন বর্তমানে করোনা ইউনিট। ফলে অন্য কোনো রোগী ওই ভবনে ভর্তি করা হয় না। নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডে প্রচুর রোগী, এত রোগী কোথায় রাখবো বলেন! তবু আমরা বিষয়টি নিয়ে কী করা যায়, সেটাই চিন্তা-ভাবনা করছি।
বাংলাদেশ সময়: ০৩৪৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৮, ২০২০
এজেডএস/এসআরএস