ফরিদপুর: আবারও করোনা মহামারি স্বরূপে ফিরতে শুরু করেছে ফরিদপুরে। ধীরে ধীরে বাড়ছে করোনা আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা।
আশঙ্কাজনক হারে করোনা বাড়ায় ইতোমধ্যে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে সরকার। ফরিদপুরে করোনা শনাক্তের সংখ্যা লাগামহীন বাড়ায় শঙ্কিত চিকিৎসকরা। মাস্ক ব্যবহার ও স্বাস্থ্যবিধি মানার ওপর জোর তাগিদ তাদের। তবে করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে সরকারি নির্দেশনায় অনীহা দেখাচ্ছে সাধারণ মানুষ। স্বাস্থ্যবিধি মেনে যত সিট ততো যাত্রী নিয়ে বাস চলার নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। ফরিদপুরে বিভিন্ন বাসে নির্ধারিত আসনের অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে বাস চলাচল করতে দেখা গেছে। পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি ও নিরাপদ শারীরিক দূরত্ব মানার ব্যাপারে উদাসীন ছিল বাসযাত্রী ও পরিবহন শ্রমিকরা।
এদিকে, চলতি মাসের শুরু থেকে হঠাৎ হাসপাতালগুলোতে রোগী ভর্তি হতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, জেনারেল হাসপাতালসহ শহরের কম-বেশি হাসপাতালগুলোতেও রোগী ভর্তি শুরু হয়েছে। এছাড়া সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় তাদের গুছিয়ে নেওয়া শয্যাগুলো পুনরায় সাজাতে শুরু করেছে।
বৃহস্পতিবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) সকাল থেকে জেলা শহরের নতুন বাসস্ট্যান্ড ও পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, গণপরিবহন শ্রমিক (বাস) ও যাত্রীদের মধ্যে কোনো সচেতনতা নেই। বাস চালক-সহকারী ও যাত্রীদের অধিকাংশের মুখে মাস্ক ছিল না। আসন না পেয়ে দাঁড়িয়ে গন্তব্যে যেতে দেখা যায় অনেক যাত্রীকে। শুধু গণপরিবহনগুলোতেও নয় জনসমাগম ঘটে এমন জায়গাগুলো মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি। এছাড়া ফরিদপুর শহরের মার্কেটগুলোতে নেই কোনো স্বাস্থ্যবিধির বালাই।
ফরিদপুরের ভাঙ্গাগামী একটি বাসের চালক নজরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, সকালে অফিস সময়ে এবং বিকেলে ছুটির সময় নিয়ম মানা সম্ভব হয়ে উঠছে না। তখন যাত্রীদের গাড়িতে উঠতে না দিলে আমাদের ওপর চড়াও হন তারা। যখন অফিস সময়ে থাকে না তখন সিটের অতিরিক্ত যাত্রী নেই না।
জেলা শহরের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী এমদাদ হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, মানুষ সচেতন না হলে করোনা থেকে কখনোই রেহাই পাওয়া যাবে না। চালক-হেলপার কেউই মাস্ক পড়ছে না। তার ওপর যাত্রী নিচ্ছে সিটের অতিরিক্ত। সরকার নির্দেশনা দিয়েই চুপ।
ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর ডা. মো. খবিরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ফরিদপুরে করোনার সংক্রমণ বাড়ছে। কাজেই সচেতন থাকা খুবই জরুরি। তবে আমরা কেউই তেমন স্বাস্থ্যবিধি মানছিনা। যা করোনা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ।
খবিরুল ইসলাম আরও বলেন, ডাবল ডোজ টিকা নিলে করোনা আক্রান্ত হবে না, ব্যাপারটা তেমন নয়। তবে, শারীরিক অসুস্থতা ও মৃত্যুর হার অনেক হ্রাস পেয়েছে। তাই, সবাইকে টিকা নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ তৈরি করতে হবে।
সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৮ জন করোনা রোগী ভর্তি আছেন। হোম আইসোলেশনে চিকিৎসা নিচ্ছেন ১৩২ জন।
ফরিদপুর জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. ছিদ্দীকুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, যেভাবে সংক্রমণ বাড়ছে, তাতে হাসপাতালেও রোগীর সংখ্যা বাড়তে পারে। ইতোমধ্যে বেশির ভাগ হাসপাতালগুলোতে রোগী ভর্তি হওয়া শুরু হয়েছে। তবে আমরা রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিতের বিষয়ে প্রস্তুত আছি। ইতোমধ্যে আমরা হাসপাতাল সংশ্লিষ্টদেরও বলেছি, তারাও যেন প্রস্তুত থাকেন। আশা করছি কোনো সমস্যা হবে না।
অন্যদিকে, ফরিদপুরে করোনা আক্রান্তদের ক্ষেত্রে এবারে নতুন করে রক্তে সোডিয়ামের মাত্রা কমে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। এক্ষেত্রে একইসঙ্গে আবার রোগীর ডায়রিয়া হচ্ছে। বমিও করছেন। এমন সব উপসর্গ দেখতে পাচ্ছেন কর্মরত চিকিৎসকরা।
ফরিদপুরে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের বেশ কয়েকজন চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রক্তের ঘনত্ব নির্ভর করে রক্তের সোডিয়ামের পরিমাণের ওপর। তাই রক্তে কোনো কারণে সোডিয়ামের মাত্রা এদিক-সেদিক হলে রক্তের ঘনত্ব পাল্টে যায়। রক্তে সোডিয়ামের স্বাভাবিক মাত্রা থাকে প্রতি লিটারে ১৩৬-১৪৫ মিলিমোল। রক্তে সোডিয়াম কমে গেলে তাকে ‘হাইপোনেট্রেমিয়া’ বলা হয়।
হাইপোনেট্রেমিয়ায় বমি ভাব, নিস্তেজ ভাব, দুর্বলতা, অসংলগ্ন কথা-বার্তা, চিন্তা-ভাবনা থেকে শুরু করে খিঁচুনি ও এমনকি অজ্ঞান হয়ে পড়ার মতো জটিলতা দেখা দিতে পারে।
এ বিষয়ে ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কয়েকজন চিকিৎসক বাংলানিউজকে বলেন, করোনার আগের ভ্যারিয়েন্টগুলোতেও ডায়রিয়া বা বমি হতো। কিন্তু বর্তমানে এ লক্ষণগুলো প্রকট আকারে দেখা যাচ্ছে। এটা হয়তো নতুন ভ্যারিয়েন্টের কারণে হচ্ছে। তবে নিশ্চিত নই। যেহেতু এখন পর্যন্ত নতুন ভ্যারিয়েন্টের জিনোম সিকোয়েন্সও সেভাবে হয়নি।
হাসপাতালটির পরিচালক ডা. মো. সাইফুর রহমান বলেন, আসলে নতুন ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়েছে কিনা সেটা এখনও জানা যায়নি। আমাদের এখানে জিনোম সিকোয়েন্স করার সুবিধাটাও অত বেশি তো না। তবে আমরা রোগীদের উপসর্গ দেখে চিকিৎসা দিচ্ছি।
ফরিদপুরে এখন পর্যন্ত ২৪ হাজার ৪৭৬ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে সুস্থ হয়েছে ২৩ হাজার ১৬৯ জন ও মৃত্যু হয়েছে ৫৪৮ জনের।
ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) অতুল সরকার বাংলানিউজকে বলেন, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী জেলা শহর ও উপজেলা পর্যায়ে করোনা প্রতিরোধ বিষয়ে প্রচার প্রচারণা চালানো হচ্ছে। জনসাধারণকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অনুরোধ জানানো হয়েছে। এছাড়া ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে আগের মতো মাস্ক ব্যবহার ও নিরাপদ দূরত্বে থেকে প্রার্থনা করার জন্য বলা হয়েছে।
তিনি বলেন, এই নির্দেশনা মানা না হলে প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২২
এসআরএস