ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

ম্যাগি এখন সিমেন্ট কারখানার জ্বালানি!

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২২ ঘণ্টা, জুন ১৯, ২০১৫
ম্যাগি এখন সিমেন্ট কারখানার জ্বালানি! ছবি:সংগৃহীত

ঢাকা: কিছুদিন আগেও ছেলে-বুড়ো সবার টেবিলে যে খাবারটি বিশেষ জায়গা দখল করে ছিল, এখন তা ব্যবহার হচ্ছে জ্বালানি হিসেবে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, সুইস বহুজাতিক খাদ্য ও পানীয় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নেসলে’র ইনস্ট্যান্ট নুডলস ম্যাগি’র ঠিকানা এখন কারখানার চুল্লি।



ভারতের কেন্দ্রীয় খাদ্যসুরক্ষা ও মান নিয়ন্ত্রক সংস্থার (এফএসএসএআই) নিষেধাজ্ঞার মুখে বাজার থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া ম্যাগি ধ্বংসের প্রক্রিয়া হিসেবেই এটি করা হচ্ছে বলে বুধবার (১৮ জুন) ভারতীয় একটি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে জানানো হয়।

সংবাদের বলা হয়, কর্ণাটকে ওয়াড়ির কালাবুর্গি জেলায় অবস্থিত এসিসি সিমেন্ট কারখানাসহ অন্তত পাঁচটি কারখানায় ম্যাগি বিকল্প জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। এ বিষয়ে একটি ভিডিও-ও প্রকাশ পেয়েছে।

এসিসি সিমেন্ট কারখানার প্রধান আরএস বিরদর সংবাদমাধ্যমটিকে বলেন, বাজার থেকে তুলে নেওয়া ম্যাগি নুডলসগুলোকে গুড়ো করে ৪০ মিলিমিটার সাইজের টুকরো করা হয়েছে। এরপর অন্যান্য বর্জ্য পদার্থ, যেমন তুষের সাথে মিশিয়ে বয়লারে দেওয়া হচ্ছে জ্বালানি হিসেবে।

এর আগে গত ৫ জুন মাত্রাতিরিক্ত সীসা ধরা পড়ার অভিযোগে ম্যাগি ইনস্ট্যান্ট নুডলসের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ভারতের কেন্দ্রীয় খাদ্যসুরক্ষা ও মান নিয়ন্ত্রক সংস্থার (এফএসএসএআই)। নির্দেশনায় সংস্থাটি বলে, ম্যাগির নয়টি অনুমোদিত ইনস্ট্যান্ট নুডলসের সবকয়টি পরীক্ষায় বিপজ্জনক এবং ঝুঁকিপূর্ণ বলে প্রমাণিত হয়েছে। তাই এসব নুডুলস বাজার থেকে প্রত্যাহার করতে হবে। একই সঙ্গে নতুন করে উত্পাদন, আমদানি, বণ্টন এবং বিক্রিও বন্ধ রাখতে হবে।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ১১ জুন মুম্বাইয়ের সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হন নেসলে ইন্ডিয়া লিমেটেডের আইনজীবীরা। এ নিয়ে ১২ জুন যুক্তিতর্ক হয়। যুক্তিতর্ক চলাকালে নেসলের আইনজীবীরা দাবি করেন, ম্যাগি নুডলস পণ্য খাদ্যসুরক্ষা ও মান ধরে রাখতে ব্যর্থ নয়। এটা জোর করেও তৃতীয় বিশ্বের (উন্নয়নশীল দেশ) ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে না। এ নুডলস সম্পূর্ণ নিরাপদ।

ম্যাগির নয়টি ব্র্যান্ডের ওপর এফএসএসএআই’র তরফে যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে সেটি ‘অযৌক্তিক’ ও ‘গোঁড়া’ বলেও দাবি করেন তারা। তারা অভিযোগ করেন, যে নুডলসের নমুনাগুলো পরীক্ষা করা হয়েছে সেগুলো অনেক আগেই নেসলের পক্ষ থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। এসময় তারা কয়েকটি পণ্যের পরীক্ষার তারিখ ও নেসলে কর্তৃক মেয়াদোত্তীর্ণ ঘোষণার তারিখও তুলে ধরেন আদালতের সামনে। এছাড়া, তিনটি নুডলসের নমুনা পরীক্ষা করে সবগুলোর ওপরই নিষেধাজ্ঞা আরোপে স্থানীয় আইন লঙ্ঘিত হওয়ার অভিযোগ তোলেন তারা।

তবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা বলেন, খাদ্যসুরক্ষা ও মান নিশ্চিত করে খাবার সরবরাহের আইন থাকলেও তা ম্যাগি মানেনি। তাছাড়া, তাদের উৎপাদিত পণ্য পরীক্ষা করেই বিপদের কথা নিশ্চিত হওয়া গেছে।

উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে আদালত বলেন, যেখানে নেসলেই তার ম্যাগি প্রত্যাহার করে নিয়েছে, সেখানে নিষেধাজ্ঞার আর কোনো প্রশ্ন আসছে না।

এসময় রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষেত্রে নেসলের পক্ষ থেকে যে আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলা হয়েছে তা-ও খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেন আদালত। নির্দেশনার জবাব দিতে দুই সপ্তাহ সময় বেঁধে দেওয়া হয় নেসলেকে। আগামী ৩০ জুন আবেদনটির পরবর্তী শুনানির দিন নির্ধারণ করা হয়।

এর পরপরই গত মঙ্গলবার  (১৬ জুন) ৪ কোটি প্যাকেট ম্যাগি ইনস্ট্যান্ট নুডলস বাজার থেকে তুলে নিয়ে ধ্বংসের ঘোষণা দেয় নেসলে। এই বিপুল পরিমাণ নুডলসের ওজন ২৭ হাজার টন, আর বাজার মূল্য ৫ কোটি মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় চারশ কোটি টাকা।

নুডলস ধ্বংসের কথা নিশ্চিত করে বিবৃতিতে প্রতিষ্ঠানটি বলে, এই পাঁচ কোটি ডলারের বাইরেও আরও খরচ রয়েছে। বাজারে ছড়িয়ে থাকা পণ্যগুলোকে ফেরত আনা, এগুলোকে ধ্বংসের জন্য নির্ধারিত স্থানে পরিবহন ও ধ্বংস ইত্যাদি। ধ্বংস করা নুডলসের বাজার মূল্যসহ চূড়ান্ত খরচের হিসাব পরবর্তীতে জানানো হবে।

নুডলসগুলো বাজার থেকে প্রত্যাহার করে ধ্বংস করতে অন্তত ৪০ দিন সময় লাগবে বলে সেসময় জানায় নেসলে।

ভারতে নুডলস বাজারের ৮০ শতাংশই সুইস বহুজাতিক খাদ্য ও পানীয় সরবরাহকারী এই প্রতিষ্ঠানটির দখলে। ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠানটির নুডলস ভারতে আসে। এরপর এটি এতোটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, দেশটির প্রায় প্রতিটা মুদি দোকানেই ঝুলে থাকতে দেখা যায় ম্যাগি নুডলসের প্যাকেট।

এদিকে,  বাংলাদেশেও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে নেসলে’র ইনস্ট্যান্ট নুডলস ম্যাগি। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) খাদ্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরীক্ষাগারে ম্যাগিতে সীসা শনাক্ত হয়েছে। তবে এ সংক্রান্ত রিপোর্ট নিয়ে শুরু হয়েছে টালবাহানা।

বাংলানিউজের অনুসন্ধানী টিম বিসিএসআইআর কর্তৃপক্ষের কাছে পরীক্ষার ফলাফল সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা জানায়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর এই পরীক্ষা করিয়েছে, এই রিপোর্টে যা রয়েছে তা কেবল তাদেরই সম্পত্তি। সিলগালা করে তাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। তারাই এর তথ্য জানাবেন।

পরে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে খোঁজ নিতে গেলে সেখান থেকে জানানো হয়, সিলগালা রিপোর্ট বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

তবে এ ব্যাপারে গতকাল বৃহস্পতিবার (১৮ জুন) সচিবালয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা (বিএসটিআই), বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণাগার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) পুষ্টি বিজ্ঞান অনুষদে ম্যাগি নুডলসের পরীক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব পরীক্ষায় সীসা ধরা পড়লে দেশেও ম্যাগি নুডলস বাজারজাত বন্ধ করা হবে।

এদিকে, বাংলাদেশে সুপারশপ বা দোকানিদের কাছে ম্যাগি নুডলস থাকলেও ক্রেতারা কিনছেন না। ফলে অনেকেই এখন বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন।

বিক্রেতারা বলছেন, বাংলাদেশে সরকারিভাবে নিষিদ্ধ না করলেও ভারতের বিষয়টি বিভিন্নভাবে জেনে গেছে গ্রাহকরা। ম্যাগি নুডলস কিনেও অনেকে ফেরত দিচ্ছেন। এতে ম্যাগি নুডলস বিক্রি প্রায় শূন্যের কোঠায় গিয়ে ঠেকেছে।

ক্রেতারা বলছেন, এতদিন ভারতে তৈরি ম্যাগি নুডল বাংলাদেশে বাজারজাত করা হচ্ছে বলে বিজ্ঞাপন করা হয়েছে। ভারতে নিষিদ্ধ হওয়ার পর কোম্পানির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দেশে উৎপাদিত ম্যাগিই বিক্রি করা হচ্ছে।

ম্যাগির এ দ্বিমুখী প্রচারণাকে গ্রাহকরা সুস্পষ্ট প্রতারণা হিসেবে দেখছেন। তাদের মতে, যারা মিথ্যা প্রচারণা চালাতে পারে তারা গ্রাহকদের সঙ্গে যে কোন ধরনের প্রতারণা করতে পারে।

বাংলাদেশ সময়: ১৩২০ ঘণ্টা, জুন ১৯, ২০১৫/ আপডেট: ১৩৫২ ঘণ্টা
আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।