ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

মার্কিন নীতিই কি আইএসের শক্তির উৎস?

রাজিউল হাসান, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৪৩ ঘণ্টা, জুন ২৮, ২০১৫
মার্কিন নীতিই কি আইএসের শক্তির উৎস? সংগৃহীত

ঢাকা: বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় আতঙ্কগুলোর একটি জঙ্গি আতঙ্ক। আর ইরাক ও সিরিয়াভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) নাম এই আতঙ্কে সবার আগে ও সবচেয়ে বেশিবার উচ্চারিত।

নৃশংসভাবে হত্যা, গণহত্যা, নারীদের যৌনদাসী করে রাখা, শিশু অপহরণ করে জঙ্গি হিসেবে প্রশিক্ষণ দেওয়া, বিশ্বব্যাপী অনেক তরুণকেই আকর্ষণ করা এই সংগঠন এখন আর মামুলি আঞ্চলিক কোনো জঙ্গি সংগঠন নয়। খেলাফত প্রতিষ্ঠার নামে সন্ত্রাস করা ‌আইএস এখন সাধারণ মানুষ, বিশ্বের সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলো ও তাদের সরকারগুলোর জন্য বড় হুমকি।

কিন্তু জনমনে প্রশ্ন, ২০০১ সালের আতঙ্ক তালেবানকে পেছনে ফেলে কিভাবে উঠে এলো আইএস? কোন প্রেক্ষাপটে কিভাবে সংগঠনটির জন্ম? বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস ছড়িয়ে দেওয়া সংগঠনটির পেছনে কি কোনো শক্তি কাজ করছে? পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো ও তাদের মিত্র রাষ্ট্রগুলোর শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে উপেক্ষা করে কিভাবেইবা সংগঠনটির জঙ্গিরা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখে সন্ত্রাস ছড়িয়ে দিচ্ছে?

আইএসের সব কার্যক্রম বাদ দিলেও নির্মমভাবে শিরশ্ছেদের খবরগুলো, চলতি বছর মার্চে তিউনিসিয়ায় জাতীয় জাদুঘরে হামলা, ২২ মে ও ২৯ মে সৌদি আরবে জুমার নামাজ চলাকালে দু’টি শিয়া মসজিদে আত্মঘাতী হামলা, ২৬ জুন কুয়েতে জুমার নামাজ চলাকালে একটি শিয়া মসজিদে হামলা, তিউনিসিয়ার পর্যটন নগরী সউসেতে বন্দুকধারীর হামলার ঘটনাগুলো আইএসের ব্যাপারে প্রশ্নগুলো আরও জোরালো করেছে। আর এসব প্রশ্নে বারবার সামনে এসে পড়ছে মার্কিন নীতির প্রসঙ্গ। অনেক বিশ্লেষকই মনে করেন, মার্কিন নীতির কারণেই আইএস এতোটা ভয়ংকর ও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পেরেছে।

খুব সংক্ষেপে যদি বলতে হয়, ইসলামিক স্টেটের জন্ম ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘জামায়াত আল-তাওহিদ ওয়াল-জিহাদ’ নামক জঙ্গি সংগঠন থেকে। সর্বশেষ ‘জামায়াত আল-তাওহিদ ওয়াল-জিহাদ’-এর সঙ্গে আরও কয়েকটি জঙ্গি সংগঠন একত্রিত হয়ে ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে গড়ে তোলে ‘মুজাহেদিন সুরা কাউন্সিল’। একই বছর অক্টোবরে আবু বকর আল-বাগদাদির নেতৃত্বে সুরা কাউন্সিলের পক্ষ থেকে খেলাফত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নতুন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর নাম দেয় ‘ইসলামিক স্টেট অব ইরাক (আইএসআই)’। ২০১১ সালের মার্চে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হলে আইএসআই সেখানে নিজেদের কর্মী পাঠায়। এই কর্মীরা ‘জাবহাত আন-নুসরাহ লি-আহলি আশ-শাম’ বা নুসরা ফ্রন্ট নামে একটি সংগঠন তৈরি করে কাজ চালাতে থাকে সেখানে। ২০১৩ সালে নুসরা ফ্রন্টকে আইএসআই’র সঙ্গে একীভূত করে বাগদাদি সংগঠনটির নাম দেন ‘ইসলামিক স্টেট অব ইরাক এন্ড দ্য লেভেন্ট (আইএসআইএল)’ বা ‘ইসলামিক স্টেট অব ইরাক এন্ড সিরিয়া (আইএসআইএস)’।

বর্তমানে ইরাক ও সিরিয়ার বেশিরভাগ অঞ্চলই জঙ্গি সংগঠনটির দখলে চলে গেছে। এক হিসাবে জানা যায়, আইএসের দখল করা এলাকাগুলোয় এক কোটিরও বেশি মানুষের বাস। কিন্তু এক বছর আগেও আইএসের এই পরাক্রমশীলতা ছিল কল্পনার অতীত। গত বছর ২৯ জুন ইরাকের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলীয় এলাকাগুলো দখলের পর যখন আইএস বিশ্বব্যাপী খেলাফত প্রতিষ্ঠার কথা পুনর্ব্যক্ত করে, তখনও ধারণা করা যায়নি, সংগঠনটি কি অশনি সংকেত দিচ্ছে বিশ্বকে। পুরো এক বছর ইরাক ও সিরিয়ায় তাণ্ডব চালিয়ে ও বাকি বিশ্বে কিছু বিচ্ছিন্ন কিন্তু নির্মম ঘটনা ঘটিয়ে এখন আইএস একটা দানব রূপে মানবতার সামনে উপস্থিত। চলতি বছর ১৭ মে ইরাকের আনবার প্রদেশের রামাদি দখল ও এর চারদিন পর সিরিয়ার পালমিরা দখলের খবর যখন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে, তখন আবার নড়েচড়ে বসে বিশ্ব। এছাড়া সাম্প্রতিক খবর, গত ২৫ জুন তুরস্কের সীমান্তবর্তী সিরিয়ার কোবানে শহরে ঢুকে পড়েছে সংগঠনটির জঙ্গিরা। সেখানে ঢুকে যথারীতি চালাচ্ছে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। এর আগে ২০১৪ সালেই সংগঠনটির হাতে পতন হয় মসুলের।

বিষয়টা এখন দাঁড়িয়ে গেছে, প্রলংকরী ঝড় আসার খবর মানুষ জানছে ঠিকই, কিন্তু এর থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় আপাতত খুঁজে পাচ্ছে না। তাই নিরব দর্শকের ভূমিকায় সবাই। পশ্চিমা বিশ্বসহ সারা বিশ্বেই সংগঠনটির বিপক্ষে সরকারগুলো সোচ্চার। পেন্টাগনের দাবি, মার্কিন নেতৃত্বে যৌথবাহিনী এ পর্যন্ত ৪ হাজার বিমান হামলা পরিচালনা করেছে। এসব হামলায় অন্তত ১০ হাজার আইএস যোদ্ধা নিহত হয়েছে। তবু যেন কিছুতেই এর বিজয়রথ থামানো যাচ্ছে না। প্রশ্ন জাগে, কেন?

সরকারি হিসাবে, ইরাকে নিরাপত্তা রক্ষা ও আইএস মোকাবেলায় শুধুমাত্র ইরাকি সেনাবাহিনীর রয়েছে ২০ হাজার সেনা। এর বাইরে সহায়তা দানকারী মার্কিন সেনাবাহিনীর সদস্য ও কুর্দি যোদ্ধারা তো রয়েছেই। তবে ইরাকি সেনা সংখ্যা ২০ হাজার মানতে নারাজ কিছু বিশ্লেষক। তাদের মতে আসল সংখ্যাটা এর চেয়ে অনেক কম। সেনাবাহিনীর তালিকায় ২০ হাজার সেনার নাম থাকলেও বাস্তবে তাদের অনেকেই অনুপস্থিত। বিশ্লেষকদের অভিযোগ, এভাবে ভুয়া সেনা দেখিয়ে তাদের বেতন-ভাতা সেনাবাহিনীর ও সরকারের কর্মকর্তারা হাতিয়ে নিচ্ছেন।

৬ লাখ অধিবাসির রামাদিতে প্রকাশ্য দিবালোকে আইএস হামলা আগে থেকেই অনুমান করা যাচ্ছিল। মসুলের মতো অতর্কিত হামলা হয়নি সেখানে। তারপরও শেষ রক্ষা করা যায়নি। কারণ খুঁজতে গিয়ে বিশ্লেষকরা আবারও ইরাকি সেনাবাহিনীর ত্রুটি খুঁজে পাচ্ছেন। ২০১৪ সালে চরম পরাজয়ের পর এই সেনাবাহিনীকে আর সংস্কার করা হয়নি। আইএস মোকাবেলায় এর রয়েছে মাত্র পাঁচটি ব্রিগেড। কেউ কেউ বলেন, ব্রিগেডের সংখ্যা এর চেয়ে কম হওয়াও অস্বাবাভিক কিছু না। এর অর্থ ১০ থেকে ১২ হাজার সেনা আইএস মোকাবেলায় নিয়োজিত। এ কথার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন ইরাকি সেনাবাহিনীরই এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

রামাদি লড়াইয়ের সময় এর দক্ষিণাঞ্চলের পুলিশ কমান্ডার ছিলেন কর্নেল হামিদ শানদোখ। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, তিনদিনের যুদ্ধে আমাদের ৭৬ জন নিহত ও ১৮০ জন আহত হলো। আইএস কমান্ডাররা বিদেশি জঙ্গিদের শরীরে বোমা বেঁধে গাড়িতে চড়িয়ে সরকারি স্থাপনাগুলোয় পাঠিয়ে দিল। তারা নিষ্ঠার সঙ্গে নিজেদের উড়িয়ে দিল। তাদের সঙ্গে উড়ে গেল আমাদের মানুষগুলোও। একটা শহরের প্রতিরোধ ভেঙ্গে দিতে আত্মঘাতী হামলার চেয়ে বড় অস্ত্র আর কিছু হতে পারে না।

কর্নেল শানদোখের কথাতেই উঠে আসে সমস্যা আসলে কোথায়। তার মতে, এই ক্ষয়ক্ষতি, পরাজয়ে মাঠে থাকা সেনাদের দায় যতটুকু, তার চেয়ে বেশি দায় কেন্দ্রের। আনবার সুন্নি অধ্যুষিত এলাকা। আইএসও সুন্নি খেলাফত প্রতিষ্ঠার নামেই সামনে বাড়ছে। তাই কেন্দ্র মনে করল, আনবারের সুন্নি পুলিশদের হাতে ভারী অস্ত্র দেওয়া যাবে না। ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে পুলিশ সদস্যদের গোণা হলেও কার্যত তারা কিছুই করতে পারলো না।

ইরাকি সেনাবাহিনীর দুবর্লতার বিষয়টি বারবার সংবাদমাধ্যম ও পশ্চিমা নেতাদের আলোচনায় উঠে এসেছে। চলতি বছর জানুয়ারিতে লন্ডনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি, ইরাকি প্রধানমন্ত্রী হায়দার আল-আবাদি এক বৈঠকে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফিলিপ হ্যামন্ডের সঙ্গে একমত হন, ইরাকি সেনাবাহিনী এখনও আইএস মোকাবেলায় প্রস্তুত নয়।

এরপরও ইরাকি সেনাবাহিনীকে কারিগরি সহায়তা ও প্রশিক্ষণ দিতে সেখানে তিন হাজার একশ’ মার্কিন অবস্থান করছে। গত ১০ জুন আরও সাড়ে চারশ’ সেনা বিশেষজ্ঞা পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবাম। এসব সত্ত্বেও বিশ্লেষকরা বলছেন, মসুল পতন থেকে শুরু করে সাবেক ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের জন্মশহর তিকরিত হয়ে রামাদি পতন পর্যন্ত ঘটনাগুলোর পর্যায়ক্রমিক বিশ্লেষণ করলে মনে হচ্ছিল, আইএস মোকাবেলায় পশ্চিমা সরকারগুলো, বিশেষ করে মার্কিন সরকারের কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু রামাদি পতনের পর বর্তমান সময় পর্যন্ত ঘটনা প্রবাহ বিশ্লেষণ করলে তেমন কোনো পরিকল্পনাই পরিলক্ষিত হয় না। এর একটাই অর্থ, হয় প্রাথমিক পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ায় পশ্চিমারা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে, নতুবা তাদের সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনাই ছিল না কোনো সময়।

এখানে অবশ্য সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ একটা ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে থাকতে পারেন বলে মনে করছেন কয়েকজন বিশেষজ্ঞ। তাদের ধারণা, পশ্চিমা চক্ষুশূল বাশারকে দূর্বল করতেই সিরিয়ায় আইএসের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো পদক্ষেপে যাচ্ছে না যুক্তরাষ্ট্র।

একদিকে, বাশারের প্রতি ক্ষিপ্ত থাকায় সিরিয়ায় আইএসের তাণ্ডবের ব্যাপারে পশ্চিমা নিরবতা, অপরদিকে ইরাকে সেনাবাহিনীর উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও লোকবলের অভাব আইএসকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে শক্তিশালী হতে সহায়তা করেছে। তারওপর বিশ্বব্যাপী তরুণ সম্প্রদায়ের অনেকের ঝুঁকে পড়া ও নিজেদের প্রচারণায় প্রযুক্তির ব্যবহার আইএসকে দিন দিন আরও ভয়ংকর ক্ষমতাধর করে তুলছে বলেই বিশ্লেষকদের মত।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৮ ঘণ্টা, জুন ২৭, ২০১৫
আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।