ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

বাবার পথেই হাঁটতে চান জুনিয়র ট্রুডো

রাজিউল হাসান, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৮, ২০১৫
বাবার পথেই হাঁটতে চান জুনিয়র ট্রুডো ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: টুইটারে দু্ই সন্তানসহ নিজের ছবি যখন তিনি পোস্ট করলেন, মানুষ যেন হুমড়ি খেয়ে পড়লো। ‘ব্যাক টু দ্য ফিউচার’ চলচ্চিত্রে যারা বিশ্বাস রাখেন, সেই তরুণ প্রজন্ম যেমন এই হুমড়ি খাওয়াদের দলে রয়েছেন, একইভাবে রয়েছেন বয়স্করাও।

এ যেন ১৯৬৮ সালের কানাডা নতুনরূপে ফিরে এসেছে।

চলতি মাসের ১৯ তারিখ অনুষ্ঠিত হয় কানাডার ৪২তম জাতীয় নির্বাচন। দেশটির ৩৭৮ সদস্যের সংসদে ৫৪ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৮৪টি আসনই জয় করে নেয় জাস্টিন ট্রুডোর লিবারেল পার্টি। আর এর মাধ্যমে অবসান ঘটে রক্ষণশীলদের প্রায় এক দশককালের শাসনের। কনজারভেটিভ পার্টির স্টিফেন হার্পার এবার চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর পদের জন্য দৌড় শুরু করেছিলেন। কিন্তু তার দলকে নির্বাচনে ৯৯ আসনে জয় নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। অপরদিকে টমাস মালকেয়ারের ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি) ৪৪ আসনে জয় পেয়েছে।

এবারের নির্বাচনের জন্য চলতি বছরের ৪ আগস্ট আদেশ জারি করেন গভর্নর জেনারেল ডেভিড জনস্টন। এরই ধারায় প্রচারণার সময় পেয়েছিলেন সবাই ৭৮ দিন। আর এই প্রচারণার শুরুতেই কানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে এলিয়ট ট্রুডোর মতো তার পুত্র জাস্টিন ট্রুডোও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তরুণ প্রজন্মই এবার তার ঝাণ্ডাধারী। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হওয়ার পর দেখা গেছে, তিনি সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর প্রথম প্রজন্মখ্যাত ৬০ ও ৭০’র দশকের নাগরিকদের। এরা ‘জেনারেশন-এক্স’ নামেই বহুল পরিচিত। এছাড়া ‘জেনারেশন-ওয়াই’, যারা ৮০ ও ৯০’র দশকে জন্মেছেন, তারাও কম যাননি ট্রুডোকে সমর্থনের ক্ষেত্রে। আর ২০০০ সাল বা এর পর জন্ম নেওয়া সহস্রাব্দের সন্তানরা, যারা কি না এবারই প্রথম ভোট দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন, তাদের মধ্যে তো জাস্টিন ট্রুডো স্টাইলিশ এক নেতার নাম।

নির্বাচনী প্রচারণার সময় বা জয়লাভের পর জাস্টিন ট্রুডোর যে জনপ্রিয়তা চাক্ষুষ করছেন কানাডাবাসী, তা অনেক প্রবীণের চোখেই যেন ১৯৬৮ সালের প্রত্যাবর্তন। সে বছর যখন সিনিয়র ট্রুডো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন, তখনও তরুণদের মধ্যে উচ্ছ্বাস দেখা গিয়েছিল। তাদেরকে নিয়েই পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। ২০১৫ সালে এসে বাবার মতো জুনিয়র ট্রুডোও তরুণদের নিয়ে পরিবর্তনের পথে হাঁটতে চাইছেন, রাজনীতি থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে নতুন মুখের আগমন যেন এখন সময়ের ব্যাপার।

দীর্ঘদিনের লিবারেল নেতা জন ডাফি। তিনি নিজ দলের অঘোষিত ইতিহাসবিদ ও ‘ফাইটস অব আওয়ার লাইভস’ বা ‘আমাদের জীবনযুদ্ধ’ গ্রন্থের রচয়িতা। জন ডাফি ও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এনডিপি) সাবেক কর্মী ও ওটোয়ার জনসংযোগ ফার্ম মিডিয়াস্টাইলের একজন অংশীদার ইয়ান ক্যাপস্টিক নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেছেন জুনিয়র ট্রুডোকে। তাদের মতে, পিতা-পুত্র সবচেয়ে বেশি সমর্থন পেয়েছেন তরুণ প্রজন্মের কাছ থেকে, আর তাই তাদের নিয়েই পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখাটাও স্বাভাবিক। তবে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে না পারলে আজকের নায়ক জাস্টিন, কালই এই প্রজন্মের কাছে খলনায়কে পরিণত হবেন। আর এই প্রতিশ্রুতি রক্ষার পথটাও ততোটা সরল নয়।

প্রচারণা
পিয়েরে এলিয়ট ট্রুডোর মতো নির্বাচনী প্রচারণার সময় থেকেই তরুণ প্রজন্মকে টার্গেট করেন জাস্টিন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্যাম্পসগুলোয় তিনি বিশেষ মনযোগ দেন। এর ফলাফলও হাতেনাতে পান তিনি।

জন ডাফির মতে, ট্রুডো ওই শ্রেনিরই। তরুণ ভোটারদের লক্ষ্য করেই তিনি প্রচারণা চালিয়েছেন। প্রচারণার প্রথম দিন থেকেই আমি দেখেছি, স্বচ্ছ কানাডার পথে তিনি হাঁটার চেষ্টা করছেন, যা আমার কাছে তারুণ্যের জয়গান বলে মনে হয়েছে। এবং আমি জানতাম, তার এ প্রচেষ্টা এবার প্রথম যারা ভোট দিচ্ছেন, তাদের আকৃষ্ট করবেই।
তবে তার মতে প্রচারণার অনেক আগে থেকেই ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা করছেন ট্রুডো। এ জন্য তিনি যেমন স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোয় ছুটেছেন, একইভাবে ব্যবহার করেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে।

এদিকে, ইয়ান ক্যাপস্টিকের মতে, জাস্টিন ট্রুডো কানাডার রাজনীতিতে নতুন এক যুগের প্রতিনিধি। আর কোনো নেতা এই প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন না।

তিনি বলেন, আমার ধারণা, তরুণ প্রজন্ম ট্রুডোকে পরখ করতে চাইছেন এবং তার কাছে নতুন কানাডার স্বপ্ন বাস্তবায়নের আশা করছেন। তবে ট্রুডো যদি তার প্রতিশ্রুতি রাখতে না পারেন, তাহলে এই আশা হতাশায় রূপান্তরিত হবে।

কেতাদুরস্ত ট্রুডো
শুধু নীতি দিয়েই জাস্টিন ট্রুডো ভোটারদের আকর্ষণ করেছেন, বিষয়টি মানতে নারাজ কানাডার অনেক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞই। বাবার মতো তার কেতাদুরস্ত উপস্থাপনাও আকর্ষণের অন্যতম কারণ বলে মনে করেন প্যাট্রিক গোসেজ।

৭০’র দশকে তিনি সিনিয়র ট্রুডোর সঙ্গে কাজ করেছেন এবং টরন্টো জনসংযোগ ফার্ম মিডিয়া প্রোফাইলের দীর্ঘদিনের অংশীদার।

তিনি বলেন, পিয়েরে যেমন ৭০’র দশকে নিজের চমকপ্রদ উপস্থাপনায় ভোটারদের মন জুগিয়েছেন, জাস্টিনও একই পথে হাঁটছেন। আমার ধারণা, তার সুদর্শন চেহারা ও চমকপ্রদ উপস্থাপনা বেশি মাত্রায় মানুষকে আকর্ষণ করেছে। পিয়েরে ট্রুডো ষাট বছর বয়সের কাছে দাঁড়িয়েও সাংবাদিকদের সঙ্গে ফ্রিজবি খেলেছেন বলে জানান তিনি।

তবে ডাফি এ কথা মানতে নারাজ। তার মতে, সিনিয়র ও জুনিয়র ট্রুডোর মতো নেতাদের ক্ষেত্রে তারুণ্য খুব বড় কোনো ফ্যাক্টর নয়। তাদের রাজনৈতিক পদক্ষেপই মানুষকে আকর্ষন করেছে বেশি। তাছাড়া জনগণের মধ্যে পরিবর্তন দেখতে চাওয়ার প্রবণতাও একটা বড় ব্যাপার।

ডাফি বলেন, আপনার যদি সিনিয়র ও জুনিয়র ট্রুডোর মতো নতুন আগমন ঘটে, তাহলে বাস্তবিকই আপনাকে আধুনিক হতে হবে। কেউ যদি দীর্ঘ সময় নিজেকে আধুনিক বলে দাবি করতে থাকে, তার চেয়ে এই নতুন মুখদের আহ্বান বেশি শ্রুতিমধুর বলে মনে হয়।

এনডিপি নেতা টম মালকেয়ার নিজেকে এমন ‍অবস্থানে নিয়ে গিয়েছিলেন বলে মত ডাফির। তিনি বলেন, তিনি নিজেকে আধুনিক বলে দাবি করলেও তার উপস্থাপনায় মানুষ এর প্রতিফলন পেতো খুবই কম।
প্রতিশ্রুতি
বাবার মতোই জাস্টিন ট্রুডোও তরুণ প্রজন্মকে আকর্ষণ করতে স্বেচ্ছামৃত্যু, এলজিবিটি (লেসবিয়ান, গ্যে, বাইসেক্সুয়াল ও ট্রান্সজেন্ডার), মারিজুয়ানা ও পরিবেশ ইস্যু নিয়ে কাজ করার অঙ্গিকার ব্যক্ত করেছেন।

জন ডাফি ও ইয়ান ক্যাপস্টিক, দু’জনের মতেই, এবারের নির্বাচনে তরুণরা হুমড়ি খেয়ে পড়েছে জাস্টিনকে নেতা হিসেবে দেখতে। এই ভালোবাসা ধরে রাখতে হলে ট্রুডোকে অবশ্যই দু’টো প্রতিশ্রুতি রাখতে হবে।

ক্যাপস্টিক বলেন, প্রথমত তাকে ভোট ব্যবস্থার পরিবর্তন আনতে হবে। কারণ প্রচলিত ব্যবস্থায় তরুণরা বিরক্ত। আর দ্বিতীয়টি হলো, মারিজুয়ানার বৈধতা। যদি মারিজুয়ানার বৈধতা দিতে ও তা নিয়মিত করের আওতায় আনতে তিনি ব্যর্থ হন, তাহলে তরুণ প্রজন্মের কাছে পুরোপুরি ব্যর্থ নেতায় পরিণত হবেন তিনি।

মারিজুয়ানা ও সমকামিতা ইস্যুতে পিয়েরে ট্রুডোর প্রাথমিক সিদ্ধান্তগুলোকে সমর্থন করেন ক্যাপস্টিক। সমকামিতায় পিয়েরের করা মন্তব্য এখন বিখ্যাত উক্তিতে পরিণত হয়েছে, ‘জাতির শয়নকক্ষে রাষ্ট্রের কোনো স্থান নেই’। এই ইস্যুগুলো ছাড়াও গর্ভনিরোধ ইস্যুও তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বেশ সাড়া ফেলেছিল তার সময়।

ক্যাপস্টিক আরও কয়েকটি ইস্যুর কথা বলেন, যেগুলোও তরুণদের মধ্যে প্রভাব রাখে। এগুলো হলো- সামাজিক স্বচ্ছতা, কারণ চাকরির বাজারে এর ভূমিকা রয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেতন ও সামাজিক বিচার ব্যবস্থা।

বয়স্কদের ভুললে চলবে না
তবে শুধু তরুণ প্রজন্মের কথা চিন্তা করাও ট্রুডো বা তার নীতিনির্ধারকদের জন্য বড় একটি ভুল হবে বলে মনে করেন জন ডাফি। তার মতে, প্রচারণার শেষদিকে অধিকাংশ নির্বাচনী এলাকাতেই লিবারেলরা এগিয়ে ছিল। এর পেছনে শুধু তরুণদের সমর্থনই যথেষ্ট ছিল না, বয়স্করাও ভূমিকা রেখেছেন। পুরো দেশই আসলে পরিবর্তন চাইছিল।
ডাফি বলেন, ১৯৬৮ সালে পিয়েরে ট্রুডোর ক্ষেত্রে কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিল ক্লিনটনের ক্ষেত্রেও এ ঘটনা দেখা গেছে। সিনিয়র ট্রুডোর জয়ে তরুণরা যেমন ভূমিকা রেখেছিলেন, একইভাবে বয়স্ক ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের ভোটাররাও কম ভূমিকা রাখেননি। বিশেষ করে, কুইবেকের ভোটাররা তাকে আকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিলেন।

চ্যালেঞ্জ
জাস্টিন ট্রুডোকে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মোকাবেলাও করতে হবে বলে মনে করছেন অনেকে। বিশেষ করে, বেকার সমস্য দূরীকরণে তাকে কণ্টকময় পথই পাড়ি দিতে হবে বলে মত প্যাট্রিক গোসেজের।

এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, তরুণ প্রজন্ম বেকার সমস্যা সমাধানে ট্রুডোর পদক্ষেপগুলো পর্যবেক্ষণ করবে। তবে সমস্যাটা হলো, এক্ষেত্রে কেন্দ্র সরকারের তেমন কিছুই করার নেই। বিষয়টা ট্রুডোর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

মারিজুয়ানা বৈধতা দেওয়াও বেশ কঠিন হবে ট্রুডোর জন্য। প্যাট্রিক বলেন, নতুন সরকারের প্রথম বছরেই এটা সম্ভব করতে পারবেন না তিনি। এদিকে তরুণ প্রজন্ম বিষয়টি নীবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে।

পথচলা
১৯ অক্টোবরের নির্বাচনে জয়ের আনন্দে এখনও হাওয়ায় ভাসছেন জাস্টিন ট্রুডো। দেশের ভার আনুষ্ঠানিকভাবে তার কাঁধে এখনও চাপেনি। সবকিছু ঠিক থাকলে ৪ নভেম্বর তিনি শপথ নেবেন। আর এরপরই আসলে জাস্টিন ট্রুডো আসলে কতোটা পিয়েরে ট্রুডো হয়ে উঠতে পারেন, তা বোঝা যাবে বলে মনে করছেন কানাডার বিশেষজ্ঞ মহল।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৮, ২০১৫
আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।