১০ বছর পর সেদিনের ভয়াবহ ভূমিকম্পের বর্ণনা দিতে গিয়ে লি জানালেন, সেদিনের কথা মনে করলে এখনও ভয়ে কেঁপে উঠি। প্রথমে আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি।
২০০৮ সালের এই দিনে ৭.৯ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে চীনের সিচুয়ান প্রদেশের ওয়েনচুয়ান অঞ্চল। দুর্যোগে প্রাণ হারায় প্রায় ৯০ হাজার মানুষ। ঘরবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয় প্রায় ৫০ লাখ মানুষ।
খোঁজ পাওয়া যায়নি আরও ১৮ হাজারের। ১৯৫০ সালের চায়ু ভূমিকম্পের পর এটিই দেশটির সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প।
লিয়ের বাড়ি ছিলো দুজিয়াংইয়ানে শহরে। শহরটি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল থেকে খুব কাছে ছিলো। ভূমিকম্পের মাত্রা এতটাই তীব্র ছিলো যে কিছু জায়গায় প্রায় ৩০ ফুট পর্যন্ত ভূমি উপরে উঠে এসেছিলো। উৎপত্তিস্থল থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে রাজধানী বেইজিংয়ও সেদিন কেঁপে ওঠে।
লি বলছিলেন, মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আমরা পৃথিবীটা পুরো পাল্টে যায়। প্রায় ১০ ঘণ্টা ধ্বংসস্তূপে আটকে থাকার পর আমাকে উদ্ধার করা হয়। তবে আমি আমার দুই পা হারিয়ে ফেলি। বছরের পর বছর ধরে সেদিনের সেই দুঃসহ স্মৃতি আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে।
এখন কৃত্রিম পা’র সাহায্যে হাঁটাচলা করেন লি। লিয়ের মতো অনেকেই সেদিনের ক্ষতচিহ্ন আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন।
লি জানান, দুই পা হারানোর পর স্বামী তাকে ডিভোর্স দেন। এ ঘটনার পর তিনি ভেবেছিলেন এখানেই বুঝি তার জীবন থেমে গেলো।
কিন্তু সেসময় তার পরিবার ও চীনা স্বেচ্ছাসেবকরা তাকে নতুন করে জীবন শুরু করতে সাহস জোগায়। এখন তিনি পর্যটকদের গায়ক হিসেবে কাজ করেন। চীনা সরকারের কাছ থেকে ভাতাও পান।
আর এভাবেই আমি জীবনের মোড় ঘুরিয়েছি, নতুন করে বাঁচতে শিখেছি-যোগ করেন লি।
ভূমিকম্পের সময় অনেক স্কুলে ক্লাস চলছিলো। ভূমিকম্পে কমপক্ষে ৫ হাজার শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। অধিকাংশই মারা যায় স্কুলের ভবন ধসে। ইউনিসেফের তথ্যমতে, সেদিনের ভূমিকম্পে সিচুয়ান প্রদেশের প্রায় ১২ হাজার স্কুলভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বেইজিং অলিম্পিকের মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে ভয়াবহ ভূমিকম্পটি হয়। এজন্য চীন সরকারকে বিশ্বব্যাপী প্রচণ্ড চাপের মুখে পড়তে হয়।
চীনা সরকার প্রতি বছর এই দিনে দুর্যোগ মোকাবিলার ওপর গুরুত্ব দিয়ে আলোচনার আয়োজন করে। এদিন দুর্যোগ মোকাবিলায় স্বেচ্ছাসেবকদের কাজের প্রশংসা করা হয়। ওয়েনচুয়ান শহর সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়। প্রতি বছর ১২ মে এই শহরে ‘থ্যাংকস গিভিং ডে’ পালন করা হয়।
ভূমিকম্পে যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাদের স্মৃতিরক্ষায় দেশটির তোংজি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগ একটি জাদুঘর ও স্মারক নির্মাণ করে। স্মারক জাদুঘর নির্মাণে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে সরকার।
স্থপতি কাই ইয়ংজির নকশায় স্মারক জাদুঘরটি সবুজ প্রাঙ্গণে লাল ইস্পাতে নির্মিত। দুর্যোগ পরবর্তী দালান কাঠামোকে থিম ধরে নকশা করা হয়েছে জাদুঘরটির।
বিরাট ভূগর্ভস্থ আনুভূমিক দালানগুলোর ছাদে কচি ঘাসের কার্পেট ছড়ানো। ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট ফাটলের মতো অবিকলভাবে নির্মিত ভূগর্ভস্থ চির ধরেই নামতে হয় অন্দরমহলে। দালানের কৌণিক দেয়ালগুলো তৈরি হয়েছে ওয়েদারিং স্টিল দিয়ে। আলোক ব্যবস্থাপনায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ভূমিকম্প পরবর্তী নিস্তব্ধতা।
২০১৩ সালের মে মাসে দুর্যোগের পাঁচ বছর পূর্তিতে জাদুঘরটি খুলে দেওয়া হয়। যা সাক্ষ্য দিচ্ছে সমসাময়িক চীনের ইতিহাসের স্থবির কালো অধ্যায়ের।
বাংলাদেশ সময়: ১১৩৯ ঘণ্টা, মে ১১, ২০১৮
আরআর