এই শ্রেণিভেদই মানুষের জীবনকে স্বাভাবিক গতিতে পরিচালিত করছে। সবাই উচ্চশিক্ষিত হয়ে অফিসের বস হয়ে গেলে যেমন ক্লার্ক আর দারোয়ান খুঁজে পাওয়া যেত না, তেমনি সবাই শিক্ষাবঞ্চিত থাকলেও শিক্ষাকেন্দ্রিক কাজগুলো করা সম্ভব হতো না।
এই বাস্তবতা সবখানে, সর্বক্ষেত্রে। পবিত্র কোরআনের ঘোষণা কী স্বচ্ছ! পড়ুন- পার্থিব জীবনে তাদের জীবিকা আমিই বণ্টন করে দিয়েছি এবং আমিই তাদের একজনকে অপরজনের ওপর মর্যাদায় উন্নত করেছি, যাতে তাদের একে অন্যের দ্বারা কাজ নিতে পারে। -সূরা যুখরুফ: ৩২
এই যে একে অন্যের দ্বারা কাজ নেওয়া, একে অন্যের সেবা গ্রহণ করা; স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্যে তা অপরিহার্য। সমাজে যত রকমের পেশা আছে, প্রতিটি পেশায় নিয়োজিত প্রতিটি মানুষই সমাজের অন্য মানুষদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এই সেবার ধরন একেক জায়গায় একেক রকম, সেবার ক্ষেত্রও একেক পেশায় একেক রকম। প্রয়োজনের তাগিদে, জীবন টিকিয়ে রাখার মহৎ লক্ষ্যে একজন সম্ভ্রান্ত শিক্ষিত বিত্তবান ব্যক্তি যেমন কর্মস্থলের দিকে বের হয়, তা ব্যবসা-চাকরি বা অন্য কিছু যাই হোক।
একইভাবে একজন নিম্নবিত্ত শ্রেণির অশিক্ষিত মানুষও একই উদ্দেশে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। দু’জনের উদ্দেশ্যের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার শিক্ষক অধ্যাপক ব্যাংকার ম্যানেজার ব্যবসায়ী শিল্পপতি থেকে শুরু করে কৃষক দিনমজুর কুলি শ্রমিক এমনকি মেথর পর্যন্ত সকলের একই লক্ষ্য। এই লক্ষ্য পূরণে একেকজনের পেশা একেকরকম। জীবিকার টানে সকলে পেশায় নেমে এসেছে ঠিক, কিন্তু এ পেশাজীবীরা তাদের পেশার মধ্য দিয়ে একে অন্যের এবং সমাজের অন্য মানুষের সেবা করে যাচ্ছে অবিরাম।
একজন রিক্সাওয়ালা যে আমাদের সেবায় নিয়োজিত তা বুঝে আসে তখনই, যখন কোথাও চলাচলের একমাত্র বাহন রিক্সার সংকট দেখা দেয়। প্রাপ্য নির্ধারিত ভাড়া পরিশোধ করেই আমরা গাড়িতে চড়ি। কিন্তু প্রয়োজনের মুহূর্তে যদি গাড়ির সংকট দেখা দেয় তখন ঠিকই বুঝে আসে- আমাদের কাছ থেকে বিনিময় নিলেও এটা তাদের সেবা। জীবনে চলতে গেলে কত কিছুই তো লাগে। দৈনন্দিন জীবনের যত প্রয়োজন, নিজে নিজে তো এর সামান্যও পূরণ করা কঠিন। একজন নরসুন্দর, যে আমাদের চুলগুলোকে কেটে-ছেটে সুন্দর করে দেয়, এ পেশায় যদি সে না আসত, যদি কেউ না আসত, তাহলে আমাদের কী অবস্থা হতো! একজন মেথর যে সেবাটুকু দেয়, তা কি আমরা অস্বীকার করতে পারি? তার এ সেবা না হলে তো আমাদের সামাজিক ও সভ্য জীবনই অচল হয়ে পড়বে!
মোদ্দা কথা হলো, প্রতিটি পেশাজীবী মানুষই সমাজের সেবা করে। আমরা সকলেই এ সেবায় নিয়োজিত, আবার সেবাগ্রহীতাও। আমরা সাধারণত কয়েকটি পেশাকে মানবসেবা মনে করি। যেমন, শিক্ষকতা, সাংবাদিকতা, ডাক্তারি, হাসপাতালের নার্সিং ইত্যাদি।
আসলে সেবা এসবে সীমাবদ্ধ নয়। বরং প্রতিটি পেশাই সেবা। যিনি ব্যবসায়ী তিনি মানুষকে সঠিক মানের পণ্য সরবরাহ করবেন। যিনি শিক্ষক তিনি ছাত্রদের সঠিক শিক্ষা প্রদান করবেন। যিনি চাকুরিজীবী, তিনি তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথ পালন করবেন। যিনি ডাক্তার, তিনি তার মেধার সবটুকু বিলিয়ে দিয়ে রোগীর চিকিৎসা করবেন। সাংবাদিক নির্ভয়ে সত্যটা সমাজের সামনে তুলে ধরবেন। যিনি রিক্সাচালক তিনি তার যাত্রীদের যথাসম্ভব আরামের দিক চিন্তা করবেন। এসবই সেবা। তবে এ সেবা যেহেতু পেশাও, এসবের যেহেতু বিনিময়ও গ্রহণ করা হয়, তাই অন্য আরও অনেক সেবার মতো এ সেবা ঐচ্ছিক নয়।
কোনো বৃদ্ধের হাতে একটি বড় ব্যাগ দেখে আপনি এগিয়ে গিয়ে সহযোগিতা করতে পারেন। আপনার সুযোগ ও সামর্থ্য থাকলে তা আপনার নৈতিক দায়িত্ব। যদি না করেন, তাহলে আপনি হয়তো আপনার বিবেকের কাছে অপরাধী হবেন, কিন্তু আইনের মুখে পড়বেন না। কিন্তু আপনি যখন কোনো পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করবেন, তখন সে সেবাটুকু সম্পাদন করা আপনার অবধারিত দায়িত্ব। সেখানে না করার কোনো সুযোগ আপনার নেই।
আমরা যেখানে কাজ করি, সেখানে আমাদের সেবা নিতে যেমন অন্যরা আসে, তেমনি অন্যরা যেখানে সেবা দেয় আমরাও সেখানে যাই। সমাজজীবনের এক অপরিহার্য অংশ যেহেতু এই সেবা, এর পাশাপাশি তা আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্বও। তাই তাতে উদাসীন থাকার সুযোগ নেই।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে তো হাদিস শরিফের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। যেমন, একজন ব্যবসায়ীকে হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে পথনির্দেশ করেছেন, ‘সত্যবাদী বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন নবী-সিদ্দিক (সত্যবাদী) ও শহীদদের সঙ্গে থাকবেন। ’ -জামে তিরমিজি: ১২০৯
অর্থাৎ আপনি যদি ব্যবসার সেবাকে নিজের জন্যে বেছে নেন তাহলে আপনাকে সততা ও বিশ্বস্ততার পরিচয় দিতে হবে। পণ্যের দোষ গোপন করা যাবে না, মিথ্যা কথা বলা যাবে না, প্রতারণা করা যাবে না।
কোথাও রয়েছে ব্যাপক নির্দেশনা। যেমন, হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যার বিশ্বস্ততা ও আমানতদারি নেই তার ঈমানই নেই, আর যে অঙ্গীকার পূর্ণ করে না তার কোনো দ্বীন নেই। ’- মুসনাদে আহমদ: ১২৩৮৩
এ হাদিসের শিক্ষা তো আমাদের সব পেশাকেই অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। কেউ যখন কোনো চাকুরিতে প্রবেশ করে তখন নির্ধারিত দায়িত্ব কাঁধে নিয়েই প্রবেশ করে। সে দায়িত্ব সূচারুরূপে আঞ্জাম দেওয়া তার অঙ্গীকার। কিন্তু যদি তাতে সে অবহেলা করে তাহলে সে অঙ্গীকার ভঙ্গ করল।
বাবা যখন ছেলেকে নিয়ে কোনো স্কুলে যায় তখন তার ছেলেকে ওই প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ যথার্থ ও উপযোগী শিক্ষা দেবে- এমন একটি মৌন অঙ্গীকারের ভিত্তিতেই সেখানে ভর্তি করা হয়। ছাত্রদেরকে যথানিয়মে পাঠদানের অঙ্গীকার করেই কেউ শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। কিন্তু যদি ছেলেকে কথামতো সময়োপযোগী ও যথার্থ শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা না হয়, কমপক্ষে এ জন্যে চেষ্টাও করা না হয়, তাহলে এতে অঙ্গীকার ভঙ্গ হয়।
আপনি যদি কোনো তথ্য অনুসন্ধানকেন্দ্রে কাজ করেন, তাহলে আপনাকে নানান মানুষের নানান প্রশ্নে বিরক্ত হতে হবেই। তবে এ বিরক্তি প্রকাশ না করতে আপনি অঙ্গীকারাবদ্ধ। যাবতীয় ক্লান্তি ও বিরক্তি উপেক্ষা করে আপনাকে সবার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলে যেতে হবে। এটাই আপনার অঙ্গীকার।
তাই আসুন, আমরা নিজেদের পেশাকে সেবা হিসেবে বিবেচনা করি। সততা বিশ্বস্ততা ও আমানতদারির অঙ্গীকারে নিজেরা শক্ত পায়ে দাঁড়াই। এতে নিজের দায়বদ্ধতা বাড়বে। সমাজ উপকৃত হবে। উপকৃত হবো আমরা সবাই।
ইসলাম বিভাগে লেখা পাঠাতে মেইল করুন: bn24.islam@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১৭১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৩, ২০১৭
এমএইউ/