ট্রাম্প স্পষ্টভাবে ঘোষণা দেন, এখন সময় এসেছে জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার। তার এ ঘোষণায় সারা বিশ্বের মুসলমানদের হৃদয়ে অপরিমেয় আঘাত লাগে এবং সঙ্গে সঙ্গে তীব্র ক্ষোভ এবং বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
ট্রাম্পের একতরফা সিদ্ধান্ত ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে বিশ্ববাসী। এ সিদ্ধান্ত শান্তি উদ্যোগের ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখবে না। তার এ ঘোষণা ‘ সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও দায়িত্বজ্ঞানহীন। ’ যুক্তরাষ্ট্রের এমন পদক্ষেপে শান্তি প্রক্রিয়ার প্রচেষ্টা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, পুরো অঞ্চলে ‘আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত’ হবে; এ অঞ্চলকে অন্ধকার যুগের দিকে ধাবিত করবে। এক কথায়, বিশ্ব ট্রাম্পের এ ঘোষণাকে সর্বাত্মকভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।
এদিকে বিশ্বের তৃতীয় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে বাংলাদেশও ট্রাম্পের এমন সিদ্ধান্তকে ‘গ্রহণযোগ্য’ নয় বলে অভিহিত করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে ট্রাম্পের এ ঘোষণা গ্রহণযোগ্য নয় এবং জাতিসংঘের রেজুলেশনকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। অন্যতম শীর্ষ মুসলিম দেশের সরকার প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার দ্রুত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত ধন্যবাদযোগ্য এবং বাংলাদেশের এ প্রতিক্রিয়া বিশ্বে মর্যাদা পাবে।
আমরা জানি, জেরুজালেম নিয়ে দশকের পর দশক ধরে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনে মাঝে বিরোধ চলছে। এ নিয়ে ব্যাপক সংঘাত-সংঘর্ষ ও রক্তপাতের ঘটনা ঘটেছে। ফলে কোনো পক্ষকেই স্বীকৃতি না দেওয়ার মার্কিন নীতি বহু বছর ধরেই চলে আসছে। ট্রাম্পই প্রথম প্রেসিডেন্ট যিনি এ নীতির বরখেলাপ এবং বিশ্বজনমতের তোয়াক্কা না করে জেরুজালেমকে এমন স্বীকৃতি দিলেন।
এ যাবৎ বিশ্বের কোনো দেশই জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। বরং শান্তি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের তাগাদা দিয়েছেন। ট্রাম্পের এক ঘোষণায় তা ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এমনকি ট্রাম্পের এ ঘোষণা নিয়ে খোদ মার্কিন প্রশাসনেই বিভক্তি রয়েছে।
উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের যে প্রস্তাবের ভিত্তিতে ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন ভেঙ্গে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল, অন্যদিকে আরব ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত হয় এবং জেরুজালেমের জন্য স্বতন্ত্র আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রাখা হয়। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর ইসরাইল পূর্ব ও পশ্চিম জেরুজালেম দখল করে নেয় এবং এককভাবে তা নিজ দেশে অন্তর্ভুক্তির ঘোষণা দেয়। এ ঘোষণা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কখনও মেনে নেয়নি। ১৯৯৫ সালে ইসরাইল ও পিএলও স্বাক্ষরিত অসলো শান্তিচুক্তিতে উভয় পক্ষ মেনে নেয়, আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে জেরুজালেমের বিষয়টি নিষ্পত্তি হবে। আমেরিকার মধ্যস্থতায় ২০০০ সালে হোয়াইট হাউসের লনে ইসরাইলি নেতা রবিন ও ফিলিস্তিনি নেতা আরাফাত যে শান্তি কাঠামো স্বাক্ষর করেন, তাতেও জেরুজালেম বিষয়ে উভয় পক্ষের সম্মতি ছিল।
ঐতিহাসিক এসব চুক্তি ও সিদ্ধান্ত এক নিমিষে উড়িয়ে দিয়ে ট্রাম্প একতরফাভাবে জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতির ঘোষণা দেন। এতে দশকের পর দশক ধরে চলে আসা শান্তি প্রক্রিয়া থেমে যায়, সারা বিশ্বে ক্ষোভ-বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষ উদ্ভুত পরিস্থিতির জন্য নেতৃস্থানীয় মুসলিম দেশগুলোকে দায়ী করছেন। বিশেষভাবে অভিযোগের তীর উঠানো হচ্ছে- সৌদি আরবের দিকে। এ ছাড়াও চলছে অভিযোগ পাল্টা অভিযোগের ঘটনা। এ সব ঘটনায় মুসলিম বিশ্বের মধ্যে যে ভেদাভেদ রয়েছে সেটাই প্রকাশ পাচ্ছে।
এটা ঐতিহাসিক তিক্ত সত্য যে, মুসলিম বিশ্বের মধ্যে ভেদাভেদ রয়েছে, সেই ভেদাভেদ সাধারণ নয় বরং তীব্র। মুসলিমরা মিশেমিশে থাকতে পারেন না- এটা উদাহরণ হয়ে গেছে। কিন্তু এ অবস্থা আর কতকাল?
মুসলমানদের এমন আত্মঘাতী বিভেদের সুযোগে একের পর এক মুসলিম দেশকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করা হচ্ছে, শরণার্থীদের মিছিলে মুসলিমদের পাল্লা ভারী হচ্ছে, এর পরও যদি হুঁশ না হয়- তাহলে কী করার আছে? বলি, এই বিভেদের কালোরেখা যদি এখনও মুছে ফেলা সম্ভব না হয়- তাহলে মুসলিমদের অস্তিত্ব যে বিলীন হয়ে যাবে সেটা আর নুতন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। সুতরাং মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
মুসলমানদের মধ্যে যে মতবিরোধ রয়েছে, তা ভুলে যেতে হবে। ছোটখাটো মতবিরোধ ভুলে সবাইকে এক অবস্থানে আসতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ইস্পাত কঠিন ঐক্য সৃষ্টি করতে হবে। বস্তুত মুসলিম বিশ্বে ঐক্য বর্তমান যুগের সবচেয়ে জরুরি দাবি। মুসলমানরা যাতে ঐক্যবদ্ধ থাকতে না পারেন সে জন্য ইসলামের শত্রুরা তৎপর। কিন্তু তাদের ফাঁদে পা দিলে চলবে না।
মুসলমানদের মধ্যকার নেতৃত্বের বিরোধ, চিন্তাগত নানা বিভেদ, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, পদের প্রত্যাশা, সম্পদের লালসা, স্বার্থবাদীদের ইন্ধন ভুলে মুসলমানদেরকে ফিরে যেতে হবে কোরআনের এ বাণীর দিকে। যেখানে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জুকে শক্ত করে ধরো ও পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। ’ –সূরা আলে ইমরান: ১০৩
নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মুসলমানদেরকে সব সময় ঐক্যবদ্ধ থাকতে বলেছেন। কোরআনে কারিমের বহু জায়গায় এক্য বজায় রাখার কথা বলা হয়েছে। তার পরও মুসলমানদের দ্বন্দ্ব কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
নবী করিম (সা.)-এর রেখে যাওয়া প্রকৃত শিক্ষা অনুযায়ী ঐক্যবদ্ধ থাকা মুসলমানদের জন্য ফরজ। নবী-রাসূলরা সবাই এসেছেন মানব জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে বিচ্ছিন্ন করতে নয়।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, অনৈক্য মুসলমানদের অধঃপতনের অন্যতম বড় কারণ। মুসলমানরা যদি আজও ইসলাম ও কোরআনের আসল শিক্ষার পথে ফিরে গিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রচেষ্টা চালায় তাহলে তারা সব অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা থেকে মুক্ত হয়ে আবারও সব দিকে কর্তৃত্বশালী হতে পারবে এবং গোটা মানবতাই পাবে প্রত্যাশিত সার্বিক মুক্তি ও অপার কল্যাণ।
এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে, মুসলমানরা এক আল্লাহ, শেষ নবী (সা.), অভিন্ন জীবন বিধান কোরআন ও ইসলামের মূলনীতিগুলো মেনে নেওয়া সত্ত্বেও সাম্রাজ্যবাদীদের নানা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে পরস্পরের মধ্যে সীসা ঢালা প্রাচীরের মতো ঐক্য গড়ে তুলতে পারছে না। অথচ মুসলমানদের বিরুদ্ধে খ্রিস্টান, ইহুদি ও অন্য অমুসলিমদের সুদৃঢ় ঐক্য লক্ষণীয়।
মুসলমানরা ইচ্ছা করলে নানা মত ও রুচির অধিকারী হয়েও অভিন্ন স্বার্থগুলোর ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারে। আমরা দেখি, বিভিন্ন দেশে নানা মত ও আদর্শের বহু দল থাকা সত্ত্বেও তারা নিজ দেশের স্বাধীনতা আর স্বার্থের ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ থাকেন। তেমনি মুসলমানরা অভিন্ন স্বার্থের ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারেন। কিন্তু মুসলমানরা অভিন্ন স্বার্থগুলোর ক্ষেত্রে কেন ঐক্যবদ্ধ হতে পারবেন না- তা বোধগম্য নয়! ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রেরণা মুসলমানদের মাঝে এখনও জাগ্রত না হলে ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করছে মুসলমানদের জন্য তা আল্লাহতায়ালাই ভালো জানেন!!
ইসলাম বিভাগে লেখা পাঠাতে মেইল করুন: bn24.islam@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১৯২১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১১, ২০১৭
এমএইউ/