ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

এক কিশোর যোদ্ধার গল্প

ইমরুল ইউসুফ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১৮ ঘণ্টা, মার্চ ১৫, ২০১৩
এক কিশোর যোদ্ধার গল্প

‘লন ভাই আপনের চা। এক্কেবারে একশ একশ গরম চা।

এতো গরম চা আর কোথাও পাইবেন না। ’ কথাগুলো বলেই চুলার দিকে দৌড় দেয় আলীম। চুলার জ্বালটা একটু ঠেলে দেয়। বেশি জ্বাল পেয়ে দুধ উথলে ওঠে। এমন সময় বেজে ওঠে হোটেলের কলিং বেল। ক্যাশ বাকসের পাশে বসে বেল বাজায় হোটেলের মালিক ফকির আলী। বেলের শব্দ শুনে দৌড় দেয় আলীম।

ফকির আলীর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ‘কী চাচা’। আলীম বলে, ‘কাস্টমার আইচে। ভালো কইরা চারটা পরটা আর চারটা ডিম ভাজতে বল’। ফকির আলীর এই কথা শুনে আলীম মাথা নাড়ে। ঘাড় ঘুরিয়ে ডান দিকে তাকায়। গোলগোল চেহারায় দুজন পাক আর্মি বসে আছে। ইয়া লম্বা। বড় বড় চোখ। পাকানো গোঁফ। গায়ে খাকি রঙের পোশাক। মাথায় হেলমেট। পায়ে বুট জুতা। কাঁধে রাইফেল। আলীম আর দাঁড়ায় না। তাদের জন্য নাস্তা আনতে যায়।

সোনাডাঙ্গা এলাকায় ফকিরের হোটেলের নাস্তাই সেরা। এজন্য এই হোটেলে সব সময় ভিড় লেগে থাকে। এখন ভিড়টা আরও বেড়ে গেছে। কারণ তার দোকানের রেডিওতে সবাই মুক্তিযুদ্ধের খবর শুনতে এসেছে। ইদানিং বসন্তপুর আর্মি ক্যাম্প থেকে পাক সেনারাও এই হোটেলে নাস্তা খেতে আসে। দল বেঁধে পাক সেনাদের আসতে দেখে ভয় পায় ফকির আলী। হোটেলে বসে থাকা লোকজন তাদের দেখে ভয়ে বেরিয়ে যায়। হোসেন আলী একটু নড়েচড়ে বসে। রেডিওটা বন্ধ করে টেবিলের নীচে রাখে। হোটেলে ঢুকে পাকসেনারা নাস্তা খায়। টেবিল ভরে নাস্তা দেয় আলীম। পাক সেনার গপাগপ খেতে থাকে। চা নাস্তা খেয়ে সেনারা খুব খুশি হয়। আলীমকে ডেকে বকশিস দেয়। একজন সেনা বলে, এ আলীম তুম হামারা সাথ ক্যাম্প মে যায়ে গা? হামারা সাথ থাকে গা? এই কথা শুনে আলীম কিছু বলে না। মালিক ফকির আলীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

নাহ! এদেশে আর থাকা যাবে না। রাজাকার আর পাক সেনারা মিলে যা শুরু করেছে তাতে এ দেশ ছাড়তে হবে। আলীমের বাবার এ কথা শুনে ফকির আলী বলল, আমরা দেশ ছাড়তে যাব কোন দুঃখে। আমরাই ওদের দেশ ছাড়া করব। বাংলার মাটি ছাড়া করব। সারাদেশের মানুষ তাইতো ওদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। আমরাও ওদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো।

যুদ্ধ কথাটি শুনে আলীমেরও যুদ্ধ করতে ইচ্ছে করে। পাক সেনাদের ঘাড়ে ঝুলানো রাইফেল ছুঁয়ে দেখতে মন চায়। যেতে ইচ্ছে করে সেনা ক্যাম্পে। আলীম তার এই ইচ্ছের কথা বাবা, বড় ভাই ও ফকির চাচাকে জানায়। ক্যাম্পে কাজ করার কথা শুনেই ফকির আলীর মাথায় অন্য বুদ্ধি চলে আসে। আলীমকে যুদ্ধের কাজে লাগানোর কথা ভাবে। এমন সময় তার সেই পাক সেনার কথা মনে পড়ে যায়। ‘এ আলীম তুম হামারা সাথ ক্যাম্পে মে যায়ে গা? হামারা সাথ থাকে গা?’ সবার সিদ্ধান্ত মতো আলীম পাক সেনাদের ক্যাম্পে কাজ করতে শুরু করে। সেনাদের ফরমাশ খাটতে থাকে। ভিতরে ভিতরে সে হয়ে উঠতে থাকে একজন মুক্তিযোদ্ধা।

কাঁকশিয়ালী নদীর ওপারের সব গ্রামে যুদ্ধ চলছে। তারালি, খানপুর, কুশলে গ্রামের সবাই জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করছে। কোথাও কোথাও মুক্তিযোদ্ধারা জিতছে। তবে বেশিরভাগ জায়গায় জিতছে মুক্তিযোদ্ধারা। গত রাতের বিজয়টা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সবচেয়ে বড় বিজয়। ওই রাতে যোদ্ধারা কৌশলে তারালি পাকসেনা ক্যাম্পে ঢুকে পড়ে। তারপর গুলি চালিয়ে, বোমা মেরে সেনা ক্যাম্প গুঁড়িয়ে দেয়। ক্যাম্পে থাকা ২১ পাক সেনাকে হত্যা করে তারা। এরপর লুট করে তাদের সব অস্ত্রশস্ত্র।

এই খবর শুনে নদীর এপারের সেনা ক্যাম্পের সদস্যরা ভয় পেয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এ হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে আলীমকে তারা কাজে লাগায়। মুক্তিযোদ্ধাদের খবর আনার জন্য নদীর ওপারে যেতে বলে। যাওয়ার সময় বলে দেয় মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটির স্থান জেনে আসতে।

দুজন পাক সেনা নৌকায় করে আলীমকে কাঁকশিয়ালী নদী পার করে দেয়। এই নদীর ঠিক পাড়ের গ্রামটির নাম হাটখোলা। হাটখোলা গ্রাম রেখে খানপুর। তারপর কুশলের বড় মাঠটি পেরিয়ে তারালি গ্রাম। গত রাতে গুঁড়িয়ে দেওয়া তারালি সেনা ক্যাম্প আলীমের খুব দেখতে ইচ্ছে করে। ভাবে ওখানে গেলে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর জানা যাবে। তাদের সঙ্গে কথা বলা যাবে।

আলীম ঘুরতে ঘুরতে তারালি গ্রামে পৌঁছায়। গ্রামের মানুষের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর জানতে চায়। কিন্তু কেউ মুখ খুলতে চায় না। সে খুব ভাবনায় পড়ে গেল। হাঁটতে হাঁটতে একটি দোকানে গিয়ে বসল। দেখল সবাই মনযোগ দিয়ে রেডিওতে খবর শুনছে। আলীম বুঝে ফেলল এখান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর জানা যাবে। খবর শেষ হওয়ার পর আলীম একজনকে কাছে ডাকল। বলল, আমি নদীর ওপার থেকে এসেছি। আমি সোনাডাঙ্গা সেনা ক্যাম্পে কাজ করি। ভাববেন না আমি পাকসেনাদের লোক। আসলে আমি মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষের লোক। কিছু খবর জানতে আমি এখানে এসেছি।

কী খবর কী খবর? দোকানে বসা দুজন একসঙ্গে বলে উঠল। ওপারের পাকসেনারা দু’একদিনের মধ্যেই এপারের গ্রামগুলোতে ঢুকবে। আমাকে তারা এখানে পাঠিয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটির খবর নেওয়ার জন্য। আমি আপনাদের খবর নিয়ে তাদের জানাব। তবে এই ফাঁকে আপনারা এই ঘাঁটি ছেড়ে নিরাপদ স্থানে চলে যান।

এই কথা বলে আলীম চলে যেতে চায়। কিন্তু দোকানে বসা একলোক তাকে যেতে দেয় না। লোকটির নাম মজনু। আলীম জেনেছে সে একজন মুক্তিযোদ্ধা। গত পরশু রাতে আর্মি ক্যাম্পে অপারেশন চালানোর সময় সেও মুক্তিযোদ্ধা দলের সঙ্গে ছিল। আলীমকে সে তাদের দলনেতা শফি ভাইয়ের কাছে নিয়ে গেল। শফি ভাইয়েরা সঙ্গে যুদ্ধ বিষয়ে আলীমের অনেক কথা হলো। কথা শেষে শফি ভাই তার দলের সবাইকে কাছে ডাকল। বলল, আমাদের হাতে সময় খুব কম। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। আমাদের এখন যথেষ্ট অস্ত্রশস্ত্র আছে। আমরা চাইলে খুব শিগগিরই আরেকটি অপারেশন চালাতে পারি।

আমাদের পরবর্তী অপারেশন হবে সোনাডাঙ্গা সেনা ক্যাম্প দখল করা। যাতে ওরা আমাদের আক্রমণ করার সুযোগ না পায়। শফি ভাইয়ের কথায় সবাই সায় দেয়। পরবর্তী অপারেশনের জন্য মনে মনে প্রস্তুতি নেয়। শফি ভাই আলীমকে কাছে ডেকে বলে, আমরা আজ সোনাডাঙা ক্যাম্প আক্রমণ করতে চাই। তুমি কীভাবে আমাদের সহযোগিতা করতে পারবে? গালে হাত দিয়ে আলীম কিছুক্ষণ ভাবে। তারপর বলে, আপনারা সব কিছু নিয়ে নিয়ে রাত ঠিক ১২টার পর নৌকা ঘাটে আসবেন। সুযোগ বুঝে আমি পরপর তিনবার টর্চ লাইট জ্বালাব ও নেভাব। এই সংকেত পেলে আপনারা নদী পার হবেন। আর যদি টর্চ জ্বালিয়ে একটানা কিছু সময় রাখি তাহলে বুঝবেন বিপদ আছে। নদী পার হওয়া যাবে না। আর দিনের আলোয় নদী পার হতে চাইলে ক্যাম্পের পতাকার দিকে লক্ষ্য করবেন। পতাকা একহাত নামানো দেখেলে বুঝবেন এখনই নদী পার পওয়ার সুসময়। এই কথা বলে আলীম উঠে সোনাডাঙা ক্যাম্পের দিকে রওয়ানা দেয়।

ক্যাম্পে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে আলীমকে ঘিরে ধরে পাকসেনারা। কী খবর নিয়ে এসেছে তা জানতে চায়। আলীম তাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটির স্থান বলে দেয়। ওই ঘাঁটিতে কতোজন মুক্তিযোদ্ধা আছে তাও বলে। আলীমের কথা শুনে পাকসেনারা ঠিক করলো খুব শিগগিরই তারা অতি কৌশলে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করবে। তারালি ক্যাম্পে সেনা হত্যার প্রতিশোধ নেবে। এজন্য তারা আগামীকালই আক্রমণের জন্য রাত জেগে নকশা করে ফেলল। সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ এক জায়গায় করল। কাজ শেষে অনেক রাতে ঘুমাতে গেল সেনারা। আলীম অবশ্য সন্ধ্যার পরপরই তার ঘরে ঘুমাতে গেছে। সবাই জানে প্রতিদিনের মতো আলীম আজও ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু সে ঘুমায় না। চোখ বন্ধ করে বিছানায় পড়ে থাকে।

সেনাদের ঘুমানোর অপেক্ষায় থাকে। যখন সে বুঝল সবাই শুয়ে পড়েছে তখন সে উঠল। টর্চ লাইটটা হাতে নিয়ে দরজার পাশে গেল। খুব আস্তে দরজা খুলল। তারপর পাহারাদারদের চোখ ফাঁকি দিয়ে পা টিপে টিপে গেল নদীর ধারে। পরপর তিনবার টর্চের আলো জ্বালালো ও নেভালো।

সংকেত পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ নিয়ে উঠল নৌকায়। দেখতে দেখতে তারা নদীর এপারে চলে এলো।

নৌকা দুটি ভেড়ালো ক্যাম্প থেকে একটু দূরে। তারপর নৌকা থেকে গোলাবারুদ ওপরে ওঠায়। আলো আঁধারিতে তাদের যেন চিনতে না পারে সেজন্য সবাই গায়ে মুখে মাথায় কাদা মেখে নেয়। পরিকল্পনা মতো যোদ্ধারা সবাই ক্যাম্প ঘিরে ফেলে। আলীম শফি ভাইয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। ক্যাম্পের কোন রুমে কমান্ডার থাকে, কোন রুমে গোলা-বারুদ, অস্ত্রশস্ত্র থাকে তা বলে দেয়। আলীমের কথা মতো তারা যে যার পজিশন নিয়ে ক্যাম্প ঘিরে ফেলে।

প্রস্তুত হয় আক্রমণ করার জন্য। শফি ভাই ‘অ্যাকশন’ বলতেই মুক্তিযোদ্ধারা একযোগে গোলাগুলি শুরু করে।

গুলি ও বোমার শব্দে নিস্তদ্ধ, অন্ধকার গ্রাম মুহূর্তেই জেগে ওঠে। আলোকিত হয়ে ওঠে বসন্তপুর গ্রাম। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেনা ক্যাম্প গুঁড়িয়ে দেয় মুক্তিযোদ্ধারা। সেনা ক্যাম্প দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে।

যুদ্ধে জিতে মুক্তিযোদ্ধারা আনন্দ করতে করতে নৌকার কাছে যায়। অস্ত্রগুলো নৌকায় রেখে গায়ের কাদা ধোয়ার জন্য পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের দেখাদেখি আলীমও নদীতে ঝাঁপ দেয়। দাপাদাপির সময় পানির তোড়ে সে চলে যায় নৌকায় নিচে। জলস্রোতে ভেসে যেতে থাকে। আলীম চিৎকার করে বলতে থাকে ‘শফি ভাই বাঁচান। আমি ডুবে যাচ্ছি শফি ভাই’।

চিৎকার শুনে শফি ভাইদের দলের সবাই আলীমকে পানিতে খুঁজতে থাকে। কিন্তু অন্ধকারে আলীমকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।

বাংলাদেশ সময়: ১২৪০ ঘণ্টা, মার্চ ১৫, ২০১৩
এসএ-ichchhegguri@banglanews24.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।