ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধ

রাজীব কুমার সাহা | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫৮ ঘণ্টা, মার্চ ২৮, ২০১৩
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধ

মার্চ স্বাধীনতার মাস। এ মাসেই শুরু হয়েছিল আমাদের মহান মুক্তির সংগ্রাম।

বাঙালি জাতি তার সবকিছু নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো মুক্তিযুদ্ধে। বাংলাদেশের সামগ্রিক চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ প্রধানতম স্থান দখল করে রয়েছে। সে হিসেবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রেও মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব কম নয়।

অআজ তোমাদের পরিচয় করাবো বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের সঙ্গে।

৯ মাস যুদ্ধের পর ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি ৯৩ হাজার সৈন্যের আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করার মাধ্যমে আমরা একটি নতুন দেশ, নতুন পতাকা নিয়ে গড়ে তুলি আমাদের নিজস্ব শিল্প-সংস্কৃতি।

kids-sm১৯৫৬ সালে এ দেশের চলচ্চিত্রের যাত্রা শুরুর মাত্র ১৬ বছর পর স্বাধীনতাযুদ্ধ ও একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়ে যান বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাতারা।

চলচ্চিত্র নির্মাণে মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত মানুষের প্রতিরোধ, সংগ্রাম, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো একটি বিশাল বিষয়বস্তু একেবাররেই হাতের কাছে পেয়েছেন তারা।

দেশের মুক্তিসংগ্রাম, সফলতা, নির্যাতিত মানুষের বৃত্তান্ত সবকিছুই ক্রমে স্থান করে নেয় চলচ্চিত্রের মূল বিষয়বস্তুতে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ নিয়ে চলচ্চিত্র বড় পরিসরে খুব বেশি একটা হয়নি। তারপরেও আমাদের দেশের নির্মাতারা তাদের মেধা ও সামর্থ্যের মধ্যে বেশ কিছু চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। নির্মিত ছবিগুলো ছিল সরাসরি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক, মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী প্রেক্ষাপট বা যুদ্ধোত্তর সমাজ ও মুক্তিযুদ্ধের আংশিক ঘটনাবলি নিয়ে পূর্ণদৈঘ্য চলচ্চিত্র, প্রামাণ্যচিত্র ও তথ্যচিত্র।

১৯৭০ সালে মুক্তিযুদ্ধের আগে স্বাধীনতার গল্প নিয়ে নির্মিত হয়েছিল ফখরুল আলমের ‘জয় বাংলা’। কিন্তু পাকিস্তান সেন্সর বোর্ডের আপত্তির কারণে ছবিটি মুক্তি পায়নি।

অবশেষে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ছবিটি মুক্তি পায়। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হতে না হতেই মুক্তিযুদ্ধকে প্রথম পর্দায় নিয়ে আসেন বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম পুরোধা জহির রায়হান।

১৯৭১ সালেই তিনি নির্মাণ করেন মুক্তিযুদ্ধের ছবি ‘জীবন থেকে নেয়া’। এই ছবিতেই ‘আমার সোনার বাংলা, গানটি চিত্রায়িত হয়েছিল। পরবর্তীতে এটিই বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃতি পায়। তোমরা জেনে অবাক হবে, কেবল সত্তর দশকেই বড় পর্দায় মুক্তিযুদ্ধের ছবি এসেছে ১৩টি।

kids-smমুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রণাঙ্গণ থেকে রণাঙ্গণে ছুটে জহির রায়হান নির্মাণ করেন ‘স্টপ জেনোসাইড’ এবং আলমগীর কবির নির্মাণ করেন ‘লিবারেশন ফাইটার্স’। এছাড়া বাবুল চৌধুরী ‘ইনোসেন্ট মিলিয়ন’ নামে নির্মাণ করেন একটি তথ্যচিত্র।

এসব তথ্যচিত্রে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর নৃশংসতা, গণহত্যা, শরণার্থী মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব, মুজিবনগর সরকারের তৎপরতাসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত সৃষ্টিতে এসব তথ্যচিত্র বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধের অবিস্মরণীয় দিনলিপি নিয়ে কাজ করেন বেশ কয়েকজন নির্মাতা। মুক্তি পায় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি ‘ওরা ১১ জন’। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে মুক্তি পাওয়া এ ছবির কাহিনীতে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধার অদম্য সাহসিকতা ও দেশমাতৃকার জন্য প্রাণপণ লড়াইয়ের গল্প তুলে ধরা হয়।

১৯৭২ সালে আরো বেশ কয়েকটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। এর মধ্যে অন্যতম সুভাষ দত্তের ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’, আনন্দ পরিচালিত ‘বাঘা বাঙালি’, মমতাজ আলী পরিচালিত ‘রক্তাক্ত বাংলা’ সহ আরও বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র।

প্রয়াত চলচ্চিত্র পরিচালক আলমগীর কবীর ১৯৭৩ সালে নির্মাণ করেন ‘ধীরে বহে মেঘনা’। এতে কাহিনীর সঙ্গে মিল রেখে পরিচালক মুক্তিযুদ্ধের আসল ঘটনা প্রবাহ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তোলেন।

একই বছর আরো বেশ কিছু মানসম্পন্ন ছবি নির্মিত হয়েছে। তার মধ্যে খান আতাউর রহমানের ‘আবার তোরা মানুষ হ’, কবীর আনোয়ারের ‘স্লোগান’, আলমগীর কুমকুমের ‘আমার জন্মভূমি’ অন্যতম। তবে এসব ছবিতে মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ের ঘটনা প্রবাহ বেশি প্রাধান্য পেয়েছে।

kids-smমুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে ১৯৭৪ সালে নির্মিত হয় নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত ‘আলোর মিছিল। একই সঙ্গে ওই সময় মুক্তি পায় চাষী নজরুল ইসলামের ‘সংগ্রাম’ ও এস আলী পরিচালিত ‘বাংলার ২৪ বছর’।

১৯৭৪ পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের ছবি নির্মাণে ভাটা পড়ে। ১৯৭৬ সালে মুক্তি পায় হারুন অর রশীদের ‘মেঘের অনেক রং’। এ ছবিতে মুক্তিযুদ্ধের মানবিক দিকগুলো ফুটিয়ে তোলা হয়। ১৯৭৭ সালে মুক্তি পায় আব্দুস সামাদের ‘সূর্যগ্রহণ’ চলচ্চিত্রটি।

আশির দশকের শুরুতে কয়েক বছর বিরতির পর আবার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি নির্মাণ করেন শহিদুল হক খান। ছবির নাম  ‘কলমিলতা’। মুক্তি পায় ১৯৮১ সালে। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে আমাদের চলচ্চিত্রে অধঃপতন শুরু হয় যা অব্যাহত থাকে পুরো নব্বই দশক পর্যন্ত।
 
এ সময়ের মাঝে বিকল্প ধারা হিসেবে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র অনেকটা জনপ্রিয় হয়ে উঠে। স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবিতে মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রাধান্য ছিল বরাবরই। মোরশেদুল ইসলামের ‘আগামী’, তানভীর মোকাম্মেলের ‘হুলিয়া’ ও ‘নদীর নাম মধুমতি’, নাসির উদ্দিন ইউসুফের ‘একাত্তরের যীশু’, মোস্তফা কামালের ‘প্রত্যাবর্তন’, আবু সাইয়ীদের ‘ধূসর যাত্রা’ প্রভৃতি বিশেষভাবে আলোচিত চলচ্চিত্র।

এই সময়ে কয়েকটি শিশুতোষ ছবিও নির্মিত হয়। যার মধ্যে দেবাশীষ সরকারের ‘শোভনের একাত্তর’ রফিকুল বারী চৌধুরীর ‘বাংলা মায়ের দামাল ছেলে’, বাদল রহমানের ‘ছানা ও মুক্তিযুদ্ধ’, ছটকু আহমেদের ‘মুক্তিযুদ্ধ ও জীবন’, মান্নান হীরার ‘একাত্তরের রং পেন্সিল’ অন্যতম।

১৯৯৪ সালে বরেণ্য কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ ছবি নির্মাণে এগিয়ে আসেন। নিজের লেখা উপন্যাস অবলম্বনে তার পরিচালিত প্রথম মুক্তিযুদ্ধের ছবি ‘আগুনের পরশমণি’। ১৯৯৫ সালে তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক তথ্যচিত্র ‘মুক্তির গান’। নৌপথে পাকিস্তানী বাহিনীর আক্রমণের মুখে পড়ে দেশের পরিবারগুলো কী ব্যবস্থা নিয়েছিল তা নিয়েই নির্মিত এই তথ্যচিত্রটি।

আরেক জনপ্রিয় কথাশিল্পী সেলিনা হোসেনের লেখা উপন্যাস অবলম্বনে খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার চাষী নজরুল ইসলাম নির্মাণ করেন মুক্তিযুদ্ধের ছবি ‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’। মুক্তি পায় ১৯৯৭ সালে।

২০০৪ সালে বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনের উপন্যাস অবলম্বনে চাষী নজরুল ইসলাম নির্মাণ করেন ‘মেঘের পরে মেঘ’। একই বছর আরো দু’টি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি নির্মিত হয়। হুমায়ূন আহমেদ তার নিজের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মাণ করেন ‘শ্যামল ছায়া’ চলচ্চিত্রটি এবং বিশিষ্ট লেখক আমজাদ হোসেনের উপন্যাস বেলা-অবেলার গল্প অবলম্বনে অভিনেতা তৌকীর আহমেদ নির্মাণ করেন ‘জয়যাত্রা’ চলচ্চিত্রটি।

kids-smমাঝে কয়েক বছর বিরতির পর বিশিষ্ট নির্মাতা নাসির উদ্দিন ইউসুফ নির্মাণ করেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের উপন্যাস নিষিদ্ধ লোবান অবলম্বনে ‘গেরিলা’ চলচ্চিত্রটি। ছবিটি মুক্তি পায় ২০১১ সালে। কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘গেরিলা’ এশিয়ার শ্রেষ্ঠ ছবির পুরস্কার অর্জন করে।

আরেক জনপ্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালের উপন্যাস অবলম্বনে মোরশেদুল ইসলাম নির্মাণ করেন মুক্তিযুদ্ধের ছবি ‘আমার বন্ধু রাশেদ’। ২০১২ সালে মুক্তিযুদ্ধের ছবি নির্মিত হয়েছে খুবই কম। এর মধ্যে মাসুদ আকন্দের ‘পিতা’ উল্লেখযোগ্য।

আমাদের চলচ্চিত্র ইতিহাসে এখন পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে ২৫টির মতো। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র ও তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে ৩৪টি। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে ২৯টি এবং মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী ঘটনা ও আংশিক প্রসঙ্গ নিয়ে তৈরি হয়েছে ২৩টি চলচ্চিত্র। আর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিদেশে নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের সংখ্যা ২৫টির মতো।

এ ছাড়া বিবিসি, এনবিসি, ফরাসি, সিবিএসসহ বেশ কয়েকটি বিদেশি টেলিভিশন চ্যানেল মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র ও তথ্যচিত্র নির্মাণ করে।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের চেতনা, আমাদের সংস্কৃতি। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে হবে তরুণ প্রজন্মের মাঝে এমনটাই স্বাধীনতার মাসে প্রত্যাশা।

বাংলাদেম সময়: ১৬৪০ ঘণ্টা, মার্চ ২৮, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইচ্ছেঘুড়ি-ichchheghuri@banglanews24.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।