ঢাকা, বুধবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

আত্মঘাতী চিত্রশিল্পী ভ্যানগগ

ইমরুল ইউসুফ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৫৫ ঘণ্টা, মে ২৯, ২০১৩
আত্মঘাতী চিত্রশিল্পী ভ্যানগগ

ফিনিক্স পাখি আত্মঘাতী হয়ে জন্ম দেয় আরেক ফিনিক্স পাখির। কিন্তু মানুষ কি তা পারে? পারে না।

তারপরও মানুষ নিজে নিজেকেই হত্যা করে। অর্থাৎ আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যা মহাপাপ জেনেও সাধারণ মানুষের পাশাপাশি পৃথিবী বিখ্যাত অনেক কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, রাজনীতিবিদ, অভিনেতা আত্মহত্যা করেছেন। বিশ্ববিখ্যাত তেমনই একজন চিত্রশিল্পী ভ্যানগগ।
 
ভিনসেন্ট ভ্যানগগের জন্ম ১৮৫৩ সালের ৩০ মার্চ হল্যান্ডে। মৃত্যু ১৮৯০ সালের ২৯ জুলাই ফ্রান্সে।

বন্ধুরা, তোমরা জেনে অবাক হবে তিনি এই পৃথিবীর আলোয় বেঁচেছিলেন মাত্র ৩৭ বছর। আর এর মধ্যে শিল্পী জীবন মাত্র দশ বছরের- ১৮৮০ থেকে ১৮৯০। এই দশ বছরে তিনি এঁকেছিলেন নয়শটি তেলরং, জলরং আর ড্রয়িং মিলিয়ে সর্বমোট এগারোশটি ছবি।

গরিব মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণাই ভ্যানগগকে শিল্পী হতে উদ্ধুদ্ধ করেছিলো। দারিদ্র্যের অভিজ্ঞতা তাকে ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করলো। এজন্য তিনি ভর্তি হলেন এক পাদ্রী কলেজে। কিন্তু কিছুদিন পর ভালো লাগলো না। শেষে মিশনারি হয়ে বেলজিয়ামে খনির মজুরদের মধ্যে চলে গেলেন। সেখানে মজুরদের অবস্থা দেখে তার এত কষ্ট হলো যে, যা সামান্য টাকাপয়সা ছিলো সব বিলিয়ে দিয়ে নিজে উপোস করতে লাগলেন।

ঠিক এই সময় থেকে তিনি ছবি আঁকা আরম্ভ করলেন। হল্যান্ডে থাকতেই শিল্পী  ফ্রাঁসোয়া মিলের আঁকা গরিব চাষীর ছবি দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। মিলের সেই ছবি- চাষী মাঠে বীজ বুনছে বা গীর্জার ঘণ্টাধ্বনি শুনে মাঠে কর্মরত কৃষক দম্পতি প্রার্থনা করছে- ভ্যানগগ প্রথম দিকে ওসব ছবি দেখে দেখে ড্রয়িং করতেন।

পরবর্তীতে তিনি ড্রয়িংয়ে আশ্চর্য দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। এঁকেছিলেন দরিদ্র কৃষক, পুরুষ-নারী মাঠে কাজ করছে, নিরন্ন শ্রমিক, দিনমজুর, কয়লার বস্তা পিঠে নুয়ে পড়া নারী শ্রমিক, গীর্জায় প্রার্থনারত নারী, সূর্যমুখী, আইরিস ফুল ও ফুলের বাগান, ভিখারি মা সন্তান কোলে লঙ্গরখানা সামনে খাবারের আশায় দাঁড়িয়ে আছেন- এমন সব ছবি।
 
গগের আঁকা এসব ছবি দেখে তার ছোটো ভাই থিও খুব উৎসাহিত হলেন। থিওর কথা মতো তিনি চলে এলন প্যারিসে ছবি আঁকা শিখতে। সেখান থেকে দক্ষিণ ফ্রান্সের অঁর্ল নামে একটি ছোটো শহরে। এখানেই তার সাথে পরিচয় হয় আরেক বিখ্যাত শিল্পী পল গঁগ্যার সাথে। সেখানে দুই বন্ধু শিল্প সম্পর্কে আলোচনা এবং ছবি এঁকে চমৎকার দিন কাটাতে লাগলেন।

কিন্তু একসময় তাদের মধ্যে এমন বন্ধুর সম্পর্ক থাকলো না। হয়ে উঠলো শত্রুর। একদিন প্রায় বিনা কারণেই ভ্যানগগ একটা কাচের গ্লাস ছুড়ে মারলেন গ‍ঁগ্যার মাথায়। আর একদিন গঁগ্যা পথ দিয়ে হাঁটার সময় শুনতে পেলেন কে যেনো তার পিছনে ছুটে আসছে। পিছনে ফিরে দেখলেন একটা ধারলো ক্ষুর নিয়ে গগ ছুটে আসছে তাঁকে খুন করতে। প্রতিরোধের জন্য বিশালদেহী গগ্যা ফিরে দাঁড়াতেই আবার ছুটে পালিয়ে গেলেন তিনি। এসব আচরণে সবাই বুঝছিলেন যে গগ পাগল হয়ে যাচ্ছেন।

১৮৮৮ সালে এক দুঘটনার পর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো সাঁ রেমির উন্মাদ আশ্রমে। সেখানে কিছুটা ভালো হয়ে আরো কতকগুলো বিশ্ববিখ্যাত ছবি আঁকেন। তার আঁকা বিখ্যাত কয়েকটি ছবি হলো- আত্মপ্রকৃতি, কৃষি কাজ ফ্রিটিলারিয়াম: স্টিল লাইফ, ল্যাং লোয়া সেতু, আলুভোজী, সূর্যমুখী, পুষ্পিত পিচ গাছ, রাত্রির কাফে, হলুদ বাড়ি, খালি চেয়ার, আইরিস ফুল, প্রেমিক প্রভৃতি।

কিন্তু এসব ছবি আজ বিশ্ববিখ্যাত হলেও বেঁচে থাকতে কোনো সমাদর হয়নি এসব চিত্রকলার। তার সমসাময়িক বন্ধুদের মধ্যে রেনোয়া, মোনে, পিসারো, গ‍ঁগ্যা প্রমুখ শিল্পী যথেষ্ট প্রশংসা পেলেও গগ কারো কাছ থেকে কোনো প্রশংসা, কদর, সহানুভূতি পাননি।

এবার তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে মর্মান্তিক ও দুঃখজনক ঘটনাটির কথা বলবো। ঘটনা নয় বলা যায় দুর্ঘটনা। ১৮৯০ সালের ২৮ জুলাই শনিবারের এক পড়ন্ত বিকেল। ভ্যানগগ প্যারিসের উত্তর পশ্চিমে ওভেয়ার সুরওয়াস গ্রামের একটি গমের ক্ষেতে গেলেন। তারপর পকেট থেকে পিস্তল বের করে নিজের বুকে গুলি চালালেন। গুলিবিদ্ধ শরীর নিয়ে অনেক রাতে ফিরে এলেন তাঁর আস্তানায়। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে চিলেকোঠার ঘরে তার বিছানায় শুয়ে পড়লেন। পরের দিন খবর পেয়ে প্যারিস থেকে ছুটে এলেন প্রিয় ভাই থিও।

ডাক্তার গ্যাসে ইতোমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন, শরীর থেকে গুলি বের করা যাবে না। কথা বলতে বলতে ওই সময়ই তিনি ছোটো ভাই থিওর কোলে মাথা রেখে মারা গলেন। তার বয়স তখন মাত্র সাঁইত্রিশ বছর। তার ছবির কেউ গুণগ্রাহী ছিলো না, একমাত্র তার ভাই থিও ছাড়া। তিনিই গগের জন্য অভাবের মধ্যেও প্রতিমাসে দেড়শো, দুশো ফ্রাঁ পাঠাতেন। পাঠাতেন ছবি আঁকার সরঞ্জাম।

মৃত্যুর পরেও অন্তত দশ বছর ভ্যানগগের ছবির কোনো কদর হয়নি। গগের মৃত্যুর পর খ্যাতির সূচনা হয় ১৯১৪ সালে তার ছোটো ভাই থিওকে লেখা তার পত্রাবলী পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে।

আজ তার একটি চিত্রকর্মের মূল্য পঁচাশি মিলিয়ন ডলার কিংবা তারও বেশি। ডাচ সরকার দু’টি মিউজিয়াম তার ড্রয়িং দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে অতি যত্নে। একটি আমস্টারডমের ভিনসেন্ট ভ্যানগগ মিউজিয়াম, অপরটি এটারলুর ক্রয়েলার ম্যুলার মিউজিয়াম।

১৯৯০ সালে ডাচ সরকার মহাআড়ম্বরে পালন করেছিল শিল্পীর মৃত্যুশতবর্ষ। গুণী এই শিল্পীর মৃত্যু হয়েছে প্রায় ১২৩ বছর আগে। কিন্তু তার ছবির আবেদন আজো কমেনি।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৪০ ঘণ্টা, মে ২৯, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইচ্ছেঘুড়ি-ichchheghuri@banglanews24.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।