ঢাকা, বুধবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

ইতিহাস ঐতিহ্যে ঈদ

ইমরুল ইউসুফ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১১০ ঘণ্টা, আগস্ট ৭, ২০১৩
ইতিহাস ঐতিহ্যে ঈদ

আমাদের সবচেয়ে বড়ো ধর্মীয় উৎসব ঈদ। উৎসব মানেই তো আনন্দদায়ক ব্যপার।

আনন্দজনক অনুষ্ঠান। ঈদে অবশ্য তাই হয়। নানা ধরনের আনন্দ অনুষ্ঠান হয়। সেই অনুষ্ঠান দেখে কিংবা অংশ নিয়ে আমরা আনন্দিত হই। খুশি হই। এ আনন্দ বা খুশিতে কল্যাণ আছে। ব্যাপকতা আছে। কামনা বা বাসনা আছে। ঈদ তাই আমাদের আনন্দের সহযাত্রী। যাতে ছোটো বড়ো সবাই মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

বছরে দুবার ঈদ আসে। প্রথমে ঈদ-উল-ফিতর। পরে ঈদ-উল-আজহা। প্রথমটি দান করার উৎসব। দ্বিতীয়টি ত্যাগ করার উৎসব। এই দুটি উৎসব আমাদের মনে এতটাই প্রভাব বিস্তার করে যে আমরা ওই দিন সবকিছু ভুলে যাই। শত্রু-মিত্র, ধনি-দরিদ্রের ভেদাভেদ থাকে না। ঈদের খুশি সবার সঙ্গে ভাগ করে নেই। যে কারণে সব খানে সব ক্ষণে দুই ঈদই রূপ নেয় আনন্দ উৎসবে।

ধর্মীয় এই উৎসব পৃথিবীর প্রাচীনতম উৎসবগুলির সমবয়সী বলা যায়। অন্তত শ্রেণীগত দিক থেকে। এই শ্রেণীর উৎসবের প্রাচীন উদাহরণ ব্যাবিলনিয়ার আকিতু। সে সময় ব্যাবিলনের সকল প্রধান মন্দিরেই বার্ষিক ধর্মীয় উৎসব অনুষ্ঠানের প্রচলন ছিল। এসব অনুষ্ঠানে সৃষ্টিকাহিনী গানে গানে বর্ণনা করা হতো। বিশেষ করে সূর্যদেব মারদুকের মহিমাকীর্তনের জন্য আয়োজিত উৎসব আকিতুতে। এ উপলক্ষে ব্যাবিলনিয়ার মানুষ সব কিছু ভুলে আনন্দে মেতে উঠতো। খ্রিস্টপূর্ব অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি ব্যাবিলনিয়ার সম্রাট ইতিহাসখ্যাত আইনবিদ হামুরাবি এক সরকারি আদেশে মারদুককে প্রধান দেবতা বলে ঘোষণা করেন। এবং আকিতুকে দেওয়া হয় ব্যাবিলনের প্রধান বার্ষিক ধর্মীয় উৎসবের মর্যাদা। সেই হিসেব করেই ইতিহাসবিদরা বলেছেন ঈদ-উল-ফিতর হচ্ছে কনিষ্ঠতম ধর্মীয় উৎসব।

কারণ মহান পুণ্যময় এই দিবসটি উদযাপন শুরু হয়েছিল হিজরি ২য় সালে। অর্থাৎ প্রায় ১৪০০ বছর আগে। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মদিনায় হিজরতের পরেই ঈদুল ফিতর উৎসব পালন শুরু হয়। অর্থাৎ বদরের যুদ্ধে ‘চূড়ান্ত মীমাংসাকারী’ বিজয় সে বছরেই অর্জিত হয়েছিল। হয়তো এই বিজয়ের স্মৃতিকে আরো আনন্দময় করে তোলার জন্য হজরত মুহম্মদ (সা.) ওই বছর রমজান মাসের শেষে ঈদ উৎসব পালনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। হজরত আনাস (রা.) বর্ণিত একটি হাদিস থেকে জানা যায়, নবি করিম (সা.) মদিনায় এসে দেখলেন মদিনাবাসী বছরে দুটি দিবসে আনন্দ উল্লাস করে থাকে। মহানবি (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, এই দিবস দুটি কী? ওরা বলল, নওরোজ ও মিহিরজান। শরতের পূর্ণিমায় পালিত হয় নওরোজ উৎসব। আর বসন্তের পূর্ণিমায় পালিত হয় মিহিরজান উৎসব। জাহেলি যুগ থেকেই এই দুটি দিবসে আনন্দ উল্লাসের মধ্য দিয়েই পালিত হয়ে আসছিল। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, আল্লাহ তোমাদের উক্ত দিবস দুটির পরিবর্তে উত্তম দুটি দিবস দান করেছেন। তা হলো ঈদ-উল-আজহার দিন এবং ঈদ-উল-ফিতরের দিন।

কারণ রাসুলুল্লাহ (সা.) জানতেন নওরোজ ও মিহিরজান এই উৎসব দুটির রীতি-নীতি, আচার অনুষ্ঠান ছিল সম্পূর্ণরূপে ইসলামের আদর্শ পরিপন্থী। জরথুস্ত্র প্রবর্তিত নওরোজ ছিল নববর্ষের উৎসব। ছয় দিনব্যাপী এই উৎসবের মধ্যে মাত্র একদিন ছিল সাধারণ মানুষের জন্য নির্দিষ্ট। বাকি পাঁচ দিন ছিল সম্ভ্রান্ত বা ধনীশ্রেণীর মানুষের জন্য নির্ধারিত। এজন্য গরিব শ্রেণীর মানুষ পাঁচ দিন আনন্দ অনুষ্ঠান উপভোগ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতো। ঠিক সেভাবেই ছয় দিনব্যাপী মিহিরজান উৎসবেও শুধুমাত্র একদিন সাধারণ দরিদ্র মানুষেরা উপভোগ করতে পারত। সুতরাং শ্রেণী বৈষম্য, ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য এবং অশালীনতায় ভরা ছিল ওই উৎসব দুটি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে রাসুলুল্লাহর কথা মতো আরববাসীরা নওরোজ ও মিহিরজান উৎসব বাদ দিয়ে বছরে দুটি ঈদ উৎসব পালন শুরু করে। এর ফলে জন্ম নেয় শ্রেণী বৈষম্যহীন, সাম্য মৈত্রি ও অশালীনতামুক্ত আরব সমাজ।

ঈদ উৎসব পালনের আরো একটি ঐতিহাসিক পটভূমি রয়েছে। তা হলো- আরবের অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে নানারকম উৎসবের প্রচলিন ছিল। উকাজের মেলা ছিল এ ধরনের একটি বর্ণাঢ্য আয়োজন। এসব উৎসব প্রায়শই নানা অশ্লীল ও রুচিহীন আনুষ্ঠানিকতায় পূর্ণ থাকত। অন্য দিকে মুসলমানদের জন্য তখন পর্যন্ত কোনো উৎসবের প্রচলন হয়নি। তাদের নিষ্কলুষ বিনোদনের বিষয়টি রসুলুল্লাহ (সা.) গুরুত্বের সঙ্গে অনুধাবন করেন। এবং হিজরির ২য় সাল থেকেই রমজান শেষে ঈদ-উল-ফিতর উৎসব উদযাপনের সূচনা হয়। তারপর শুরু হয় ঈদ-উল-আজহা উদযাপন। এভাবেই শুরু হলো বছরে দুটি ঈদ উদযাপন। এর ফলে জন্ম নেয় শ্রেণী বৈষম্য বিবর্জিত সার্বজনীন আনন্দ উৎসবের।

আমাদের দেশে ঈদ উৎসবে গ্রামবাংলায় এমন কী শহরেও মেলা বসে। মেলায় লোকশিল্পজাত নানা পণ্যদ্রব্য বিক্রি হয়। বিক্রি হয় খাবার জিনিসপত্র। কোনো কোনো মেলায় নাগরদোলা, ছবির খেলা, পুতুল নাচ ইত্যাদি প্রদর্শিত হয়। নানা ধরনের খেলাধুলা হয়। মুর্শিদি, মারফতি প্রভৃতি আধ্যাত্ম সংগীতের আসর বসে। এসব কিছুই ঈদ উৎসবকে আরো আনন্দময় এবং প্রাণবন্ত করে তোলে। এ উৎসব পালনের জন্য সরকার তিন দিন ছুটি ঘোষণা করে। যাতে শহরবাসীরা নিজ নিজ গ্রামে গিয়ে পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে ঈদ উৎসব পালন করতে পারে। ঈদ উপলক্ষে পত্র-পিত্রকাগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র এবং ঈদসংখ্যা প্রকাশ করে। রেডিও,  টেলিভিশন  প্রচার করে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানমালা।

শহর গ্রামের সব জায়গায় ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। দেশের সবচেয়ে বড়ো জামাত অনুষ্ঠিত হয় কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ময়দানে। যেখানে একসঙ্গে লক্ষাধিক মুসল্লি নামাজ আদায় করেন। নামাজের পরপরই শুরু হয় প্রীতি আর শুভেচ্ছা বিনিময়মূলক কোলাকুলি। এই কোলাকুলি চলে সারা দিন। এমনকি তার পরেও। এই কোলাকুলি সকল মুসলিমের সাম্য আর ভালোবাসার স্বীকৃতি। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশীর সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়ার ধর্মীয় এবং সামাজিক রীতি।

বাহ্যিক দিক থেকে ঈদ আনন্দময় হয়ে ওঠে নতুন এবং সুন্দর পোশাকে, খাওয়া-দাওয়ায়। বিশেষ করে ছোটোদের কাছে। ফেতরাসহ দান সে আয়োজনের পূর্ণতা রক্ষায় বিশেষ সহায়ত করে। সারাদিনব্যাপী এই উৎসবে মুসলমানদের অংশগ্রহণ হয় সর্বাত্মক এবং সার্বজনীন। কারণ সব মানুষ মিলেমিশে গড়ে তুলেছে মানব সমাজ। সেই মানব সমাজের কল্যাণের কথাই বলে ইসলাম। ঈদ এজন্য সকলের জন্য কল্যাণকর একটি উৎসব। ঈদ উৎসব এই শিক্ষা দেয় যে, নিজের সম্পদ নিজে ভোগ করলেই হবে না, সে সম্পদে অন্যেরও অধিকার আছে। কারণ ঈদ উৎসবের মূল বাণী হচ্ছে মানুষে মানুষে ভালোবাসা, সম্প্রীতি। সকলের মাঝে একতা ও শান্তি।

বাংলাদেশ সময়: ১৯০০ ঘণ্টা, আগস্ট ০৭, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইচ্ছেঘুড়ি-ichchheghuri@banglanews24.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।