ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

দুই বন্ধু

আবুল কালাম আজাদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩৪ ঘণ্টা, মে ১২, ২০১১
দুই বন্ধু

তপু আর অপু। দুই বন্ধু।

ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পড়ে ক্লাশ সেভেন-এ। ছাত্র হিসেবে তপু অপুর চেয়ে কিছুটা ভাল। তবে গরীব-দুখীর প্রতি অপুর সহমর্মিতা একটু বেশি।

একদিন ওরা ফিরছিল স্কুল থেকে। স্কুলের গেট দিয়ে বেরিয়ে অপু পকেটে হাত দিয়ে দেখে যে, পকেটে কোনো টাকা নেই। এখন উপায়? অন্তত রিকশা ভাড়ার পনেরটা টাকাতো লাগবেই। তার মনে পড়ল স্কুলে আসার সময় বাবা যে টাকা দিয়েছিল সেটা সে তাড়াহুরো করতে গিয়ে মনের ভুলে টেবিলের ওপর রেখে এসেছে। অগত্যা তপুর কাছ থেকে ধার করতে হল।

একটু এগিয়ে ওরা দেখল এক বোবা লোক ভিক্ষা করছে। আগেই বলেছি যে, গরীবের দুঃখ অপুকে স্পর্শ করে।

অপু তপুকে বলল, ‘আর দু’টো টাকা দে’। ’
তপু বলল, ‘কেন?’
-‘ঐ বোবা লোকটাকে দেব। ’
-‘ধার করে গরীবের সেবা করতে হবে না। ’
-‘আরে লোকটাতো অসহায়। ’
-‘তুই নিজেইতো এখন অসহায়, আমি টাকা না দিলে এই চৈত্রের দুপুরে হেঁটে হেঁটে বাসায় যেতে হবে। ’
-‘প্লিজ তপু, লোকটাকে দু’টো টাকা না দিলে আমি শান্তি পাব না মনে। ’

তপু আরো দুই টাকা দিল। দু’জনই গেল লোকটার কাছে। লোকটার হাতে অপু টাকা দুটো দিল। তপু বলল, ‘আজকাল মানুষ অন্ধদের প্রতি বেশি দয়াবান। মূলত অন্ধরা বেশি অসহায়। ’ আর অমনি লোকটি বলে উঠল, ‘সেটা আমিও জানি, কিন্তু এখন অন্ধ হয়ে চোখ বন্ধ করে রাখলে আমার উদ্দেশ্য হাসিল হবে না। ’ বোবার কণ্ঠে স্পষ্ট কথা। প্রথমটায় ওরা দু’জন ভয় পেয়ে লাফ দিয়ে পিছিয়ে গেল। যেন মরা মানুষ জ্যান্ত হয়েছে। একটু পর ওরা সস্তি ফিরে পেল। বুঝতে পারল আসল রহস্য। সঙ্গে সঙ্গে ওদের মেজাজও চড়ে গেল।

তপু এগিয়ে এসে বলল, ‘সুস্থ শরীর বোবা সেজে ভিক্ষা করা। দাঁড়াও তোমাকে এখনই মজা দেখাচ্ছি। ব্যাটা ভন্ড, এখন চিৎকার করে লোক জড়ো করে তোকে গণ পিটুনি খাওয়াবো। তারপর তোকে পুলিশে দেব। জোচ্চরির মজা বুঝবে আজ। ’

লোকটা বলল, ‘চুপ চুপ, আমার কথা শোন। দয়া করে তোমরা একটু শান্ত হও। ’ অপু বলল, ‘কিসের শান্ত হব? মনে করেছ ছোট মানুষ কিছু করতে পারবে না, না? দ্যাখ কী করতে পারি আর না পারি। ’

কয়েকজন লোক এগিয়ে আসছিল। লোকটা বেগতিক বুঝতে পেরে ওদের দু’জনতে টান দিয়ে দেয়ালের পাশে নিয়ে বলল, ‘শোন, আমি আসলে ভিক্ষুক নই। আমি পুলিশের লোক। এখানে বোবা ভিক্ষুক সেজে এসেছি ক্রিমিনাল ধরার জন্য। ’

একথা ওদের বিশ্বাস হল না। তপু বলল, ‘তুমি আবার নতুন চাল চালতে চাচ্ছো? আর আমাদের বোকা বানাতে পারবে না। আজ তোমার খবর করেই ছাড়বো। ’

লোকটা বলল, ‘বিশ্বাস কর, আমি কোনো চাল চালছি না। আশে-পাশে আরও পুলিশ আছে। এই স্কুলের ক্লাশ ফোরের ছেলে মিঠুকে চেন?’ ওরা দু’জনই মিঠুকে চেনে। সে এবার একটা টিভি চ্যানেলের সংগীত প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। অপু বলল, ‘চিনি, খুব ভাল করে চিনি। ’ লোকটা তখন তার পকেট থেকে একট ফটো বের করে বলল, ‘দ্যাখতো এটা কিনা। ’ তপু বলল-‘হ্যাঁ, এটাতো মিঠুর ছবি। ’ লোকটা বলল, ‘ক্রিমিনালরা ওর বাবার কাছে এক লক্ষ টাকা চাঁদা চেয়েছে। বলেছে ‘না দিলে মিঠুকে কিডনাপ করবে। আমরা গোপন সূত্রে খবর পেয়েছি আজ ক্রিমিনালরা এই স্কুলে আসবে মিঠুকে কিডনাপ করতে। ’

তপু-অপুর মনে ভীষণ উত্তেজনা জাগল। সে যে সত্যিই পুলিশের লোক সে বিষয়েও ওদের আর কোনো সন্দেহ রইল না। ওরা কিছু বলতে পারছিল না। লোকটা বলল, ‘তোমরা আমার সঙ্গে কিছুক্ষণ থাকবে? আমি তোমাদের কাছ থেকে একটু সাহায্য পেতে চাই। ’

পুলিশকে সহায়তা! কেমন রোমাঞ্চ জেগে উঠল ওদের মধ্যে। দেরি করে বাসায় ফিরলে কৈফিয়ত দিতে হবে সে কথা ভুলে গিয়ে দু’জনই বলল, ‘থাকবো, অবশ্যই থাকবো আপনার সাথে। আর মিঠুতো আমাদের স্কুলেরই ছেলে। সংগীত শিল্পী হিসেবে ও স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করেছে। ওর প্রতি আমাদেরও তো দায়িত্ব আছে। ’

লোকটা আবার রাস্তায় দাঁড়িয়ে আগের মত ভিক্ষা চাইতে লাগল। তপু আর অপু দাঁড়িয়ে রইল একটু দূরে দেয়ালে ঠেস দিয়ে। ছোট ক্লাশ ছুটি হয়েছে মাত্র। মিঠুর গার্ডিয়ান আসে না। ও স্কুল ভ্যানে যাতায়াত করে।

একটু পর দু’জন ভিক্ষুক এলো স্কুলের গেটের সামনে। একজন অন্ধ আর একজন খোড়া। পুলিশ তখন অপু আর তপুক হাত ইশারায় ডাকল। বলল ‘ওরা সত্যিই ভিক্ষুক কিনা তা তোমরা প্রমাণ করবে। ’ তপুকে একটা লাঠি দেখিয়ে বলল, ‘তুমি এই লাঠিটা এমনভাবে অন্ধ লোকটার সামনে ঘুরাবে যেন প্রায় ওর মাথায় লাগে লাগে। ও যদি সত্যিই অন্ধ হয় তাহলে কিছুই টের পাবে না। আর যদি তা না হয় তাহলে......। ’

তারপর অপুকে বলল, ‘আর তুমি ঐ খোড়া লোকটাকে পেছন থেকে এমনভাবে ধাক্কা দিবে যে খোড়া হলে অবশ্যই পড়ে যাবে। ’

কথা মত ওরা দু’জন গেল লোক দুজনের কাছে। প্রথমে অপু পেছন থেকে খোড়া লোকটাকে প্রাণপণে মারল এক ধাক্কা। লোকটা ভীষন এক লাফ দিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে উঠল, ‘ঐ ছ্যামরা, চোখ নাই তোর? অমন ধাক্কাইয়া চলোস। দিমু একবারে ফুটা কইরা। ’

একটু পর তপু অন্ধ লোকটার সামনে লাঠি ঘুরাতে লাগল। লোকটা বলে উঠল, ‘অমন কইরা লাঠি নাড়াইতোছোস যে? আমার চোখ দুইডা কি কানা কইরা দিবি?’ তপু বলল, ‘আপনিতো কানাই, আপনাকে আবার কী কানা করবো?’ লোকটা রেগে উঠে বলল, ‘কথা না বাড়াইয়া ভাগ, নইলে.....। ’

ঠিক তখনই সাত-আট জন মানুষ ওদেরকে চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলল। সেই লোকটি এসে বলল, ‘আর পালানোর পথ নেই। তোরা ধরা পড়ে গেছিস। খোড়া খবির আর কানা কালু, তোদের সব খেল শেষ। খোড়া আর কানা সেজে অনেক দেখিছেস আজ......। ’

তারপর একজন ওদের হাতে হ্যান্ডকাপ পড়ালো, পায়ে ডান্ডা বেড়ি পড়ালো। পুলিশের গাড়ি এল। ওদেরকে গাড়িতে তুলল। যাবার সময় সেই পুলিশ অফিসারটি তপু আর অপুকে বলল, ‘তোমরা আমাদের কাজে যেভাবে সাহায্য করলে তা সত্যিই প্রশংসনীয়।

তোমাদের দু’জনকে কিছু উপহার দিতে চাই। এর জন্য আগামীকাল আমি তোমাদের স্কুলে আসবো। মিঠুর বাবা-মাও বারবার তপু আর অপুকে বুকে জড়িয়ে ধরল। বলল ‘তোমাদের জন্য আমার ছেলেটা রক্ষা পেল।

পরদিন সকাল দশটায় সেই পুলিশ অফিসার এল ওদের স্কুলে। ওদের জন্য সে অনেকগুলো বই উপহার নিয়ে এসেছে। বইগুলো পেয়ে ওরা খুবই খুশি হল। স্কুলের শিক্ষকরাও তপু-অপুর’র খুব প্রশংসা করল।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।