‘সাদাসিধে কথা’ নামটি শুনলেই এই মানুষটির কথা মনে পড়ে। সহজ সরল ভাষায় সাদাসিধে কথা বলতে পারেন, আমাদের দেশে এমন আর কে আছেন? হ্যাঁ, জনপ্রিয় লেখক ও শিক্ষাবিদ মুহম্মদ জাফর ইকবালের কথাই বলছি।
বাংলাদেশের শিশু-কিশোরদের কাছে তুমুল জনপ্রিয় এই লেখকের ৬৩ তম জন্মবার্ষিক আজকে। ১৯৫২ সালের এই দিনে (২৩ ডিসেম্বর) সিলেটে জন্মেছেন তিনি। তাঁর বাবা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ফয়জুর রহমান আহমদ এবং মা আয়েশা আখতার খাতুন। বাবার পুলিশে চাকরির সুবাদে জাফর ইকবালের ছোটবেলা কেটেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায়। ভীষণ সাহিত্যমনস্ক এক পরিবারে জন্মেছেন তিনি। বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক এবং ছোটভাই জনপ্রিয় কার্টুনিস্ট ও সাহিত্যিক আহসান হাবীব। প্রত্যেকে নিজেদের নামেই সুপরিচিত।
বাংলাদেশের শিশু-কিশোরদের কাছে খুব প্রিয় নাম মুহম্মদ জাফর ইকবাল। ‘আমি তপু’, ‘টুকুনজিল’, ‘দস্যি ক’জন’, ‘রাশা’, ‘মেকু কাহিনী’, ‘বৃষ্টির ঠিকানা’ ইত্যাদি জনপ্রিয় কিশোর উপন্যাসের লেখক তিনি। তাঁর লেখা অনেকগুলো কিশোর উপন্যাস বাংলা কিশোর-সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। এছাড়াও লিখেছেন অসংখ্য বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী। ছোটদের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত ইতিহাস সহজ ভাষায় তুলে ধরতে লিখেছেন ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ নামে ২২ পৃষ্ঠার একটি পুস্তিকা।
শিশুসাহিত্যিক হিসেবে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় এই লেখকের লেখালেখির শুরুটা বেশ অদ্ভুত। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। প্রথম সায়েন্স ফিকশন গল্প ‘কপোট্রনিক ভালোবাসা’ প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক বিচিত্রায়। গল্পটি পড়ে একজন পাঠক দাবি করেন সেটি কোনো এক বিদেশি গল্প থেকে চুরি করা। অনেকটা এর উত্তর হিসেবেই তিনি একই ধরনের আরো বেশ কয়েকটি গল্প বিচিত্রার পরপর কয়েকটি সংখ্যায় লিখে পাঠান। এ গল্পগুলো নিয়েই পরবর্তীতে ‘কপোট্রনিক সুখ-দুঃখ’ বইটি প্রকাশিত হয়। বইটি পড়ে শহীদ-জননী জাহানারা ইমাম বেশ প্রশংসা করেন। এরপর আর থেমে থাকতে হয় নি জাফর ইকবালকে। প্রতি বইমেলাতেই পাঠকরা উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করে তাঁর বইয়ের জন্যে।
শহুরে শিশুকিশোরদের ইট-কাঠ-পাথরের জীবন রঙিন করে তুলেছে জাফর ইকবালের বই। তাঁর বেশিরভাগ কিশোর উপন্যাসে বেশ সাবলীলভাবে ওঠে আসে মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ। এই প্রজন্মের অনেক শিশুকিশোররা মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক ধারণা লাভ করে তাঁর লেখা পড়েই। শুধু প্রিয় লেখক নয়, এই দেশের শিশু-কিশোরদের বন্ধুও তিনি। তাই তো যেকোন কিছু নিয়ে জানতে হলে কিংবা যেকোন সমস্যায় সরাসরি তাঁকেই প্রশ্ন করে সমাধান খোঁজে ওরা। এইসব প্রশ্নোত্তর নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ‘তোমাদের প্রশ্ন আমার উত্তর’ ও ‘আরো প্রশ্ন আরো উত্তর’ বই দুটি।
নিজের সেই পরিচিত সহজবোধ্য ভাষায় জাফর ইকবাল লিখেছেন বিজ্ঞান ও গণিত নিয়েও। বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড গড়ে তোলার পেছনে তাঁর অসামান্য অবদান রয়েছে। অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদের সাথে যৌথভাবে লেখা তাঁর ‘নিউরনে অনুরণন’ ও ‘নিউরনে আবারো অনুরণন’ বই দুটি গণিতপ্রেমীদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়।
(মুহম্মদ জাফর ইকবালের সঙ্গে লেখক)
‘সাদাসিধে কথা’ শিরোনামে নিয়মিত কলাম লেখেন ২০০৪ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া এই শিশুসাহিত্যিক। লেখেন তাঁর বৈশিষ্ট্যসূচক সহজ ভাষায়। মনে প্রাণে দেশপ্রেমিক এবং ভীষণ রাজনীতি-সচেতন এই লেখক সরাসরি লিখেছেন স্বাধীনতাবিরোধী ও ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে। সদা প্রতিবাদী এই লেখক সবসময় লিখে চলেছেন কোনো না কোনো অন্যায় বা অনিয়মের বিরুদ্ধে। আর একারণে স্বাভাবিকভাবেই প্রতিক্রিয়াশীলদের রোষানলেরও শিকার হয়েছেন।
শিশুসাহিত্যিক, কলাম লেখক, শিক্ষাবিদ, ইত্যাদি অনেক বিশেষণের আড়ালে অনেক সময়ই হারিয়ে যায় মুহম্মদ জাফর ইকবালের বিজ্ঞানী পরিচয়টি। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন থেকে পিএইচডি করে ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি ও বেল কমিউনিকেশান্স রিসার্চে বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। সুদীর্ঘ আঠারো বছর পর ঢাকায় ফিরে আসেন দেশের টানে। বর্তমানে তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের একজন অধ্যাপক এবং তড়িৎ কৌশল বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
বাংলাদেশের শিশু কিশোরদের অভিভাবক হয়ে আরো অনেক অনেক বছর বেঁচে থাকুক সাদাসিধে ভাষার লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। জন্মদিনে তাঁর পাঠকদের চাওয়া এটুকুই।
বাংলাদেশ সময়: ১৭০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৩, ২০১৫
এফএম/টিকে