‘বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই, মাগো আমার শোলক বলা কাজলা দিদি কই....’ একমনে পড়েই চলেছে তমাল। মায়ের ডাক শুনে পড়ার টেবিল ছেড়ে বাইরে এলো।
বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান তমাল। বাবা-মা দু’জনই চাকরি করেন। স্কুলের সময়টুকু বাদ দিয়ে বাকিটা সময় একাই থাকে সে। রাতের খাবার খাওয়ার সময় তিনজন একসঙ্গে খেতে বসে। সকালে ও দুপুরে যে যার মতো খেয়ে নেয়। তাই রাতের খাবার খেতে খেতে তিনজন সারাদিনে ঘটে যাওয়া ঘটনার গল্প করে। আজ তিনজনেরই মন খুব ভালো, তাই কথা বলা, গল্প বলা যেন আর শেষ হচ্ছে না।
হঠাৎ মা খেয়াল করলেন ঘড়ির কাঁটা রাত ১২টার ঘরে পৌঁছে গেছে। তাই তাড়া দিয়ে বললেন, কি আজ ঘুমানো লাগবে না? সকালে উঠতে ১২টা বেজে যাবে। যাও ওঠো, তাড়াতাড়ি করো। মায়ের তাড়া পেয়ে বাবা-ছেলে ডাইনিং টেবিল ছেড়ে শোবার ঘরে চলে এলো।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে নানা কথা ভাবতে লাগল তমাল- কাল সকালে স্কুলে গিয়ে কী করবে, ফিরে এসে কী করবে, এসব কথা। ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুম রাজ্যে ডুব দিল সে।
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখল বাবা মা-অফিসে চলে গেছেন। ওর জন্য নাস্তা, ইউনিফর্ম, ব্যাগ গোছানো। আর একটা চিরকুটে লিখে গেছেন- বাবা, নাস্তা করে বাকিটা ফ্রিজে উঠিয়ে রেখ আর দুপুরের টিফিন নিতে ভুলো না কিন্তু, লক্ষ্মী বাবা আমার।
এটা তমালের জন্য প্রতিদিনের লিখে যাওয়া চিরকুট। ঠিকঠাক সব কাজ সেরে তমাল ঘরে তালা-লাগিয়ে বাইরে এলো। এমন সময় বাড়ির সামনের কাঁঠাল গাছের একটা হলুদ পাতা তমালের হাতের ওপর পড়লো। আর তখন ওর মনে হলো, এই রে ঘড়ি পরতে ভুলে গেছি। তোমাকে ধন্যবাদ কাঁঠাল পাতা বলেই সে আবার ঘরে
ছুট দিলো এবং ঘড়ি পরে স্কুলে চলে গেলো।
বিকেলে বাড়ি ফিরে দেখলো বাবা-মা তখনো ফেরেননি। তাই হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বাইরে এলো খেলার জন্য। খেলাটা শুরু করতে না করতেই বাবা-মা চলে এলেন। তাই আর খেলা হলো না। তাদের সঙ্গে সঙ্গে তমালও ঘরে চলে এলো। একটু পরই ওর গৃহশিক্ষক এলেন। গৃহশিক্ষককে তমাল খুব পছন্দ করে। উনিও তমালকে খুব আদর করেন।
তমাল ওর গৃহশিক্ষক আজাদকে তার স্কুলে যাওয়ার সময়ের ঘটনাটা বলল। আজাদ সাহেব খুব মনোযোগ দিয়ে ওর কথা শুনলেন এবং তার জীবনে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনার কথা বললেন, আমি তখন দশম শ্রেণির ছাত্র। আমি হোস্টেলে থাকতাম পঞ্চম শ্রেণি থেকে। রোজার ছুটিতে স্কুল বন্ধ, তাই হোস্টেলও বন্ধ হয়ে যাবে, আমার বাবা এসেছেন আমাকে নিয়ে যেতে। বাবা গেস্টরুমে অপেক্ষা করছেন। আমি রেডি হয়ে বাবার কাছে আসছি, এমন সময় আমাদের হোস্টেলের গেটের সামনের সজনে গাছটার একটা ডাল ভেঙে পড়লো। বাবা ভয় পেলেন, চলার পথে বাধা পড়ল, না জানি কী হয় তাই খানিক সময় অপেক্ষা করতে বললেন।
আমি আর বাবা ১০ মিনিট থেমে যাত্রা শুরু করলাম। বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে শুনলাম আমাদের যে গাড়িটাতে যাওয়ার কথা ছিল, সেই গাড়িটা কিছুক্ষণ আগে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে এবং যাত্রীরা মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন, কয়েকজন নাকি মারাও গেছেন।
এই কথা শুনে তমাল পুরো হা হয়ে গেলো। বললো, বলেন কী স্যার, সেদিন যদি আপনারা বাধা না পেতেন আপনাদের অবস্থা কী হতো?
কী জানি, কী হতো, তবে এখনো আমি মাঝেমধ্যে ওই গাছটার কথা মনে করি। গাছ আমাদের নানাভাবে উপকার করে। অক্সিজেন দেওয়ার কথাটাই ভাবো না কেন? আমাদের চারদিকের বিষাক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড সে নিজে গ্রহণ করে, তারপর নিজে ফ্রেশ অক্সিজেন দান করে।
পড়ানো শেষ হলে আজাদ সাহেব চলে গেলেন। তমাল টিভি রুমে এলো। মা-বাবাকে স্যারের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা বললো। তারপর ওরা রাতের খাবার খেয়ে যার যার রুমে চলে গেলো।
তমালের আজ কিছুতেই ঘুম আসছে না। বিছানা ছেড়ে জানালার ধারে এসে দাঁড়ালো। আকাশের গায়ে মিটমিট করে জ্বলছে অসংখ্য তারা আর তাদের মাঝে বিশাল একটা চাঁদ। আজ পূর্ণিমা। জ্যোৎস্নায় আলো হয়ে আছে চারপাশ। ওর খুব ইচ্ছে করছে বাইরে বের হতে, কিন্তু দরজা খুলে বাইরে বেরুলেই তো মা-বাবা টের পেয়ে যাবেন। এখন রাত ২টা বাজে। এত রাতে বাইরে বের হওয়াটাও ঠিক হবে না। এসব ভাবতে ভাবতে তমাল খেয়াল করলো চাঁদটা একবার আলো দিচ্ছে আবার অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। আকাশটা মেঘে ঢেকে গেছে। উড়ে বেড়াচ্ছে কালো মেঘ। সেই মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি খেলায় মেতেছে চাঁদ। চাঁদ আর মেঘের লুকোচুরি খেলা দেখতে দেখতে হঠাৎ বাতাস উঠলো। এক মুঠো ধুলো উড়ে এসে পড়লো তমালের চোখে-মুখে।
বাতাসটা আস্তে আস্তে বাড়ছে। বাধ্য হয়েই জানালাটা বন্ধ করলো সে, বিছানার ওপর বসে চোখ মুখের ধুলো ঝাড়লো। টেবিলের ওপর রাখা গ্লাসের পানি দিয়ে চোখ ধুয়ে ফেলল। এখন আর জ্বালা করছে না। বাতাসটা ঝড়ের রূপ নিয়েছে বলে মনে হলো। এমন সময় মা-বাবার ঘরের দরজা খোলার শব্দ শুনতে পেলো। ছুটে গিয়ে তমাল মায়ের কাছে দাঁড়ালো। মা বললেন, বাবা, ঘুম ভেঙে গেলো, নাকি ঘুমাওনি! একি চোখ লাল কেন, ভয় পেয়েছো?
তমাল মাকে জড়িয়ে ধরলো। বাথরুম থেকে বাবা ফিরে এলে ওরা তিনজন একসঙ্গে ঘুমালো। মা-বাবার সঙ্গে শুয়ে তমাল ঘুমিয়ে পড়লো। ওদিকে ঝড় বেড়েই চলেছে। বৃষ্টিও শুরু হয়েছে। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়া, বেশ লাগছে। তিনজনই বেশ আয়েশ করে ঘুমালো।
সকালবেলা সবার আগে ঘুম ভাঙলো তমালের। মা-বাবা তখনো ঘুমিয়ে। সেই সুযোগে চুপিচুপি উঠে এসে দরজা খুললো। খুলেই মামনি বলে একটা চিৎকার দিলো তমাল। সঙ্গে সঙ্গে মা-বাবার ঘুম ভেঙে গেলো। তাড়াহুড়ো করে দু’জনই উঠে বাইরে বের হলেন। আর দেখতে পেলেন তমাল হাঁটু গেড়ে কাঁঠাল গাছের কাছে বসে আছে। কালকের ঝড়ে গাছটা ভেঙে গেছে। ওদিকে পাশের বাড়িটার টিন উড়ে এসে পড়েছে ওদের বারান্দায়।
একে একে সবাই এলো ঝড়ে ভেঙে যাওয়া বাড়িটা দেখতে। আর তমালদের বাড়িটা দেখে বললো, এই বাড়িটার ঝড়ে কিছুই হবে না। চারদিকে যে গাছপালা রয়েছে। এই কাঁঠাল গাছটা না থাকলে বাড়িটার অনেক ক্ষতি হয়ে যেত।
পরিবেশ আবার শান্ত হয়ে গেছে। যে যার মতো ব্যস্ত দিন কাটাতে লাগল। কিন্তু তমালের মন কাঁঠাল গাছটার কথা ভুলতে পারলো না। মা-বাবা ব্যাপারটা বুঝলেন, তাই তারা একটা ছোট্ট কাঁঠালের গাছ ওই জায়গাটাতে লাগিয়ে দিলেন। বাড়িতে কেউ নেই। স্কুল থেকে ফিরে ঘরে বই রেখে সে খেলার জন্য বের হলো। বারান্দাতে পা রাখতেই সে দেখতে পেলো একটা ছোট্ট কাঁঠাল গাছ।
গাছটা দেখে ওর মনটা খুশিতে ভরে উঠলো। ওর বড় গাছটার কথা খুব মনে পড়লো। স্মৃতিতে ভেসে উঠলো গাছের ছবি। ঠিক তখনই অন্য গাছের ডাল থেকে খসে এসে একটা কাঁঠাল পাতা ওর পায়ে পড়লো। পাতাটা দেখে ওর মনটা খুশি হলো। গাছটা যেন পাতাটা তার জন্যই পাঠিয়েছে। সে পাতাটা উঠিয়ে নিয়ে নিজের ডায়েরির ভেতরে রেখে দিলো। আর পানি এনে ছোট গাছটার গোড়ায় দিলো। আর বললো, বন্ধু তোমাকে কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি বড় হতে হবে।
তমালের মা-বাবা আড়াল থেকে ছেলের কাণ্ড দেখে খুব খুশি হলেন। ছোট্ট গাছটাও আস্তে আস্তে তমালের বন্ধু হয়ে গেলো। সে প্রতিদিন গাছে পানি দেয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৯, ২০১৫
এএ