ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

সুন্দর তবে ভয়ানক | রহীম শাহ

গল্প/ইচ্ছেঘুড়ি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪০ ঘণ্টা, মার্চ ৭, ২০১৬
সুন্দর তবে ভয়ানক | রহীম শাহ

আমাদের গ্রামের বাড়ি কর্ণফুলী নদীর খুব কাছাকাছি। চারদিকে সবুজের ছড়াছড়ি।

যেদিকে চোখ যায়, কেবল সবুজ আর সবুজ। গ্রামজুড়ে শিরা-উপশিরার মতো ছোট ছোট বহু খাল। পুকুর জলাশয় তো আছেই। আমাদের গ্রামটি ছিল বেশ শান্ত। এই গ্রামে আমার ছেলেবেলা কেটেছে।

আমার বাবা সাপ নিয়ে অনেক গল্প করতেন। তার গ্রামের বাড়ি কর্ণফুলী নদীর পাড়ের একটা শান্ত গ্রাম। শৈশবকালে তিনি শত শত সাপ দেখেছেন।

সে বলত, সব সাপই বিষধর নয়। ঢোঁড়া সাপ উজ্জ্বল বাদামি রঙরে। প্রচুর বৃষ্টিপাত হলে জলে ভরে যায় গর্ত। গর্তে থাকার অসুবিধার কারণে সাপেরা বের হয়ে এদিক সেদিক ছুটতে থাকে। লোকেরা সাধারণত জানেই না, তারা অমন করে ছুটোছুটি কেন করে। গ্রামের ছেলেরা এসব সাপ ধরে ফেলে। নিয়ে আসে খোলা মাঠে খেলার জন্য। তারা সেগুলো নিয়ে খেলে, বিভিন্ন নাম দেয়। অনেক সময় পকেটেও রাখে তাদের মা আর বোনদের ভয় দেখানোর জন্য।

অনেক সাপ আছে, একেবারে সবুজ ঘাসের মতো। ওদের চোখগুলো উজ্জ্বল নীল রংয়ের। বেশ সুন্দর, তবে ভয়ানক। সেগুলো ঘাসের সঙ্গে মিশে থাকে। ঘাস খেতে গিয়ে অনেক গরু ওদের মাড়িয়ে দেয়। এতে সাপগুলো মারা যায়। আবার অনেক সময় গরুকে সাপগুলো দংশন করে। এতে গরুও মারা যায়।

সাপদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুন্দর অথচ বেশি ভয়ঙ্কর হলো- গোখরা, ক্রেইট, কেনটেস। এরা ফণা তোলে। ফণা যখন তোলে মাথার উপরে বেশ সুন্দর ফুলের মতো আলপনা দেখা যায়। তাদের চোখের দৃষ্টি ভয়ানক তীক্ষè। কোনো ছোট প্রাণীও তাদের চোখ এড়িয়ে যেতে পারে না।
আগেকার দিনে গ্রামের লোকেরা এসব বিষাক্ত সাপের বেশ প্রশংসা করত কেবল ভয়ের কারণে। বিষাক্ত বুড়ো সাপ, যেমন- কোবরা বা গোখরা মানুষের বসতিতেই সারা বছর বাস করে। মানুষেরা তাদের বিরক্ত করত না। তবে সতর্ক থাকত।

এখনও অনেকেই এ রকম বিষধর সাপকে বলে ‘বাস্তু সাপ’। গ্রামের লোকেরা বাস্তু সাপকে সৌভাগ্যের প্রতীক মনে করে। তারা মনে করে বাস্তু সাপ পরিবারের লোকজনকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করে। তারা জানত সাপের অবস্থান। তারা সেই সাপের গর্তের কাছে ছোট্ট পাত্রে দুধ নিয়ে রাখত, যাতে করে সাপগুলো বেরিয়ে এসে দুধ খেতে পারে।

ডাক্তার বলেছিল, তাদের পাশের ঘরে এক দম্পতি থাকত। তাদের একটা ছোট বাচ্চা ছিল। একদিন বাচ্চাটা তার ছোট্ট চৌকিতে ঘুমুচ্ছে একা একা। মহিলাটি তার রান্নাঘরের কাজে ব্যস্ত। কাজের ফাঁকে ফাঁকে বাচ্চাটা ঠিকমতো ঘুমুচ্ছে কি না দেখে যায়। সন্ধ্যার সময় পূজা উপলক্ষে সে বিশেষ খাবার রান্না করছিল।
কিছু সময় পর শিশুটির মা দেখতে চেয়েছিল বাচ্চা এখনও ঘুমুচ্ছে কি না। বাচ্চাটার রুমে উঁকি মারতেই ভয়ে তার রক্ত হিম হয়ে গেল। দেখা গেল, ঘুমন্ত শিশুর মাথার কাছেই একটা সাপ ফণা তুলে আছে। সাপটা ওখানে কুণ্ডলি পাকিয়ে রইলো শরীরের নিচের অংশ।

মা আতঙ্কের সঙ্গে খেয়াল করল ওটা কোনো বাস্তু সাপ নয়। একটা ছোট সাপ। শিশুটির দাদিও তাদের দেখছিল। একটুও কথা না বলে দাদি রান্নাঘরে ফিরে গেল। সেখান থেকে দ্রুত ছোট একবাটি দুধ নিয়ে বাচ্চার বিছানার কাছাকাছি জায়গায় রাখল। দুধের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ল ঘরময়। গন্ধটা পেয়ে সাপটা আস্তে করে ওখান থেকে নেমে এল। তারপর এসে দুধের বাটিতে মাথা নামিয়ে দুধ পান করতে লাগল। এ ফাঁকে দাদি চট করে রুমে ঢুকে বাচ্চাটাকে তুলে নিয়ে গেল। আসার সময় আস্তে করে দরজাটা টেনে দিল।
এরপর লোকজন লাটিসোটা নিয়ে ঘরটায় ঢুকল। বেশ সতর্কতার সঙ্গে খুঁজল সাপটাকে। কিন্তু ঘরের কোথাও সাপটার চিহ্নও নেই। সাপটা এরই মধ্যে সরু কোনো পথ পেয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে।

আমাদের ডাক্তার বন্ধু বলছিল তার বাবার কথা। তার বাবা বলত, কেউ যদি সাপ ধরতে ছোটে, তবে কখনও যেন সোজা না ছোটে। তাকে এঁকেবেঁকে অনুসরণ করতে হবে। সাপ তার পথ পরিবর্তন করতে অনেক সময় নেয়। আর এ সময়ের মধ্যেই যে কেউ সাপের কাছে পৌঁছুতে পারে।

একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর সাপ তার খোলস বদলায়। খোলস বদলানোর পর কিছু সময় ওটা বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে। সাপের ত্বক তখন বেশ নরম থাকে। আর দ্রুত ছুটতে পারে না, যতদিন না ওটার ত্বকে আবার নতুন শক্ত খোলস না হয়। সাপের খোলস বদলানোর পরপর সাপ মারা বেশ সহজ। তবে কোনো লোক দুর্বল আর অসহায় শত্রুকে আঘাত করে না।

প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রতি বছর সাপের কামড়ে অনেক লোক ও অন্যান্য প্রাণী মারা যায়। আজকাল সাপের কামড়ের দ্রুত নিরাময়ের অনেক ওষুধ পাওয়া যায়। তবে গ্রামের অনেক লোকই এটা জানে না।

গ্রামে মাঝেমধ্যে কিছু লোককে পাওয়া যায়, যারা সাপের কামড়ের নিরাময়ের জন্য গাছ-লতা-পাতার ওষুধ দিতে পারে। তবে শিগগিরই তাকে হাসপাতালের চিকিৎসা নিতে হয়।

সাপ ধরা আর সাপের খেলা দেখায় এমন কিছু পেশাদার লোক দেখতে পাওয়া যায়।

গর্ত থেকে সাপ শিকারের অনেক কৌশল আছে। সেটা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ডাক্তার বলেছিল, ‘যখন আমার বয়স সাত বছর, তখন আমি একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখেছিলাম। সে সময় আমরা উত্তর বঙ্গে থাকতাম। ওদিকে তখন প্রচুর নদী আর বড় বড় জলাশয় ছিল। বাড়িঘরগুলো উঁচু জমিতেই তৈরি করত। বর্ষার সময় সে জায়গাটাকে মনে হত বিশাল একটা লেক। আর ঘরগুলোকে মনে হত যেন একেকটা দ্বীপ। এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে যেতে তারা নৌকা ব্যবহার করত।

ব্যবসায়ীরা তাদের পসরা নিয়ে আসত নৌকা করে।

একবার আমার বাবা একটা নৌকা বোঝাই করে অনেক হাঁস এনেছিল আমার বড় বোনের জন্য। আমাদের কাজের লোক জলের নিকটেই একটা বাঁশের চালাঘর বানিয়েছিল।

সেখানে খাঁচাটা এমনভাবে বানানো হয়েছে, যাতে নদীতে জল বাড়লেও যেন ওটা জলের নাগালের বাইরে থাকে। সেই দিনগুলোতে হাঁসেরা বেড়ে ওঠা জলে বেশ আনন্দের সঙ্গে সাঁতার কাটত। তবে সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে তারা সেই চালাঘরে ঢুকে যেত। আর কাজের লোক চালাঘরের দরজা আটকে দিত, যাতে করে শেয়াল বা অন্য কেউ চালাঘরে ঢুকতে না পারে।

একদিন সকালে এক চাষি চালাঘরের দরজা খুলে দেয়। সব হাঁস বেরিয়ে যায়। তবে সে দেখতে পায় নিচে মাটিতে একটা হাঁস মরে পড়ে আছে।
পরদিন সকালে দেখা গেল আরও একটা হাঁস মারা গেছে। চাষি এবার ওটাকে ভালো করে দেখে বলে ওটাকে সাপে কামড়েছে। যে কোনোভাবে হোক একটা সাপ অবশ্যই চালাঘরে ঢুকে আছে।

আবার বড়বোন হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল, ‘হায় রে! এখন সাপটা আমার সব হাঁস মেরে শেষ করে ফেলবে। ’

চাষি তাকে তিরস্কার করল বলল, ‘তোমার সব হাঁস কীভাবে মারবে সে? এখানে আমি কেন আছি? তুমি কি জান না, সাপধরা আর সাপের কামড় থেকে রক্ষা করার জন্য আমাদের পরিবারের নামডাক আছে?’

সে কথা বলে চাষি ঘরে গেল। তবে শিগগিরই সে ঘর থেকে বের হয়ে এল। হাতে একটা কাঠের টুকরো। সম্ভবত ঔষধি। দেখতে অনেকটা লম্বা হাড়ের মতো। আজও জানি না জিনিসটা কী ছিল।

এ সময় সব হাঁস জলে ছেড়ে দেওয়া হল। চাষি আমাদের চালাঘর হতে একটু দূরে থাকতে বলল।

আমরা দেখলাম চালাঘরের দরজার বাইরের দিকে একটা বৃত্ত। চাষি একাই বৃত্তটাতে ঢুকে পড়ল। হাতে ধরা সেই কাঠের টুকরো বা হাড়টা। দেখলাম সে বৃত্তটার ভেতর নড়াচড়া করছে আর কী যেন বিড়বিড় করে বলছে। হঠাৎ আমরা শুনতে পেলাম একটা রাগী ফোঁসফোঁস শব্দ। চাষি সেখান থেকে দ্রুত বেরিয়ে এল আর তার পিছু পিছু এল একটা সাপ।

আমরা সবাই বেশ ভয় পেয়েছিলাম। যে কোনো সময় সাপটা তাকে আঘাত করতে পারে। সে খুব তাড়াতাড়ি তার কাঠের টুকরোটা বের করল। সাপটা তার মাথা নামিয়ে নিল। চাষি কাঠের টুকরাটা দিয়ে চট করে মাটিতে একটা বৃত্ত বানাল সাপটাকে ঘিরে। তারপর সে বৃত্তের ঠিক বাইরে দাঁড়াল। সাপটা রইল বৃত্তের ভেতর। তারপর আমরা দেখলাম এক অদ্ভুত দৃশ্য। ভয়ঙ্কর সাপটা বৃত্তের মধ্যে পাক খাচ্ছে, কিন্তু বৃত্ত থেকে বেরোতে পারছে না। বারবার সাপটা বেরোতে চাইল, কিন্তু ব্যর্থ হল। সম্ভবত জমিরের কাঠের টুকরো বা হাড়টা সাপটার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। সাপটা যখন বৃত্তে আটকে ঘুরপাক খাচ্ছে তখন চাষি একটা শুকনো লম্বা কাঠ সংগ্রহ করে তাতে আগুন ধরাল। তারপর কাঠিটা বৃত্তের মধ্যে রাখল। একসময় কাঠটার আগুন দিয়ে সাপটাকে এখানে সেখানে পোড়াতে লাগল। সাপটা কিন্তু এরপরও বৃত্ত থেকে বেরোতে পারছে না।

বারবার আগুনের সেঁকা লাগাতে সাপটা এক সময় বেশ দুর্বল হয়ে পড়ল। মারা গেল শেষে। চাষি শেষে সাপটাকে সম্পূর্ণ পুড়িয়ে ফেলল।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৫ ঘণ্টা, মার্চ ০৭, ২০১৬
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।