শীতের ভোরে এমন একটা কাণ্ড হয়ে যাওয়ায় ভীষণ বিরক্ত রুশো। দিনের শুরুতেই এমন একটি বিষয় তাকে অস্বস্তিতে ফেলেছে।
যেমন ভাবা তেমন কাজ। রাফ খাতা খুলে পেন্সিল দিয়ে এটা ওটা দাগ কাটতে থাকলো। যা মনে চায় তাই।
চারিদিকে হৈ চৈ। বন্ধুরা সব খেলছে। টিচার তখনো ক্লাসে আসেননি। রবি একবার এসে হাত টানাটানি করে গেছে বটে, কিন্তু রুশো সাড়া দেয়নি। মুখ লুকিয়ে খাতায় আঁকিবুকি চালিয়ে যায়। রবি সোহানরা খেলার সুযোগ মিস করতে চায়নি বলেই বেশি পীড়াপিড়ি না করে বারান্দার দিকে ছুটে গেলো। কিন্তু রুশোর আজ কিছুতেই আগ্রহ নেই। সে জানে আজ খেলতে যাওয়া মানেই হচ্ছে বন্ধুদের হাতে হেনস্ত হওয়া। সকাল বেলার কথা ভাবতেই ফের গা রি রি করে উঠলো তার। হাতের পেন্সিল তখনো খাতার ওপর চলছে।
তখনই হঠাৎ তার কানে এলো ফিসফিস করে নাকিসুরে দুটি কথা রুঁশো...ভাঁলো আছো? মাথা তুললো রুশো। এদিক ওদিকে তাকালো। কই কেউ নেই তো! তাহলে কে বললো কানের কাছে ওই কথা?
একবার ভাবলো ঠিক পেছনের বেঞ্চে তানি বসা। এটা ওরই কাণ্ড। কণ্ঠটা একটু মেয়েলি মেয়েলি মনে হয়েছিলো তার কাছে। কিন্তু আড়চোখে তানির দিকে তাকিয়ে দেখলো- ও অন্যদের সঙ্গে গল্প করছে। তার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। তাহলে কে? স্কুলে কেউতো জানারও কথা নয়।
আসলে কারোই জানার কথা নয়। মাকে শুধু সে একটি কথাই বলেছিলো- স্বপ্ন দেখছিলাম। ভূত ভূতের ছানা... ডিগবাজি খাওয়া এসবের কিছুই মাকে বলেনি। স্কুলে কেই বা জানবে। আর কেউ যদি সত্যিই জেনে যেতো সে বিছানায় হিসু করেছে তাহলে আজ আর স্কুলে টেকাই যেতো না। বন্ধুগুলো ভীষণ দুষ্টু। তানিটা সবচেয়ে বেশি। ওর বাসা আবার একই বিল্ডিংয়ে। ওর জানার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি। আর সত্যি জেনে গেলে তার অপমানের আর শেষ থাকবে না।
আবার মাথা নোয়ালো রুশো। ভাবলো হয়তো ভুল শুনেছে। তবে সকালের ভাবনাটা মন থেকে যাচ্ছে না। ভাবছে আকাশ-পাতাল। কি হলো কাণ্ডটা। আচ্ছা তানি যদি জেনেও থাকে তা জানবে শুধুই বিছানায় হিসু করার কথা। ভূতের ছানার নাকি কথাতো আর তানি শোনেনি।
ঠিক সে কথা যখন ভাবছে তখনই ফের শুনতে পেলো- কিঁ রুঁশো... কিঁ ভাবছো?
নিজের নামটির অদ্ভুত উচ্চারণে রুশোর হাসি পেলো। ফিক করে একটু হেসেও দিলো। আর তখনই তার চোখে পড়লো খাতার ওপর যে আঁকিবুকি করেছে তাতে কোন ফাঁকে আঁকা হয়ে গেছে গত রাতের ভুতের ছানাটি। ঠিক তেমন গোল গোল চোখ। তেমনই ঠাসা নাক। আর চোখা ঠোঁট। আর কথাগুলো বলছে সেই খাতায় এঁকে ফেলা ভূতের ছানাটিই।
দ্রুত খাতা বন্ধ করলো রুশো। হাত দিয়ে চেপে ধরে এদিক-ওদিক তাকালো।
সবাই যে যার কাজে মগ্ন। কেউ খেলছে, কেউ গল্প করছে। যাক বাবা কেউ এখনো দেখেনি।
বড্ড বেকায়দায় পড়ে গেলো রুশো। খাতাটি খুলে দেখতে মন চাইছে... সত্যিই কি ওটা ছিলো গত রাতের সেই ভূতছানা। ভাবলো... কিন্তু খাতাটি খুললো না। বরং হাতদিয়ে আরও জোরে ঠেসে ধরে রাখলো।
উদাস হওয়ার ভান করে উপরের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। কেউ যেনো বুঝতে না পারে একটা ভূতছানাকে সে এভাবে খাতায় বন্দি করে রেখেছে।
হঠাৎ মায়া হলো তার মনে। আহা ভূত ছানাটা কষ্ট পাচ্ছে বুঝি। এই ভেবে হাত আলগা করে খাতাটা খুললো। দেখলো ভূতছানাটি খাতার পৃষ্ঠার ওপর লেপ্টে আছে। একটু আলগা পেয়ে কোনোরকম মুখ তুলে ভূতছানা বললো- রুঁশো তুঁমি এঁত নিষ্ঠুর। আঁমি পুঁরো চিঁড়েচ্যাঁপ্টা হঁয়ে গেঁছি।
চিঁড়েচ্যাঁপ্টা... এমন অদ্ভুত শব্দ রুশো আর শোনেনি। হাসলো সে। আর খেয়াল করে দেখলো- সেই একই গোল গোল চোখ একই মুখ একই নাক স্রেফ আকারে ছোট্ট- এত্তটুকু। গতরাতে ভূতের ছানাটিকে তার মনে হয়েছে ছোট্ট শিশুর মতো। আর এখন এটা পুরোই লিলিপুট। লিলিপুট ভূত।
রুঁশো বললো- স্যরি।
তুঁমিতো সঁরি বঁলেই খাঁলাস... আঁমার পুঁরো হাঁড়গুঁড়ো দঁশা, বললো ভূতের ছানা।
কোনোরকম উঠে খাতার ওপরেই দুটো ডিগবাজি খেয়ে নিলো ভূতের ছানা। তবে তা করতে গিয়ে পড়েই গেলো পা উল্টে।
রুশো বললো- আরে তুমিতো পায়ে চোট পেয়েছো। এখন ডিগবাজি খাবে কি করে।
ভূতছানা বললো- এখঁন দঁরদ দেঁখাচ্ছো। এতঁক্ষণ যেঁভাবে চেঁপে ধঁরেছিঁলে, আঁমিতো ভাঁবলাম তুঁমি আঁমায় প্রাঁণেই মেঁরে ফেঁলবে।
আরে আমি জানতাম নাকি তুমি ওখানে, আমিতো ভেবেছিলাম কেউ দুষ্টুমি করছে, আর আমি ভুল দেখছি, বললো রুশো।
ততক্ষণে ফের উঠে দাঁড়িয়ে গোটা চারেক পটাপট ডিগবাজি খেয়ে নিলো ভূতছানা। বললো- যাঁক বাঁবা হাঁড্ডিগুলো ভেঙ্গে যাঁয়নি। এঁইতো চাঁরটি ডিঁগবাজি খেঁলাম। দেঁখো পেঁট ভঁরে গেঁছে।
এই বলে পেটটাকে সামনে ফুলিয়ে ধরলো ভূতের ছানা।
একে তো লিলিপুট। তায় এতবড় পেট। এই দৃশ্যে কার না হাসি পায়। রুশোও হেসে দিলো। বললো, তুমি এতটুকু হয়ে গেলে কিভাবে।
আঁচ্ছা রুঁশো তুঁমি সঁত্যিই বোঁকা! তুঁমি জাঁনো না, ভূঁতেরা যঁখন তঁখন রূঁপ বঁদলায়, আঁকারও বঁদলায়। আঁমিতো তোঁমাকে কাঁল রাঁতেই দেঁখালাম- আঁমি হাঁওয়া হঁয়েও যেঁতে পাঁরি যঁখন তঁখন।
এই বলে ঝপ করে খাতার ওপর বসে পড়লো লিলিপুট ভূতছানা। আর রুশোকে অবাক করে দিয়ে খাতার সব আঁকিবুকিগুলোও গেলো উবে।
রুশো তখন তার খাতার পাতায় হাত বুলাচ্ছে আর বলছে, আরে এতো সত্যিই গায়েব হয়ে গেলো। বিড় বিড় করে বলতে থাকলো ভূতছানা এসো, ভূত ছানা এসো, আর ব্যথা দেবো না। আর ব্যথা দেবো না।
এভাবে যখন বিড় বিড় করছে রুশো তখন অংকের কালাম স্যার তার ঘাড়ের ওপর থেকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে। তিনি ভেবেছিলেন অন্যমনস্ক হয়ে রুশো নিশ্চয়ই খাতার ওপর অন্য কিছু লিখছে, অংকে মন নেই। কিন্তু দেখলেন ছেলেটা বিড় বিড় করে কি সব বলছে। ভূতছানা এসো, ভূতছানা এসো। হাতে একটা পেন্সিল। কিন্তু খাতার সাদা পাতায় কিছুই নেই।
সম্বিৎ ফিরে পেলো রুশো। ততক্ষণে গোটা ক্লাস তার দিকে ফিরে শুধুই হাসছে। হিহি...হাহা।
কালাম স্যার দয়ামাখা কণ্ঠে বললেন, কি হয়েছে রুশো। তুমি এমন করছো কেনো। রাতে ঘুম হয়নি। যাও ওয়াশ রুমে গিয়ে হাতমুখে পানি দিয়ে আসো।
সবার হাহা...হিহি থেকে বাঁচতে রুশো দে..ছুট।
সোজা ওয়াশ রুমে। হিসুর চাপ পাচ্ছিলো। প্রথমেই একটা ইউরিনালে দাঁড়িয়ে জিপার খুলে হিসু করলো। সকালে নাস্তার টেবিলে অন্য কিছু না খেয়ে পানিই খেয়ে ফেলেছিলো দুই গ্লাস। তাই হিসু যেনো আর শেষই হয় না।
ঠিক তখনই রাহেলার ডাক ও গায়ে ধাক্কা.... আরে খালাম্মা দেখেন রুশো ভাইয়া আজকেও বিছানায় হিসু করেছে।
ঘুম ভাঙলো রুশোর। আর দেখতে পেলো ট্রাউজারসহ বিছানার অনেকটাই ভিজা। আর তার ওপরই সে শুয়ে আছে। মনে মনে ভাবলো... আজও তাহলে কম্ম কাবার।
ভূতের ডিগবাজি-১ | মাহমুদ মেনন
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৬
এএ