তখনকার সোনারগাঁওয়ে তিনটি নগর গড়ে তোলা হয়েছিল। বড়নগর, খাসনগর আর পানামসিটি।
৩০ টাকার টিকিট কেটে যখন পানামনগরের ধ্বংসাবশেষ এলাকায় ঢুকবে তখন প্রায় ৪৫০ বছরের পুরনো কিছু বাড়ি দেখতে পাবে। এখানে কেউ বাস করে না এখন। অনেকে ‘ভূতুড়ে নগর বা অন্ধকার নগর’ বলে থাকেন পানামনগরকে। বাড়িগুলোর স্থাপনাশৈলী দেখার মতো। ইউরোপীয় আর বাঙালির শিল্পরীতির মিশেলে তৈরি করা হয়েছে। তোমরা যে রাস্তা দিয়ে হাঁটবে তার দু’পাশেই এসব ভবন দেখতে পাবে।
এ শহরে একটিই মাত্র রাস্তা। রাস্তার দু’পাশে ৫২টি ভবন রয়েছে। এগুলো নাম্বারিং করা। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় উত্তর পাশে ৩১টি ভবন আর দক্ষিণপাশে ২১টি দেখা যাবে। পানামসিটির মধ্য দিয়ে ৬০০ মিটার বয়ে যাওয়া রাস্তাটি চওড়া ৫ মিটার। এ নগরটি প্রায় ২০ বর্গকিলোমিটারের। ২০০৬ সালে ‘ওয়ার্ল্ড মনুমেন্ট ফান্ড’ বিশ্বের ১০০টি ধ্বংসপ্রায় ঐতিহাসিক স্থাপনার তালিকা প্রকাশ করে তারমধ্যে পানামনগরীর নাম আছে। এটা আমাদের গর্বের কথাই বলে।
নির্মাণশৈলীর নান্দনিকতা উপভোগ করার মতো। একতলা বা দোতলা কোনো ক্ষেত্রে তিনতলা বিশিষ্ট ৫২টি ভবন মন ছুঁয়ে যায়। এখানে দেখা যাবে বড় বড় অট্টালিকা, সরাইখানা, মসজিদ, মন্দির, বিনোদনের জন্য নাচের ঘর, গোসলখানা, পাকঘর, টাকশাল, দরবার হল ইত্যাদি। এগুলোর নির্মাণশৈলী অসাধারণ! বুধ ও বৃহ¯পতিবার বন্ধ থাকে। বাংলাদেশিদের জন্য প্রবেশ ফি ৩০ টাকা হলেও বিদেশিদের জন্য ১০০ টাকা।
আর একটা বিষয় জেনে রোমাঞ্চিত হবে। তোমরা ‘গ্রান্ড ট্রাংক রোড’ এর নাম শুনেছো। এটা দিল্লির পাঠান সম্রাট সুলতান শেরশাহ নির্মাণ করেছিলেন। এটা সোনারগাঁওয়ের খাসনগর থেকে দিল্লি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আবার দিল্লি থেকে আফগানিস্তানের কাবুল ও কান্দাহার পর্যন্ত এ রোড ছিল। এ রোডের দু’পাশেই ছোটবড় দীঘি দেখতে পাওয়া যাবে। পানামসিটির প্রায় কাছেই এ খাসনগর। এখানে ফখরুদ্দীন মোবারক শাহ আমলের মসজিদ ও সমাধি কেন্দ্র দেখতে পাবে।
পানামনগর থেকে আধা কিলোমিটার দূরেই বাংলাদেশ লোকশিল্প জাদুঘর। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন এটার প্রতিষ্ঠা করেন। মিউজিয়ামে দেশের ঐতিহ্য বহন করে এমন অনেক কিছুই আছে। এখানের দীঘিতে নৌকাভ্রমণ করে আনন্দ উপভোগ করতে পারো। ফাউন্ডেশনের প্রবেশপথেই একটি ভাস্কর্য রয়েছে। একজন লোক গরুর গাড়ি ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। জাদুঘরের প্রবেশদ্বার সুন্দর কারুকাজ ও নকশায় সজ্জিত। দর্শনার্থীদের জন্য মোট ১১টি গ্যালারি রয়েছে। প্রতিটি গ্যালারিতে দুর্লভ ঐতিহ্যের নিদর্শন সংরক্ষিত।
গ্যালারিগুলো হলো- নিপুণ কাঠ খোদাই গ্যালারি, মুখোশ গ্যালারি, নৌকার মডেল গ্যালারি, আদিবাসী গ্যালারি, লোকজ বাদ্যযন্ত্র ও পোড়া মাটির নিদর্শন গ্যালারি, তামা, কাঁসা, পিতলের তৈজসপত্র গ্যালারি, লোকজ অলঙ্কার গ্যালারি, বাঁশ, বেত, শিল-পাটি গ্যালারি ও বিশেষ প্রদর্শনী গ্যালারি। দু’টি গ্যালারির প্রথমটি কাঠের তৈরি প্রাচীন ও আধুনিককালের নিদর্শন দিয়ে সাজানো হয়েছে। অন্য গ্যালারিটি সোনারগাঁওয়ের ঐতিহ্যবাহী জামদানি ও নকশিকাঁথা দিয়ে সাজানো।
গ্রামবাংলার প্রায় সব কিছুই এই জাদুঘরে স্থান পেয়েছে। নকশা করা কাঠের দরজা থেকে শুরু করে কাঠের সিন্ধুক, বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র, বিভিন্ন নৌকার ছোট আকৃতির মডেল, পোড়ামাটির পুতুল, পাথরের থালা, পোড়ামাটির নকশি ইট কি নেই সেখানে।
লোকশিল্প জাদুঘরের সামনেই খাওয়ার জন্য ভালোমানের হোটেল গড়ে উঠেছে। তাছাড়া ভেতরেও ক্যান্টিন আছে। খাওয়া-দাওয়া নিয়ে টেনশন না থাকলে ৩০ টাকা দিয়ে ঢুকে পড়ো মিউজিয়ামে।
যাওয়া সহজ। কম খরচ। একদিনে বেশ কয়েকটি দর্শনীয় স্থানে ঘুরে ঢাকায় ফিরে আসা সম্ভব। এসব কারণ আর ইতিহাস-ঐতিহ্য ও লোকজ সমন্বয়ে গড়া ঐতিহাসিক সোনারগাঁওয়ে যাওয়ার মতো দ্বিতীয় আর স্পট নেই বাংলাদেশে।
যেভাবে যাওয়া যাবে:
‘হারিয়ে যাওয়া শহর’ হিসেবে পরিচিত পানামনগর বা পানামসিটি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার পাশের নারায়ণগঞ্জ জেলার মোগরাপাড়া পয়েন্টে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের উত্তরে প্রায় ২.৫ কিলোমিটার অদূরে সোনারগাঁও থানার একটি নিকটতম শহর। গুলিস্তান থেকে স্বদেশ, বোরাক ও সোনারগাঁও নামের বাসে উঠে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সোনারগাঁও মোগরাপাড়া চৌরাস্তায় নামতে হবে। মোগরাপাড়া থেকে লোকশিল্প জাদুঘরের দূরত্ব প্রায় ২ কিমি। চাইলে রিকশা অথবা সিএনজি অটোরিকশায় করে যাওয়া যাবে। তাছাড়াও নিজস্ব যানবাহন নিয়েও যেতে পারো।
বাংলাদেশ সময়: ২০৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৭, ২০১৮
এএ