টুশি কিছুতেই রাফিনকে খেলতে নেবে না। টুশির সঙ্গে বিড়াল ছানার মা পুশিটাও।
রাফিনের দাঁতগুলো সত্যিই সুন্দর। চকচকে, ধবধবে, দুধসাদা। এজন্যই বোধহয় এই দাঁতকে দুধদাঁত বলে। দুধদাঁত বের করে রাফিন খিলখিল হাসে। দাঁতগুলোর ফাঁক দিয়ে তখন বের হয় মিষ্টি গন্ধ। অদ্ভুত সে গন্ধ। পুষি আর টুশিও সে গন্ধ পায়। এজন্য রাফিন হাসলেই বিড়াল দুটি ছুটে আসে লেজ তুলে। রাফিনের পাশে ঘুরঘুর করে। লেজ নাড়িয়ে, গোপ পাকিয়ে রাফিনের হাত পা শুকতে থাকে। মাটিতে তিনবার গড়াগড়ি দিয়ে দেয় এক লাফ। এমনটি বেশি করে টুশি। টুশি ভাবেÑ এর পাশে থাকলে দুধ পাওয়া যাবে। চুকচুক করে খাওয়া যাবে মিষ্টি মধুর দুধ।
টুশিকে নিয়ে পুষিও আছে বিপদে। সারাক্ষণ মায়ের দুপায়ের ফাঁকে মুখ ঢুকিয়ে দুধ খাওয়ার চেষ্টা। আর তার লেজ নিয়ে খেলা। মায়ের লেজটাই তার কাছে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয়। মা যে কতোভাবে লেজটা নাড়ায়। সামনে পিছনে, ডানে বামে, উপরে নিচে। মাঝেমধ্যে লেজটা আবার নাড়ায় ডান থেকে বামে কিংবা বাম থেকে ডানে। টুশি এজন্য মায়ের লেজটা মোটেই ধরতে পারে না। কতো যে চেষ্টা করে টুশি। লাফিয়ে লাফিয়ে লেজটা ধরতে যায়। কামড়ে দিতে চায়। ধারালো নখ দিয়ে আঁচড়ে দিতে চায়। উল্টে পাল্টে চার পা একজায়গায় করে লেজটা ধরতে চায়। কিন্তু পারে না। তখন সে রাগে গরগর করতে থাকে। নিজের লেজ নিজেই কামড়ে ধরে। ব্যথায় ক্যাঁক করে ওঠে টুশি। তারপর দৌড়ে চলে যায় পাশের ঘরে।
ঘরে গিয়ে দেখে রাফিন প্লাস্টিকের পুতুল, বল নিয়ে খেলছে। রাফিনের খেলা দেখে টুশিরও ইচ্ছে হয় পুতুল নিয়ে খেলতে। কিন্তু টুশি ভাবে পুতুলের সাথে খেলা কিসের। ওদের সাথে খেলে পোষায়? ওরা নড়তে চড়তে পারে না। কথা বলতে পারে না। নিজে নিজে খেলতে পারে না। ওর চেয়ে রাফিন ভালো। ও কথা বলে। দৌড়াদৌড়ি, লাফালাফি করে। কেবল দাঁত নেই এই যা সমস্যা। কিন্তু এ সমস্যা মায়ের লেজ ধরে কামড়াতে না পারার চেয়ে বড় সমস্যা নয়। এজন্য টুশি ভয়ে ভয়ে রাফিনের কাছে যায়। বলে, আমাকে খেলতে নেবে? রাফিন এই কথার কোনো জবাব দেয় না। একমনে খেলতে থাকে। টুশি আবারও একই কথা বলে।
এবার মুখ খোলে রাফিন। বলে, তোমরা আমাকে খেলতে নাও না। আমার দাঁত নেই বলে ছোট ভাবো। আমি মোটেও ছোট নেই। আমি এখন একা একা খেলতে পারি। এটা ওটা কামড়ে খেতে পারি। তুমি কি জানো, আমার মা আমাকে বাবা বলে ডাকেন। তাহলে আমি আর ছোট থাকি কি করে। তোমার মুখ ভর্তি দাঁত থাকতে পারে। কিন্তু তুমি কি একবারো ভেবেছো, তোমার দশটা দাঁত সমান আমার একটা দাঁত? আমার মুখে যদি চারটি দাঁত থাকে তাহলে তোমার চল্লিশটি দাঁতের সমান। তোমার মুখে কি চল্লিশটি দাঁত আছে? বাথরুমে যাও। আয়নায় দেখো তোমার মুখে কয়টি দাঁত আছে।
টুশি দাঁত কেলিয়ে তিন লাফে বাথরুমে চলে যায়। একলাফে বালতির কানায় ওঠে। আরেক লাফে বেসিনে উঠে আয়নার দিকে তাকায়। টুশি এর আগে আয়নায় নিজেকে কখনো ভালোভাবে দেখেনি। বাহ! নিজেকে দেখতে বেশতো লাগছে। এমন দুধসাদা আমার গায়ের রং। খাড়া নাক। টানাটানা চোখ। মুখে এত সুন্দর গোঁফ, নাকের পাশে তিল। ছোট ছোট দাঁত। সে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিজেকে দেখতে থাকে। তবে তার চোখ আটকে যায় দাঁতের দিকে। মনে মনে বলে, রাফিন তো ঠিকই বলেছে। আমার দাঁত এতো ছোট ছোট? সত্যিই তো আমার দশটি দাঁত সমান রাফিনের একটি দাঁত। টুশি মন খারাপ করে নিচে নেমে আসে।
গুটি গুটি পায়ে রাফিনের কাছে আসে। লেজ নাড়িয়ে মিউ মিউ ডাকতে থাকে। সামনের পা বাড়িয়ে রাফিনের গা ছুঁতে চায়। কিন্তু ছোঁয় না। পরপর কয়েকবার সে এমন করে। তারপর ভয়ে ভয়ে একসময় রাফিনের গা ছোঁয়। মিউ মিউ ডেকে তার সাথে ভাব জমাতে চায়। কিন্তু রাফিন পাত্তা দেয় না। আনমনে খেলতে থাকে। এমন সময় টুশির মা পুষি আসে। বলে, তুই এখানে। আর আমি তোকে সমস্ত ঘর খুঁজছি। মা, রাফিন আমাকে খেলতে নিচ্ছে না। পুষি বলে, তুমিও তো রাফিনকে খেলতে নাও না। আমি আর এমন করবো না মা। এখন থেকে রাফিনকে আমি খেলতে নিব। চলো রাফিন আমরা এখন একসাথে খেলি?
পুষি ও টুশির কোনো কথা শোনে না রাফিন। একমনে খেলতে থাকে। মাঝেমধ্যে তাদের দিকে আড়চোখে তাকায়। হঠাৎ সে খেলা ফেলে উঠে দাঁড়ায়। বলে, তোমরা আমার দিকে এমন করে তাকিয়ে আছ কেন? তোমরা আমাকে খেলতে নাও না। আমাকে খেলতেও দেবে না? আমার মুখে দাঁত নেই? এটাই আমার অপরাধ? আমি মায়ের কাছে গিয়ে তোমাদের নামে নালিশ দিব। বলবো, তোমরা আমাকে খেলতে দিচ্ছ না। এখন তোমরা যতো খুশি খেল। আমি যাচ্ছি। এই বলে রাফিন খেলার জিনিসপত্র ফেলে চলে যেতে চায়।
পুষি বলে যেও না। খালাম্মার কাছে নালিশ দিও না। এই কথা বলে পুষি ও টুশি রাফিনের দুপায়ে আদর করতে থাকে। আমরা তো বলিনি তোমাকে খেলতে নিব না। আমাদের নিয়ম হচ্ছে কারো মুখ ভর্তি দাঁত না থাকলে আমরা তার সাথে খেলি না। রাফিন বললো, কে বলেছে আমার মুখে দাঁত নেই? আমিতো আগেই বলেছি আমার একটি দাঁত সমান তোমাদের দশটি দাঁত। সেই হিসেবে আমার দাঁত তোমাদের চেয়ে বেশি। তুমি দেখতে চাও, প্রমাণ চাও? পুষি বললো, তাহলে চলো আয়নার সামনে।
পুষি, টুশি ও রাফিন দৌড়ে বাথরুমে যায়। এটা সেটায় উঠে যে যার মতো আয়নার সামনে দাঁড়ায়। টুশি বলে, আমি আগে দেখি। পুষি বলে, আমি দেখি। রাফিন বলে, সরো আমি আগে দেখি। শুরু হলো আয়নায় দাঁত ও মুখ দেখার প্রতিযোগিতা। এখন কে কার দাঁত দেখবে। এই নিয়ে শুরু হলো ঠেলাঠেলি। ঠেলাঠেলি করতে গিয়ে টুশি হঠাৎ পানিভরা বালতিতে পড়ে যায়। মিউ মিউ করে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে থাকে। চার পা দাপিয়ে পানি থেকে ওঠার চেষ্টা করে। টুশিকে বাঁচাতে পুষিও চিৎকার করতে থাকে।
এমন অবস্থা দেখে রাফিন থতমত খেয়ে যায়। ওপর থেকে তাড়াহুড়া করে নিচে নেমে আসে। বালতির মধ্য থেকে টুশিকে টেনে তোলে। টুশিকে ফিরে পেয়ে পুষি আনন্দে লেজ নাড়তে থাকে। মিউ মিউ ডেকে টুশিকে আদর করতে থাকে। টুশির গা চাটতে থাকে। টুশি বলে, মা ভীষণ শীত লাগছে। আমাকে ধরো। রাফিন বলে, চলো রোদে যাই। হ্যাঁ তাই চলো, বলে পুষি। রাফিন টুশিকে কোলে তুলে নেয়। দ্রুত বের হয় বাথরুম থেকে। তারপর তারা তিনজন দৌড়ে চলে যায় উঠানে।
গায়ে রোদ লাগতেই টুশি নড়ে চড়ে ওঠে। রাফিনের কোল থেকে নেমে যেতে চায়। রাফিন বলে, আরে এমন করছো কেন? টুশি বলে, আমাকে নামিয়ে দাও। আমাকে রোদ পোহাতে দাও। টুশি একলাফে রাফিনের কোল থেকে নেমে যায়। ধুলায় কয়েকবার গড়াগড়ি খায়। চার হাত-পা মেলে রোদ পোহাতে থাকে। লেজ দিয়ে গা চুলকাতে থাকে। জিভ দিয়ে গা চাটতে থাকে। একসময় টুশি উঠে রাফিনের কোল ঘেঁষে দাঁড়ায়। বলে, মা আমি সবসময় রাফিনের সাথে খেলব। এই কথা শুনে রাফিন হেসে ওঠে। টুশি বলে মা, আজ থেকে আমরা সব খেলা তিনজন মিলে খেলব। রাফিন মনে মনে বলে, টুশিকে বাঁচিয়েছি বলেই কি তারা আমাকে খেলতে নিচ্ছে?
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০২১
এসআই