ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

ঘুড়ির দেশে ওড়াউড়ি

সুমন মজুমদার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৪১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১২
ঘুড়ির দেশে ওড়াউড়ি

শরতের সাদা নীল আকাশ আছে। পেজা মেঘ আছে আর রঙ-বেরঙের ঘুড়ি নেই দৃশ্যটা মনে হয় বাংলাদেশের জন্য বড্ড বেমানান।

এদেশে এমন একজন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল যিনি একবারের জন্যও নাটাই আর ঘুড়ি হাতে নেন নি। তাইতো এই শহরায়নের ব্যস্ততার চাপেও বড় বড় আকাশছোঁয়া ভবনের ফাঁক দিয়ে এখনো কোনো দুপুরে চোখে পড়বে নিঃসঙ্গ একটা ঘুড়ি। ঘুড়ি যে শুধু এদেশের মানুষের আনন্দের অন্যতম উৎস হয়ে রয়েছে তা কিন্তু নয়। এটি জড়িয়ে আছে আমাদের সংস্কৃতির অনুষঙ্গ হিসেবেও। কিন্তু বন্ধুরা তোমরা কি জানো কিভাবে এলো এই ঘুড়ি? কে-ই বা আবিষ্কার করলো বাতাসে ভেসে থাকা এই মজার জিনিসটি?  

কিভাবে এলো ঘুড়ি
ঘুড়ির ইতিহাস বহু প্রাচীন। সেই অনেক কাল থেকেই মানুষ ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। প্রথমে মানুষ গাছের পাতা দিয়ে ঘুড়ি তৈরি করে তা ওড়াতো মনের আনন্দে। অবশ্য কোন দেশের আকাশে প্রথম ঘুড়ি উড়েছিল তা নিয়ে রয়েছে বিস্তর তর্ক-বিতর্ক। ধারণা করা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার আকাশেই সর্বপ্রথম উড়েছিল ঘুড়ি। সাম্প্রতিক সময়ে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও ভারতে সুতোর আগায় গাছের পাতা বেঁধে তা ঘুড়ির মতো করে উড়ানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে।

ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপেতো এখনো ঐহিত্য অনুসারে পাতার ঘুড়ি ওড়ানো হয়। বলা হয়ে থাকে যে, এক সময় পলিনেশীয় নাবিকদের দ্বারা এই ঘুড়ি এশিয়া থেকে ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য মহাদেশেও। অবশ্য এর আগেও ঘুড়ি আবিষ্কারের দাবি উঠেছিল।

সেই ৪শ’ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিসে প্রথম ঘুড়ি ওড়ানোর দাবি করেন বিজ্ঞানী আরকিয়াতাস। আবার গ্রিসেরও অনেক আগে থেকে সেই ৩ হাজার বছর আগে চীনারা প্রথম ঘুড়ি উড়িয়েছে বলে দাবি করে। তবে যেই এর আবিষ্কারক হোক না কেন নাটাই হাতে পেলে এটি ওড়ানোর মজা এখন বিশ্বজনীন।

ঘুড়ির দুনিয়া
আজকের পৃথিবীতে প্রায় সব দেশেই ঘুড়ি ওড়ানোর প্রচলন রয়েছে। তবে দেশে দেশে ঘুড়ির মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য দেখা যায়। কারণ নানা দেশের মানুষ ঘুড়ির মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করতে চেয়েছে নিজেদের সংস্কৃতি, মিথ এমনকি ধর্মও। চীন, জাপান ও তাইওয়ানে তো ঘুড়ি উড়ানো রীতিমতো জাতীয় উৎসব।

ওই দিন দেশগুলোতে সরকারি ছুটিও ঘোষণা করা হয়ে থাকে। ঘুড়িকে পবিত্রতার প্রতীক মনে করে মালয়েশিয়ার মানুষ। তারা ঘুড়িকে মনে করে ভূত-প্রেতের ওঝা। তাদের বিশ্বাস যে বাড়িতে ঘুড়ি ওড়ানো হয় সে-বাড়ির ধারেকাছে নাকি ভূত বা দুষ্ট জ্বিন আসে না। আবার নিউজিল্যান্ডের অধিবাসীরা দুষ্ট আত্মা তাড়াতে মাওরি নামের এক ধরনের ঘুড়ি ওড়ায়। এই ঘুড়ির মধ্যে থাকে অনেক ছিদ্র। ওই ছিদ্রে বসানো থাকে ধাতব পাত।

উড়বার সময় বাতাস এসে ওই ছিদ্রে ঢুকলে অদ্ভুত শব্দ হয়। আর ওই শব্দেই নাকি দুষ্ট আত্মারা দৌড়ে পালায়। এছাড়া চীন, জাপানে ঘুড়ি এত জনপ্রিয় যে একসময় এর পেছনে দিনের অধিকাংশ সময় নষ্ট করার জন্য ঘুড়ি ওড়ানো সরকারিভাবে নিষিদ্ধই করে দেওয়া হয়। পরে অবশ্য এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।

এখনো চীনা আর জাপানিরা ড্রাগনসহ নানা প্রাগৈতিহাসিক জীবজন্তুর মুখের আদলে রঙ-বেরঙের ঘুড়ি ওড়ায়। আমাদের দেশেও রয়েছে ঘুড়ির আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা। পুরানো ঢাকায় এখনো হাকরাইন নামে ঘুড়ি ওড়ানো উৎসব বিপুল জনপ্রিয়। বাংলাদেশের ঘুড়িগুলোর নামও কিন্তু অদ্ভুত। যেমন:  মদনা, আউক্কা, পতেঙ্গা, চং, সাপা, গোয়া ইত্যাদি। এছাড়া রঙিন কাগজ দিয়েও শিশুরা লাল, নীল, হলুদসহ নানা রঙের ঘুড়ি বানিয়ে থাকে। এখনো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুড়ির সুতায় মাঞ্জা দেওয়া নিয়ে আনন্দ হয়।

কাটাকাটির খেলা
ঘুড়ি ওড়ানোর মধ্যেই খেলা কিন্তু থেমে থাকেনি। এর আসল মজা হলো কাটাকাটির খেলা। অন্যের ঘুড়িকে কেটে দেয়ার আনন্দ উত্তেজনা কেবল ঘুড়িয়ালরাই টের পান। এর জন্য ঘুড়ির সুতায়ও জোর থাকা চাই। ঘুড়ির সুতা ধারালো করতে আমাদের দেশে মাঞ্জা দেওয়া হয়।

সাধারণত ভাতের মাড়, সাগু গোলা, কাচের গুঁড়ার মিশ্রণের মধ্যে সুতাকে ডুবিয়ে রোদে শুকিয়ে ধারালো করা হয়। তারপর সেই মাঞ্জা দেওয়া ধারালো সুতা নিয়ে ঘুড়িয়ালরা নেমে পড়ে তাদের আকাশযুদ্ধ কাটাকাটির মিশনে। একটি ঘুড়ি কাটা পড়লে তার পেছনে ছুটতে শুরু করে ছোট্ট ছেলেরা। মাঠ ঘাট পেরিয়ে ওই কাটা ঘুড়ি হাতে পাওয়ার পরই যেন তাদের সান্ত্বনা।

বন্ধুরা এইতো গেলো ঘুড়ির গল্প। তাহলে এখনই ভাইয়া বা বাবাকে বলো একটা ঘুড়ি বানিয়ে দিতে। তারপর লাগবে শুধু নাটাই আর সুতো। তবে সাবধান ঢাকায় অনেকে ছাদের উপরে ঘুড়ি ওড়ায়। ভুলেও কিন্তু তা করবে না। কারণ অসাবধানতাবশত ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া আরেকটা সাবধানতা অবশ্যই মানবে। ঝড়ের সময় কখনো ঘুড়ি ওড়াবে না। কারণ তখন বিদ্যুৎ চমকায়।

ঘুড়ির ভেজা সুতো বিদ্যুৎ পরিবাহী হওয়ায় তা সরাসরি এসে তোমার উপরেই পড়তে পারে। তার চেয়ে বরং চলে যেও খোলা মাঠে। সেখানে সাদা মেঘের মাঝে দেখবে ঘুড়ি ওড়াতে কী মজা। অথবা বাবা বা ভাইয়ার হাত ধরে যেতে পারো কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে। সেখানে প্রতিবছর ঘুড়ি উৎসব হয়ে থাকে।

সেসময় ওখানে গেলে অবাক না হয়ে পারবে না। সমুদ্রের ধারে সাদা আকাশের কোলে দেখবে ঘুড়ি হয়ে আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে মাছ, সাপ, হাঙর, দৈত্য, ড্রাগন, মৎসকন্যাসহ কতকিছু।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।