মুরগাব (কুয়েত) থেকে: মরুভূমির দেশ কুয়েতে সবুজ শ্যামল বাংলাদেশ রচনা করে চলেছেন সাদিকা ইয়াসমিন রচনা (৪৮)। নিজের মেধা, অক্লান্ত পরিশ্রম আর দেশপ্রেমে উজ্জীবিত বগুড়ার এই মেয়ে এখন আকাশ সংস্কৃতির মাধ্যমে কুয়েতের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছেন বাংলাদেশকে।
প্রবাসীদের নানা অর্জন, সাফল্য, বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতি ও সৌন্দর্য তুলে ধরছেন তিনি। সাদিকা ইয়াসমিন রচনা প্রথম ও একমাত্র নারী যিনি কুয়েতে সরকারি টেলিভিশনে একাধারে অনুষ্ঠান পরিচালক, প্রযোজক ও উপস্থাপক।
আরবি ভাষার ভিড়ে কুয়েতের আকাশে বাংলার আলো ছড়ানো এই নারীকে টেলিভিশনের পর্দায় এক নজর দেখতে মুখিয়ে থাকেন বাংলাদেশি প্রবাসীরা। উপস্থাপনার মুগ্ধতায় খোদ কুয়েতিদের মাঝে নিজেকে জনপ্রিয় করে তুলেছেন তিনি।
শিক্ষকতার পাশাপাশি সংসার সামলিয়ে কীভাবে প্রবাসে, তাও আবার কুয়েতের মতো দেশে টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মাণ ও পরিচালনা সম্ভব?
‘চেষ্টা আর ইচ্ছে থাকলে সবই সম্ভব। আমি আসলে তেমন কিছুই হইনি। আমি মফস্বলের খুব সাধারণ ঘরের মেয়ে। মানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে দেবার যোগ্যতা আমার নেই’- মৃদু হেসে বিনয়ী উত্তর রচনার।
বগুড়ার মহাস্থানগড় এলাকার এক বনেদি পরিবারে জন্ম রচনার। এক ভাই তিন বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি। বাবা ব্যবসায়ী মোস্তফা আল মামুন। বড় চাচা বরেণ্য সাহিত্যিক ড. মুস্তফা নূর-উল ইসলাম। সেজো চাচা সাংবাদিক, লেখক, সম্পাদক ও মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারিত সাড়া জাগানো ‘চরমপত্রের’ কথক এম আর আখতার মুকুল। শৈশব থেকেই পারিবারিক আবহে শিল্প ও সাহিত্যের স্পর্শে বেড়ে ওঠেন রচনা।
সময়টা ১৯৮৪ সাল। প্রকৌশলী স্বামী জামাল মূর্তজা আলীর চাকরির সুবাদে চলে আসেন মরুভূমির দেশ কুয়েতে। সেখানে নিজেকে নিয়োজিত করেন শিক্ষকতা পেশায়।
বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত হয়ে কুয়েতে যান জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল আসহাব্ উদ্দিন। সেখানেই প্রবাসীদের সাথে দূতাবাসের ঘনিষ্ঠতা আর বাংলাদেশি কমিউনিটির মেলবন্ধন ঘটাতে নানামুখী উদ্যোগ নেন তিনি। রাজ পরিবার ও কুয়েত সরকারের উচ্চ পর্যায়ে নিবিড় যোগাযোগ ও আন্তরিক চেষ্টায় কুয়েত রেডিওতে চালু করেন বাংলা অনুষ্ঠান।
স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে সেখানে যোগ দেন রচনা। সম্বল বলতে কেবল মাত্র একটি মাইক্রোফোন। তা দিয়েই মাত করে দেন প্রবাসীদের। বাংলা অনুষ্ঠান পরিচালনার মাধ্যমে সাদিকা ইয়াসমিন রচনা প্রবাসীদের নিয়ে আসেন একটি কেন্দ্রে। ততদিনে নিজের মেধা আর পরিশ্রমে প্রবাসীদের কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছেন বাংলা ভাষার অনুষ্ঠান।
এক পর্যায়ে প্রবাসী জনগণের সাথে কুয়েতিদের সম্পর্ক আরও গভীর করার উদ্দেশ্যে কুয়েত সরকার দেশটির টেলিভিশনে অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্যে আমন্ত্রণ জানায় ১৮টি ভাষাভাষি জাতিগোষ্ঠীকে।
এর মধ্যে প্রাথমিক বাছাইয়ে বাংলা, ইংরেজি, ফারসি, ফিলিপাইন ও উর্দু ভাষাকে নির্বাচন করে কুয়েত সরকার।
শহরের প্রাণকেন্দ্র মুরগাবে তথ্য মন্ত্রণালয়েই কম্পাউন্ডেই রয়েছে কুয়েতের রেডিও ও টেলিভিশন সেন্টার। রেডিও এবং টেলিভিশনে যুক্ত হওয়ার স্মৃতিচারণ করে রচনা বলেন, ‘রেডিও কুয়েতের পরিচালক শেখ সাজন আল সাবাহ আমাকে তাদের টেলিভিশনে বাংলা ভাষায় অনুষ্ঠান নির্মাণে অনুপ্রাণিত করেন। তিনিই সুপারিশ করে আমাকে পাঠান টেলিভিশনের পরিচালক মজিদ আল জেজ্জাফের কাছে। তাদের কাছে প্রোগ্রাম প্রোফাইল জমা দিলাম। শেয়ার করলাম প্রবাসীদের সাথে কুয়েতিদের মেলবন্ধন ঘটাতে পারে এমন সব অনুষ্ঠানের আইডিয়া। টানা দুদিন ধরে চললো চুলচেরা বিশ্লেষণ। দুদিন ধরেই নেওয়া হলো আমার স্বাক্ষাৎকার। এরপর কুয়েত টেলিভিশনে (কেটিভি-২) চূড়ান্ত নিয়োগ দেওয়া হলো আমাকে। এর আগে একটি কথাই বলা হলো আমাকে- ‘সাদিকা দিস ইজ মিডিয়া, নট মার্কেট’।
কুয়েতে সরকারি তত্ত্বাবধানে পরিচালিত পাঁচটি টেলিভিশন চ্যানেল পরিচালিত হয় বলে জানান রচনা।
‘সুপ্রিয় দর্শক এবং আমার বাংলাদেশি ভাই ও বোনেরা। আমি সাদিকা ইয়াসমিন রচনা। আজ আমি আপনাদের সামনা-সামনি। আশা করি আপনারাও আমার সামনে আছেন’ সেই কথাগুলো মনে পড়লে এখনো রোমাঞ্চ অনুভব করি- কুয়েতি টেলিভিশনে প্রথম বাংলা ভাষার অনুষ্ঠানের অনুভূতি জানতে চাইলে এভাবেই তা প্রকাশ করেন রচনা।
দিনটি ছিলো ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি। কুয়েতের আকাশে বাতাসে আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের আবহে শুরু হলো প্রথম বাংলা অনুষ্ঠান। নাম ইনটাচ বিশ্বায়নে বাংলা। তারপর প্রচারিত হতে লাগলো সপ্তাহের প্রতি সোমবার বিকেল ৫টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত- জানান তিনি।
স্বদেশি বাদেও এখানে প্রবাসী কলকাতার মানুষদের কাছে তমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে রচনার অনুষ্ঠান। এতে তুলে ধরা হতো প্রবাসীদের নানা অর্জন আর সাফল্য। শূন্য হাতে কুয়েত এসে নিজেদের মেধা আর পরিশ্রমে আজ যারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন সেসব কৃতি প্রবাসীদের সাফল্যগাঁথা তুলে ধরা হতো ওই অনুষ্ঠানে।
রচনা আরও বলেন, অনুষ্ঠান জনপ্রিয় হবার পর আমাকে বলা হলো আরো অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে। এরপর ‘হালা কুয়েত’ মানে কুয়েতে স্বাগতম অনুষ্ঠানটি শুরুর পর তাও জনপ্রিয় হলো।
অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচারিত হয়। প্রতি রোববার থেকে বৃহস্পতিবার। সন্ধ্যা ৬টা থেকে সাড়ে ৬টা পর্যন্ত। প্রকৃতপক্ষে এসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তুলে ধরা হয় বাংলাদেশের ইমেজ। আমরা তুলে ধরেছি প্রবাসীদের নানা সাফল্য। বোঝাতে চেয়েছি- অভিবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকরা কেবল কুয়েতের রাস্তাই ঝাড়ু দেয় না। কুয়েত বিনির্মাণে আরো অনেক কিছুই করে যাচ্ছেন তারা। মরুভূমির বুকে কৃষি থেকে শুরু করে প্রকৌশল, চিকিৎসাসহ সবখাতেই বাংলাদেশিরা। সেটা জানাতেই এই আয়োজন। এসব অনুষ্ঠান প্রচারের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের প্রতি কুয়েতিদের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা বেড়ে যায়। আমাদের মান্যবর রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল আসহাব্ উদ্দিন অতিথি হয়ে এসেছেন নানা অনুষ্ঠানে। যেখানে তিনি তুলে ধরেছেন দূতাবাসের কর্মকাণ্ডসহ প্রয়োজনীয় নানা তথ্য। এর মাধ্যমে কিন্তু ‘পিপল টু পিপল কানেক্টিভিটি’ বেড়েছে।
তিনি আরও যোগ করেন, ‘হালা কুয়েত’ অনুষ্ঠানের ধারাবাহিকতায় আমি প্রস্তাব পেয়েছি নতুন আরও একটি অনুষ্ঠান পরিচালনার। ‘কেটিভি টু প্রেজেন্ট মাই সেকেন্ড হোম বাংলা’ নামে অনুষ্ঠানটির স্যুটিং চলছে। এখানে তুলে ধরা হবে প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমজীবী মানুষদের কথা। যারা তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে গড়ে তুলছেন কুয়েত।
রচনার স্বামী জামাল মূর্তজা আলী স্থানীয় আহমেদিয়া কনস্ট্রাকশন কোম্পানির কোয়ালিটি কন্ট্রোল ইঞ্জিনিয়ার। দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে মাশরুক মূর্তজা আলী প্রীতিম (২৮) পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছেন যুক্তরাষ্ট্রে। ছোট ছেলে মারজুক মূর্তজা আলী প্রবণ ফিন্যান্সের শিক্ষার্থী। তিনিও পড়ছেন যুক্তরাষ্ট্রে।
তিন দশকের বেশি সময় ধরে কুয়েত প্রবাসী এই নারীর কর্মজীবন শুরু হয় ভোর ছয়টায়। স্কুলের শিক্ষকতা শেষ করেই দৌড়াতে হয় টেলিভিশনে। ক্যামেরার সামনে পেছনে নিজের কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন রচনা। স্যুটিং এর প্রয়োজনে তাকে ছুটে বেড়াতে হয় শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। তিনটি অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা, স্যুটিং, উপস্থাপনা ও সম্পাদনা করে কর্মক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরতে রাত ৮টা/৯টা। পর দিন আবার একই নিয়মে দিন শুরু তার।
তাহলে কি এভাবেই জীবনটা সঁপে দিলেন কর্মের পেছনে?
‘সঁপে দিলাম আর কোথায়? সেই যোগ্যতা আমার থাকলে তো! তবে হ্যাঁ, আমার চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই। এখন দেওয়ার পালা। আমি বিশ্বাস করি। বাংলাদেশ আমাকে জন্ম দিয়েছে। আর কুয়েত আমাকে দিয়েছে প্রতিষ্ঠা। মানুষের জন্যে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে চাই। তাদের কল্যাণের জন্য ভালো কিছু করতে পারলেই তা হবে আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মাধ্যম’- যোগ করেন কুয়েতে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশ রচনা করে যাওয়া কৃতি নারী সাদিকা ইয়াসমিন রচনা।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৫
এমজেএফ/
** গাড়ি নতুন, ফোন পুরনো!
** ‘আঁততে আর বাংলাদেশত যাইতাম মনে ন হ’
** ব্যাডা মাছ, বেডি মাছ!
** ‘ধরা পড়লে রক্ষা নেই, কুয়েত থাকার সুযোগ নেই’
** কুয়েতে একখণ্ড ‘বাংলাদেশ’ বাংলা মার্কেট
** কুয়েতের রাজধানী
** সবার উপর দেশ
** কুয়েতে সবাই এমপি!
** সেই ‘ছোট মানুষটিই’ কুয়েতের বড় ব্যবসায়ী
** কুয়েতের বাতাসে ধ্বনিত হয় বাংলা
** কুয়েতের ডাক্তার আপা
** ‘জীবন যুদ্ধ কইত্যে কইত্যে একটা জায়গায় পৌঁছাইছি’
** কুয়েতে তথ্য প্রযুক্তি খাতে সেনা পাঠাচ্ছে বাংলাদেশ
** আইনে নেই, তবুও বেআইনি চর্চা
** পরিবেশ পেলে বিনিয়োগ যাবে কুয়েত থেকে
** কুয়েতের জন্যে বাংলাদেশের আত্মত্যাগ
** কুয়েত পুনর্গঠনে বাংলাদেশ
** কুয়েতে বাংলাদেশের ‘প্রিন্স’ সহিদ
** হয়রানি ও নাজেহালের শিকার হচ্ছেন প্রবাসীর
** অলিদের বঞ্চনা দেখার কেউ নেই
** শিল্প-সাহিত্যেও পিছিয়ে নেই প্রবাসীরা
** বাংলাদেশিদের কাজের ঠিকানা সুলাইবিয়ার ফল-সবজির বাজারও
** পরিবর্তনের দূত মেজর জেনারেল আসহাব উদ্দিন
** কুয়েতে মানবতার ফেরিওয়ালারা!
** সততা আর নিষ্ঠা থাকলে ঠেকায় কে?
** মরুর বুকে বুকভরা নিঃশ্বাস
** শ্রমিকদের মাথার মুকুট আব্দুর রাজ্জাক
** আরব সাগর থেকে হিমেল বাতাসে ভর করে এলো ছন্দ
** মরুর কুয়েত সবুজ চাদরে ঢাকছেন নাফিস জাহান
** ফেব্রুয়ারিতেই খুলনার মারুফের জীবনে আসছে পূর্ণতা!
** কুয়েতে গুলশান!
** কুয়েতের অ্যাম্বাসেডর!
** জন্ম কুয়েতে, হৃদয় বাংলাদেশের
** সূর্য ওঠার আগেই ঘুম ভাঙে চট্টগ্রামের শাহজাহানের
** ধূসর মরুভূমিতে সবুজ স্বপ্ন!