সুধীবৃন্দ
ক্ষান্ত হোন। আজকের এই সভা সভাপতিহীন।
আপনারা আমার কার্তিকের নবান্ন প্রসূত শুভেচ্ছা লোন। একি আপনারা এদিক-ওদিক মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছেন কেন? এখনো ঠাওরাতে পারেন নাই? আমি আপনাদের ঘরের অন্তরাত্মা বলছি।
আপনারা অনেকে না জানলেও আপনাদের এক বিজ্ঞ বিচারপতি আমার সম্বন্ধে লিখেছিলেন আমার শুধু কাঠামোই নেই, আমার একটা হৃদয়-মন্দিরও আছে (মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান: ১৯৯৮)।
নইলে আমাকে সাক্ষী মানার সময় আপনারা 'এন-শ্রাইন' লিখবেন কেনো ? আর আমার ভেতরে 'মানবজাতির প্রগতিশীল আশা-আকাঙ্খা' আমানত রাখবেনই বা কেন? আশা কি কখনও মরে নাকি? আমি জানি এই ৪৩ বছরে আপনাদের অবহেলায় আমার হৃদয়ের ভেতর অনেক উই পোকা বসত গেড়েছে।
কিন্তু ১৯৭১ এ তো আপানদের মন 'মন্দির-কাবার' মতই সত্য ছিলো। আপনাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল একদা লিখেছিলেন: "মিথ্যা শুনিনি ভাই, এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই। "
প্রিয় বন্ধুগণ, আপনারা আমাতে বসত করেন। একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর শান্তির প্রত্যাশায় ১৯৭২-এর হেমন্তের এক মিষ্টি দিনে আপনারা আমাকে বিনির্মাণ করেছিলেন। আমাকে আপনাদের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চারটি মজবুত খুঁটির উপর সমাসীন করেছিলেন (জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র)। তাই তিনি যখন পরম মমতায় আমার বুকে তার নাম খোদাই করেছিলেন সেটা ছিলো আমার জীবনের সবচেয়ে গর্বের মুহূর্ত। সেই স্মৃতি আমাকে আজও ভালো লাগা দিয়ে যায়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কাকডাকা ভোরবেলা বাংলাদেশের ভবিষ্যতকে বুকে ধারণ করে জাতির জনক যখন টলতে টলতে তার ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির সিঁড়িতে পড়ে গিয়েছিলেন, তার কিছুক্ষণ আগেও তিনি আমার খুঁটিগুলো ছুঁয়ে দেখেছিলেন। সে কথা মনে পড়লে আজও আমি বিদীর্ণ হয়ে যাই ।
প্রিয় মালিকবৃন্দ, আমার বড় দুর্বলতা হলো আমি কাউকে আমার ভেতরে আসতে নিষেধ করতে পারি না। তাই উর্দিপরা লোকজন আমাতে ঢুকে তছনছ করেছে, স্তম্ভ চারটি ধ্বংস করে আমাকে গুড়িয়ে দিয়েছে। নিজেরা ব্যক্তি জীবনে অধর্ম করেও, আমাকে ধর্মের আদল দিতে চেয়েছে। আপনাদেরকে দখল থেকে উচ্ছেদ করে, নিজেদের কথাকে সর্বোচ্চ আইন হিসেবে চালিয়ে দিয়েছে।
অনেক সংগ্রামের পর আপনারা আমার আগের চেহারা ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। শুনতে পাচ্ছি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে আপনারা বাংলার ক্লেদাক্ত জমীন-কে পবিত্র ও শ্বেত-শুভ্র করতে চাচ্ছেন। জাতি হিসেবে আত্ম-উপলব্ধির এ এক পরম উদাহরণ বৈকি! আপনারা আমার অভিনন্দন গ্রহণ করুন।
সুধীবৃন্দ, আপনাদের মধ্যে অনেকে আছেন যারা আমার অস্তিত্ব টের পান না। আমার অস্তিত্ব টের পেতে হলে আমার হৃদয়কে বুঝতে হবে। আর হৃদয় কে বুঝতে হলে একটা ভালো মন থাকা চাই। ক্ষয়িষ্ণু মানুষ ক্ষয় দেখতে পছন্দ করে। আমেরিকার বিচারপতি হ্যান্ড বলেন: "একটা দেশের সংবিধান বাস করে ওই দেশের মানুষের হৃদয়ে। "
এতক্ষণে আপনারা ধরতে পেরেছেন যে আমি আমার প্রকৃত নামটি আর লুকিয়ে রাখতে পারি নাই। আমি আপনাদের দেশের সংবিধান। হাজার কাঁটা-ছেঁড়া হলেও আমার কাছে এসে আপনারা যদি আমার মূল-নকশা দেখেন তবে আপনারা এর সেই প্রকৃত চেতনার গন্ধ পাবেন।
অনেক কথা বলবার ছিল আমার। কিন্তু বেলা পড়ে এলো। শুধু একটা কথা বলি। আপনারা বোধ হয় একমাত্র জাতি যারা তাদের জাতীয় সঙ্গীত কে সাংবিধানিক মর্যাদা দিয়েছেন (অনুচ্ছেদ ৪)। সেই অর্থে আপনাদের জাতীয় সঙ্গীত সাংবিধানিক সঙ্গীতও বটে। এই সঙ্গীত সম্পর্কে হালের দার্শনিক মার্থা ন্যুসবম বলেন (২০১৩): এটা হচ্ছে শক্তিশালী 'পাবলিক ইমোশান'' আর 'কাপাসাস হিউম্যানিজম' -এর বড় উদাহরণ। 'মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি' --এমন দেশপ্রেমের কথা আর কোনো সংগীতে আর কোনো সংবিধানে দেখা যায় না।
অতএব, প্রিয় সুধীবৃন্দ, সামনে ১৬ ডিসেম্বর-এ আপনারা আরেকবার স্নান করে আসুন এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। আরেকবার এই জমিনের মাটি ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করুন- "আমরা যাহাতে স্বাধীন সত্তায় সমৃদ্ধি লাভ করিতে পারি এবং মানবজাতির প্রগতিশীল আশা-আকাঙ্খার সহিত সঙ্গতি রক্ষা করিয়া আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে পূর্ণ ভূমিকা পালন করিতে পারি, সেইজন্য বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তিস্বরূপ এই সংবিধানের প্রাধান্য অক্ষুণ্ন রাখা এবং ইহার রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তাবিধান আমাদের পবিত্র কর্তব্য (প্রস্তাবনা: ৪থ অনুচ্ছেদ )।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। পিএইচডি গবেষক, ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অব ওয়েলিংটন। ইমেইল: billah002@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১৮২৭, নভেম্বর ০৪, ২০১৪