ছাত্রজীবনে ভাবতাম জীবনে একদিনের জন্য হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করবো, দেশবরেণ্য সম্মানীত পন্ডিতদের সাথে ওঠাবসা করব, তাদের পদাংক অনুসরণ করবো। ২০০২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দিয়ে সেই স্বপ্ন পূরণের পর আমার কল্পনার জগতের সাথে বাস্তবের বিস্তর পার্থক্য দেখতে পেলাম।
সত্যিকারের পান্ডিত্য অর্জন করা কিংবা আদর্শস্থানীয় অধ্যাপক হওয়ার জন্য যে ধরনের নিবেদন, পরিশ্রম, বিনিয়োগ ও ধৈর্যের প্রয়োজন হয় তার তুলনায় ছাত্রজীবনের অধ্যাবসায় একদম নস্যি।
জ্ঞানচর্চা, জ্ঞান সৃজন এবং তা বিতরনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় হলো আদর্শ স্থান। আমি যখন মেধাবী, চৌকষ, সৃজনশীল ও দুর্দান্ত ছেলেমেয়েদের পাঠ দান করার জন্য শ্রেণীকক্ষে যাই তখন নিজেকে বড় ভাগ্যবান মনে হয়। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশনার পাঠ চুকিয়ে আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে সফলভাবে পেশাগত জীবনে উত্তরণ হতে দেখে নিজের আনন্দকে আর লুকিয়ে রাখতে পারি না।
অনেকটা ঘোষণার মত করেই মানুষজনকে বলি অমুক জেলায় আমাদের এতজন ছাত্র-ছাত্রী বিচারক পদে কাজ করছে কিংবা ঐ কোম্পানীর আইন কর্মকর্তা পদে আমাদেরই একজন ছাত্র কর্মরত আছে।
দুনিয়া জুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যে র্যাঙ্কিং হয় তার গুরুত্বপুর্ণ কয়েকটি মাপকাঠি হলোঃ নতুন নতুন গবেষণা, নতুন জ্ঞান সৃষ্টি, গ্রাজুয়েটদের কর্মসংস্থানের হার ইত্যাদি। বিশ্ব মানদণ্ডের সাথে নিজেদের তুলনার মহাধৃষ্টতা না দেখিয়েই বলতে চাই আমাদের বিভাগে একাডেমিক কার্যক্রমের নূন্যতম বাধ্যবাধকতা মেনে চলা হয়।
প্রতিষ্ঠাকাল থেকে বিগত ২২ বছরে আইন বিভাগের একাডেমিক এবং নন-একাডেমিক কার্যক্রমের সার্বিক চিত্র চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিভাগের তুলনায় ঈর্ষনীয়। সংখ্যাতত্বের দিক থেকে দেশের BAR এবং BENCH গুলোতে আমাদের অবস্থান উল্লেখযোগ্য।
সামরিক, বেসামরিক ও বাণিজ্যিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আইন শাখায় আমাদের গ্রাজুয়েটরা যোগ্যতার সাথে কাজ করছেন। বিদেশের মাটিতে আমাদের Alumni রা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত আছেন, অনেকেই বিভিন্ন মাধ্যমে কর্মসংস্থান লাভ করেছেন।
দেশে ও বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেকেই যোগ্যতার সাথে অধ্যাপনা করছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আইন পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে এ সকল অর্জন ও প্রাপ্তি আমাকে আপ্লুত করে, শিহরিত করে এবং অনুপ্রেরণা যোগায়।
কিন্তু আমাদের সীমাবদ্ধতাও কম নয়। সমন্বিত গবেষণা কর্ম থেকে আমরা মনে হয় একটু পিছিয়ে আছি। একটি আন্তর্জাতিক মানের বা নিদেনপক্ষে দক্ষিণ এশীয় মানের কনফারেন্স আমরা এখনও আয়োজন করতে পারিনি যা আমাদের পক্ষে খুবই সম্ভব। এশীয় কিংবা সার্ক পর্যায়ে Moot Competition গুলোতে আমরা এখনও উল্লেখযোগ্য সফলতা পাইনি।
বিশ্বের মানসম্মত LAW School গুলোর সাথে আমরা Exchange Programme করতে পারি, এজন্য ত্বরিত উদ্যোগ নিতে পারি। কিংবা পৃথিবীর ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে ডেপুটেশনে পন্ডিত বিশেষজ্ঞদের আমাদের বিভাগে ভিজিটিং ফেলো হিসেবে আনার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে আমরা দেন দরবার করতে পারি। অথচ এই উদ্যোগগুলো আমরা এখনও নিতে পারিনি। আইন বিভাগে এখন পর্যন্ত কোনো Career/Job Fair করা যায়নি।
আমাদের বিভাগে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বিগত ২২ বছরে একটাও Research and Teaching Training Programme হয়নি। অবশ্য এটি আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার একটি অন্যতম সাধারণ সমস্যা। কোনো প্রকার পেশাগত বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ ও ওরিয়েন্টেশন ছাড়াই শিক্ষকদের পেশায় প্রবেশের ফলে সার্বিক performance এর ক্ষেত্রে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সুযোগ থেকে যায়। যে কোনো পেশার উৎকর্ষতা তথা মানব সম্পদ উন্নয়নের জন্য প্রাথমিক উপাদান হলো নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও মূল্যায়ন। এই ধরণের উদ্যোগগুলো গ্রহণ করলে আমাদের অনুষদ, বিশ্ববিদ্যালয় তথা দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে।
আরেকটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো চ.বি. এলএল.এম. অ্যাসোসিয়েশান নাম ধারন করে দেশে-বিদেশে কয়েকটি গ্রুপ বর্তমানে সক্রিয় আছে। এভাবে বিভিন্ন দলে বিভক্ত না হয়ে আইন বিভাগের আইন সমিতির উদ্যোগে আমরা সকলেই একটা এলামনাই প্লাটফর্মে আসতে পারতাম। অতীতে এই ধরনের একটি উদ্যোগ নেয়া হলেও এর দুখজনক অপমৃত্যু হয়েছে। বর্তমানে আবার এরকম একটি উদ্যোগ আরম্ভ হয়েছে যা খুবই সময়োচিত।
বর্তমানে চ.বি. আইন সমিতিও নিষ্ক্রিয় রয়েছে। অন্যরা পারলে আমরাও কেনো পারবোনা? আমাদের অনুষদের বরিষ্ঠ শিক্ষক আইন কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছেন, আমাদের একজন সম্মানীত শিক্ষক জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের সদস্য হয়েছেন, আমাদের অধ্যাপকগণ নামকরা প্রতিষ্ঠান থেকে পিএইচডি করেছেন এবং করছেন। আমাদেরই অধ্যাপকগণ আন্তর্জাতিক সংস্থায় কনসাল্টেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন। তাদের কারো কারো বই নামকরা প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এসবই আমাদের অর্জন-আইন পরিবারের গর্ব। আমরা চাইলে এসব অর্জনকে আরো সমৃদ্ধ করতে পারি, আরো অনেক দূর যাওয়ার সক্ষমতা আছে আমাদের।
স্বপ্ন দেখতে পয়সা লাগে না, কাউকে জবাবদিহি করতে হয় না। আমি আমার স্বপ্ন পাখির ডানা পুরোপুরি মেলে দিতে চাই। আমি মন খুলে আমার ভাবনাগুলো প্রকাশ করতে চাই, আগামী ত্রিশ বছরের মধ্যে আমাদের আইন পরিবার কি কি অর্জন করতে পারে আমি তার একটি উইশ লিস্ট (Wish List) বর্ণনা করতে চাই।
আমি স্বপ্ন দেখি আমাদের গ্রাজুয়েটরা WTO, ILO, WIPO, European Union, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে Intern হিসেবে সরাসরি রিক্রুট হচ্ছে। ভারতের বিখ্যাত বিজনেস স্কুল Indian Institute of Management (IIM) এবং Delhi School of Business (DSB) -এ প্রতি বছর বিশ্বের খ্যাতনামা কোম্পানী ও প্রতিষ্ঠানসমুহ গ্রাজুয়েট সার্চ করতে যায়। ২০০৯ সালে এই দুটো প্রতিষ্ঠান থেকে ১০০% গ্রাজুয়েট রিক্রুট হয়েছে এবং তাদের গড় বাৎসরিক বেতন ছিল ৮০ লক্ষ রুপী। আমি পরিষ্কার দিব্য চোখে দেখতে পাচ্ছি, নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশের চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো এবং নামকরা আইনী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিজস্ব উদ্যোগ ও ব্যাবস্থাপনায় আমাদের আইন অনুষদের ক্যাম্পাসে চাকরি মেলার আয়োজন করছে আর আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে উঁচু বেতনে নিয়োগ দিচ্ছে।
পাশ করে আমাদের কোনো ছাত্র-ছাত্রী একদিনের জন্যও বেকার থাকবে না। আমি অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এবং আমার বিশ্বাসের যথেষ্ঠ ভিত্তি আছে। world ranking-এ ৫০ এর ভিতরে আছে এমন ল’ স্কুলগুলোতে আমাদের সম্মানীত ফ্যাকাল্টিগণ ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে নিয়মিত আসা-যাওয়া করবেন। আমাদের একাডেমিক জার্নালে আইনের জগতে সর্বশেষ ও সাম্প্রতিক findings নিয়ে সারা বিশ্বের নেতৃস্থানীয় Legal scholars গণ তাদের মহামূল্যবান গবেষণাকর্ম প্রকাশ করবেন। চ.বি. Law School হবে দক্ষিণ এশিয়ার নেতৃস্থানীয় শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান। Bangalore National Law School, Delhi Law School, Kathmandu Law School, Indian Institute of Management, Lahore School of Management Science (LAMS) - এ সকল প্রতিষ্ঠানের সাথে আমাদের আইন অনুষদের নাম ও উচ্চারিত হবে।
জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার উদ্যোগে যে সকল আন্তর্জাতিক চুক্তি, ট্রিটি, কনভেনশন বা চার্টার গৃহীত হয় এসবের ড্রাফটিং প্রক্রিয়াতে আমরাও অংশগ্রহণ করব। আমি স্বপ্ন দেখি আন্তর্জাতিক বিরোধ সমূহের নিষ্পত্তি এবং আন্তর্জাতিক আইনের বিকাশে আমরাও অবদান রাখছি। Hague International Law Academy, Netherlands কিংবা Aslo Peace Centre এর মতো অনুরূপ বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান আমাদের এখানে গড়ে উঠবে।
যে যাই মনে করুক বা বলুক, আমি মনের গহীন কোনে এই স্বপ্ন প্রতিনিয়ত দেখি। আমার একান্ত বিশ্বাস, আমার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে-প্রত্যাশিত কিংবা অপ্রত্যাশিত পন্থায়। “মানুষ যা ভাবতে পারে, যা বিশ্বাস করতে পারে, তা অর্জন করতে পারে”। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের আইন পরিবারের এইসব সম্ভাবনা ও তা অর্জনের সামর্থ্য আছে।
লেখকঃ সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫০ ঘন্টা, নভেম্বর ০৮, ২০১৪