দরিদ্র বিচারপ্রার্থীদের সরকারি খরচে আইনগত সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে সরকার ২০০০ সালে আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০ নামে একটি আইন প্রণয়ন করে।
এই আইনের আওতায় সরকার জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা প্রতিষ্ঠা ও এ সংস্থার অধীনে প্রত্যেক জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে লিগ্যাল এইড অফিসের মাধ্যমে আর্থিকভাবে অসচ্ছল, সহায় সম্বলহীন এবং আর্থ-সামাজিক কারণে বিচার পেতে অসমর্থ্য বিচারপ্রার্থী জনগণকে সরকারি খরচে আইনগত সহায়তা প্রদান করছে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান ও আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।
এছাড়া সংবিধানের ৩১ ও ৩৩ নম্বর অনুচ্ছেদে ন্যায়বিচার ও সার্বজনীন মানবাধিকারের কথা যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়েছে।
১৯৪৮ সালের ‘সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের’ অনুচ্ছেদ ৭-এ কোনো ধরনের বৈষম্য ছাড়া আইনি প্রতিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে সমান অধিকারের ব্যাপারে উল্লেখ রয়েছে। আর অনুচ্ছেদ ৯-এ কোনো ব্যক্তিকে নির্বিচারে আটক না রাখার নির্দেশনা রয়েছে। এসব কথা অর্থবহ করে তুলে এর সফল বাস্তবায়নের
উদ্দেশে মূলত আইনগত সহায়তা কার্যক্রম চালু হয়েছে। সরকারি আইনি সেবাসমূহের মধ্যে রয়েছে:
১। আইনগত পরামর্শ প্রদান। ২। মামলা পরিচালনার জন্য আইনজীবী নিয়োগ। ৩। আইনজীবীর ফি পরিশোধ। ৪। বিনামূল্যে ওকালতনামা সরবরাহ। ৫।
সালিশকারির সম্মানী পরিশোধ। ৬। বিনামূল্যে রায় বা আদেশের অনুলিপি সরবরাহ। ৭। ফৌজদারি মামলায় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের ব্যয় পরিশোধ। ৮। মামলার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রাসঙ্গিক সকল ব্যয় পরিশোধ।
মহৎ উদ্দেশে লিগ্যাল এইড কার্যক্রম চালু হলেও এই কার্যক্রম কতটুকু সফল হয়েছে, তা আলোচনার দাবি রাখে। ২০০০ সালের এ আইনগত সহায়তা প্রদান আইনে কোন ব্যক্তি এই আইনের অধীনে আইনগত সহায়তা পাবেন সে বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। এই সমস্যা সমাধানে ২০০১ সালের আইনগত সহায়তা প্রদান নীতিমালায় আইনগত সহায়তা পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তিদের সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে কিন্তু এতে সমস্যার খুব একটা সমাধান হয়নি।
নীতিমালা ২-এর ব্যাখ্যায় ‘অসচ্ছল বা আর্থিকভাবে অসচ্ছল ব্যক্তি’ বলতে বোঝানো হয়েছে এমন ব্যক্তিকে যার বার্ষিক গড় আয় ৩০০০ টাকার উর্ধ্বে নয় অর্থাৎ যার মাসিক আয় ২৫০ টাকার বেশি নয় তিনি আইনগত সহায়তার জন্য আবেদন করতে পারবেন।
একটু লক্ষ্য করলে দেখতে পাব, বর্তমানে একজন ভিক্ষুকেরও আয় মাসে ২৫০ টাকার বেশি। তাহলে কি বলা যায় যে, এই সহায়তা পাওয়ার মতো কোনো অসচ্ছল ব্যক্তি নেই?
দ্বিতীয়ত, পর্যাপ্ত প্রচারের ব্যবস্থা না থাকায় এই কার্যক্রম সম্পর্কে গ্রামের অসচ্ছল, দরিদ্র মানুষ খুবই কম জানেন।
তৃতীয়ত, আইনে বর্ণিত আইনগত সহায়তা পাওয়ার জন্য যে আবেদন প্রক্রিয়া, তা খুবই জটিল। যা সাধারণ দরিদ্রদের পক্ষে বোঝা কষ্টসাধ্য।
চতুর্থত, যারা জাতীয় কিংবা জেলা পর্যায়ে কমিটি পরিচালনাকারী, তারা উঁচুতলার লোক, তারা গরিবদের প্রকৃত অবস্থা বুঝতে প্রায়শই অক্ষম।
প্রার্থীরা আবেদন করার পর আবেদনপত্র গ্রহণ কিংবা বাতিল করার এখতিয়ার একান্তই কমিটির। ফলে অনেক সময় স্বজনপ্রীতির ঘটনা ঘটে। শুধু তাই নয়, প্যানেল আইনজীবীদের ফি কম থাকায় ভালো সিনিয়র আইনজীবী মামলা পরিচালনার কাজে আসতে চান না। ফলে গরিবের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না।
সরকারি হিসেবে, ২০০৯ সালের পূর্বে সরকারি আইন সহায়তা তহবিলের ব্যয় ১০ শতাংশের কম ছিল, যা ২০০৯ সালে বৃদ্ধি পেয়ে ৭২ শতাংশ, ২০১০ সালে ৮৬ শতাংশ, ২০১১ সালে ৯৮ শতাংশ, ২০১২ ও ২০১৩ সালে শতভাগ এবং সর্বশেষ ২০১৪ সালে এ তহবিলের ব্যয় শতভাগে উন্নীত হয়েছে।
কিন্তু পত্রপত্রিকার বিভিন্ন সময়ের প্রতিবেদনে তহবিলের টাকা পুরোপুরি ব্যবহার না হওয়ায় ফেরত যাওয়ার খবর দেখতে পেয়েছি। আবার স্বজনপ্রীতির কারণে অনেকের অবৈধভাবে সুবিধা নেওয়ার অভিযোগও ঢের শোনা যায়। আইনগত সহায়তা প্রদান (সংশোধন) আইন, ২০১৩ পাসের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্ট, শ্রম আদালত ও চৌকি আদালতে লিগ্যাল এইড কমিটি গঠনের বিধান, জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারকে এডিআর ক্ষমতা প্রদান ইত্যাদি বিষয় সন্নিবেশিত করা হলেও এই আইনের আরও অর্থবহ সংশোধনী আনা সময়ের দাবি।
যদিও লিগ্যাল এইড সার্ভিস প্রসারের জন্য বর্তমান সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম যেমন ওয়েবসাইট উন্মুক্ত করা, হট লাইন সার্ভিস চালু করা ইত্যাদি বিষয় প্রশংসার দাবি রাখে, তবুও আইনগত সহায়তা কার্যক্রমের যারা টার্গেট সেই দুস্থ, অসহায় বা গরিবদের উৎসাহিত করতে আরও প্রচারের ব্যবস্থা জরুরি।
একটি দেশের নাগরিকদের জন্য আশ্রয় লাভের অধিকার নিশ্চিত করা এবং মৌলিক অধিকার জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ‘আইনগত সহায়তা’ কাজ করে।
উন্নত দেশ যেমন যুক্তরাজ্য, কানাডা অনেক আগেই লিগ্যাল এইড সার্ভিস চালু করেছে। সুতরাং সংবিধানের প্রস্তাবনা অনুসারে শোষণ-বঞ্চনামুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় আইনগত সহায়তা প্রদান আইনকে যথাযথ সংশোধনী এনে এবং লিগ্যাল এইড কমিটির জবাবদিহিতা করে এ কার্যক্রম জোরদার করা জরুরি।
মো. নাহিদ হোসেন, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সৌজন্যে: আইন ও সালিশ কেন্দ্র।
বাংলাদেশ সময়: ১২২৫ ঘণ্টা, মে ২৩, ২০১৫
এসআই