ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আইন ও আদালত

চার শিশু হত্যার রায়ে অসন্তুষ্ট আইনজীবীরাও

নাসির উদ্দিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১১ ঘণ্টা, জুলাই ২৬, ২০১৭
চার শিশু হত্যার রায়ে অসন্তুষ্ট আইনজীবীরাও রায়ে অসন্তুষ্ট আইনজীবীরা। ছবি: আবু বকর

সিলেট: হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার সুন্দ্রাটিকি গ্রামের ৪ শিশু হত্যা মামলার রায়ে প্রধান আসামি পঞ্চায়েত প্রধান আব্দুল আলী বাগালসহ তিন আসামি খালাস পাওয়ায় ও দু’জনের  কম সাজা হওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন আইনজীবীরা। রায়ে সন্তুষ্ট নন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীও।

তাদের মতে, চার শিশু হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী আব্দুল আলী বাগাল এবং সংশ্লিষ্ট ছিলেন সকল আসামিই। তাই সকলেরই ফাঁসি হওয়া উচিত ছিলো।

অথচ তিনজনের ফাঁসি হলেও মূল পরিকল্পনাকারীই খালাস পেয়েছেন।

বুধবার (২৬ জুলাই) চার শিশু হত্যার দায়ে তিনজনকে মৃত্যুদণ্ড ও দু’জনকে সাত বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন সিলেট বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মকবুল আহসান। ৮ আসামির মধ্যে প্রধান আসামি পঞ্চায়েত প্রধান আব্দুল আলী বাগালসহ (৬০) বাকি তিনজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- আব্দুল আলী বাগালের ছেলে রুবেল মিয়া (১৮), বাগালের প্রধান সহযোগী (সেকেন্ড ইন কমান্ড) হাবিবুর রহমান আরজু (৪০) এবং উস্তার মিয়া (৪৮)। তাদের মধ্যে উস্তার পলাতক। বাকি দু’জন কারাগারে রয়েছেন।

সাত বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- বাগালের আরেক ছেলে জুয়েল মিয়া ও সহযোগী শাহেদ আহমদ (৩২)। পাশাপাশি তাদের দু’জনকে ৫ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরো ৬ মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
 
অপরাধ সন্দেহজনকভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় বেকসুর খালাস পাওয়া বাকি দু’জন হলেন- পলাতক বাবুল মিয়া (৪৫) ও বিল্লাল মিয়া (৩৫)।

চাঞ্চল্যকর এ মামলার রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে ট্রাইব্যুনালের পিপি অ্যাডভোকেট কিশোর কুমার কর বাংলানিউজকে বলেন, ‘এ মামলার রায়ে সকল আসামির ফাঁসি হওয়া উচিত ছিলো। যেহেতু বাদী এজাহারে কারো নাম উল্লেখ করেননি। চার আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উঠে আসে হত্যাকাণ্ডে মূল পরিকল্পনাকারীসহ অন্যদের নাম’।  

দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা।  ছবি: আবু বকর৪ শিশুকে আসামিরা শান্ত মাথায় খুন করেন উল্লেখ করে সিলেটের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ বলেন, ঘটনার এক মাস আগের পরিকল্পনা অনুসারে শিশুদেরকে হত্যা করা হয়েছে। রায়ে কিছুটা সন্তোষ প্রকাশ করলেও পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাওয়ার পর দেখে-শুনে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন তারা।

সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ লালা বাংলানিউজকে বলেন, চার আসামি নিজেদের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন, পরিকল্পনাকারীর নাম বলেছেন। অথচ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়া তিনজনের ফাঁসি হলো, একজনের হলো না। আবার মূল আসামিও খালাস পেলেন!

এ মামলার প্রেক্ষিতে সকলের ফাঁসি না হওয়ায় তিনি নিজেও মর্মাহত। কেননা, বাদী মামলায় উল্লেখ করেননি যে, কে হত্যা করেছেন। তদন্তকালে ও ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে আসামিরাই সকলের জড়িত থাকার কথা বলেছেন।

সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘এ রায়ে বাদীপক্ষের পুরোপুরি সন্তুষ্ট হওয়ার কথা নয়। কারণ, ৪ শিশু হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী আব্দুল আলী বাগাল খালাস পাওয়ায় উদ্বেগ রয়েই গেলো’।

এ মামলার সকল আসামির ফাঁসি চেয়ে বাদীপক্ষের আইনজীবীকে উচ্চ আদালতে আপিলেরও পরামর্শ দেন অ্যাডভোকেট লালা ও অ্যাডভোকেট শহিদুল।

এ মামলার মোট ৯ আসামির একজন বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন ৫ জন এবং পলাতক ৩ জন।
গ্রেফতারকৃতদের কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। রায়ের পরে সাজা পরোয়ানা দিয়ে ফের তাদেরকে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

গত বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি বিকেলে বাড়ির পাশের মাঠে খেলতে গিয়ে নিখোঁজ হয় সুন্দ্রাটিকি গ্রামের চার শিশু আবদাল মিয়ার ছেলে মনির মিয়া (৭), ওয়াহিদ মিয়ার ছেলে জাকারিয়া আহমেদ শুভ (৮), আব্দুল আজিজের ছেলে তাজেল মিয়া (১০) ও আব্দুল কাদিরের ছেলে ইসমাইল হোসেন (১০)। নিহত ইসমাইল সুন্দ্রাটিকি মাদ্রাসা ও অন্য তিন শিশু সুন্দ্রাটিকি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল।

নিখোঁজের পাঁচদিন পর স্থানীয় ইছাবিল থেকে বালিচাপা দেওয়া অবস্থায় তাদের মরদেহ উদ্ধার করা হলে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ঘটনার পর চারজনকে আটক করে পুলিশ। পরে বাহুবল থানায় ওই চারজনসহ মোট নয়জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন নিহত শিশু মনিরের বাবা আবদাল মিয়া।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তৎকালীন পরিদর্শক (ওসি) মোক্তাদির হোসেন গত বছরের ২৯ এপ্রিল নয়জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেন। এ মামলায় গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান আব্দুল আলী বাগাল ও তার দুই ছেলেসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাদের মধ্যে আসামি বাচ্চু মিয়া র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।

সুন্দ্রাটিকি গ্রামের দুই পঞ্চায়েত আবদাল মিয়া তালুকদার ও আব্দুল আলী বাগালের মধ্যে পারিবারিক বিরোধের জের ধরে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে তদন্তকালে ও আসামিদের দেওয়া স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে নিশ্চিত হয় পুলিশ।

গ্রেফতারকৃত পাঁচজনের মধ্যে চারজন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

হবিগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে গত বছরের ০৭ সেপ্টেম্বর অভিযোগ (চার্জ) গঠনের মধ্য দিয়ে মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। গত ১৫ মার্চ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আদেশে মামলাটি সিলেট বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়।

এ মামলায় ৫৭ জন সাক্ষীর মধ্যে হবিগঞ্জের আদালত ৪৫ জনের ও ট্রাইব্যুনাল ০৭ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেছেন।

উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) উপস্থাপন শেষে গত ২০ জুলাই রায়ের দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল।

বাংলাদেশ সময়: ১৮০৭ ঘণ্টা, জুলাই ২৬, ২০১৭
এনইউ/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।