সিলেটের গোয়াইনঘাট এলাকায় জমির মালিকানা নিয়ে বিরোধের জের ধরে ৬২ বছর (১৯৫৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর) আগে সংশ্লিষ্ট মুনসেফ আদালতে একটি বাটোয়ারা মামলা (নম্বর ৩৯৭/৫৮) করেন আসিরুননেসা। বিচারিক আদালতে বাদীর পক্ষে প্রথম রায় হয় ১৯৬২ সালের ২৩ আগস্ট।
১৯৮৯ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট এক রায়ে অধস্তন আদালতের ওই রায়টি আংশিক সংশোধন করে বাদী আসিরুননেসার পক্ষে রায় দেয়। একই সঙ্গে বাদী ডিক্রি পাওয়ার পর বিরোধীয় জমির মালিকানার কে কোন অংশ পাবে এটি নির্ধারণ করতে ১৯৯৪ সালে অ্যাডভোকেট কমিশনার নিয়োগ দেয়। ২০০০ সালের ২৪ এপ্রিল অ্যাডভোকেট কমিশনার সংশ্লিষ্ট অধস্তন আদালতে প্রতিবেদন দেওয়ার পর এটি মঞ্জুর করে বাদীর পক্ষে চূড়ান্ত ডিক্রি জারি হয় একই বছরের ১৪ ডিসেম্বর।
ওই প্রতিবেদন নিয়ে বিবাদী আপত্তি তুলে ২০০০ সালে জেলা জজ আদালতে আপিল করলে ২০০১ সালের ১৪ আগস্ট সেই আপিল খারিজ হয়ে যায়। এ আদেশের বিরুদ্ধে বিবাদীপক্ষ ২০০১ সালে হাইকোর্টে সিভিল রিভিশন আবেদন করে। ২০১৫ সালের ৬ ডিসেম্বর এ মামলা নিয়ে বিচারিক আদালতের সব সিদ্ধান্ত বাতিল করে নতুন করে অ্যাডভোকেট কমিশনার নিয়োগের নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। পরে হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে বাদীপক্ষ ২০১৬ সালে আপিল বিভাগে সিভিল লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করলে ২০১৭ সালের ৮ অক্টোবর লিভ টু আপিল গ্রহণ করে নিয়মিত আপিলের অনুমতি দেয় আপিল বিভাগ।
এ মামলায় সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা জানান, মামলাটি সর্বোচ্চ আদালতে শুনানির পর্যায়ে রয়েছে। ১৯ বছর আগে বাদী আসিরুননেসা মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না দেখেই মারা গেছেন। এখন মামলার বাদী তার মেয়ে হামিদা খাতুন (৭০) মামলার শেষ দেখতে আদালতে ঘুরছেন। দীর্ঘদিন আগে মারা গেছেন প্রথম বিবাদী আবদুল জলিল। তিনিও মামলার শেষ দেখে যেতে পারেননি। মামলা চালাচ্ছেন অন্যান্য বিবাদী। মামলা পরিচালনায় নিযুক্ত একাধিক আইনজীবীও ইতিমধ্যে মারা গেছেন। তারাও মামলার নিষ্পত্তি করে যেতে পারেননি।
এভাবে দিন, মাস, বছর, যুগ পার হয় কিন্তু শেষ হয় না জমির মালিকানা ও বিরোধসংক্রান্ত দেওয়ানি মামলা। অনেক ক্ষেত্রে মামলা হলেও এর চূড়ান্ত ফল দেখে যেতে পারেন না বাদী কিংবা বিবাদী। মামলা চলে বংশ পরম্পরায়। সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা বলছেন, মামলার আরজি প্রস্তুত, শুনানির জন্য নোটিস জারি, বিবাদীর জবাব দাখিল ও গ্রহণে বিলম্ব, ঘন ঘন শুনানি মুলতবির আবেদন ও তা মঞ্জুর, বিচারক ও এজলাস স্বল্পতা, জুডিশিয়াল পলিসি ও দেওয়ানি আইনের সংস্কার না হওয়াসহ নানা জটিলতায় দেওয়ানি মামলার নিষ্পত্তি হয় ধীরলয়ে। এতে বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। অনেকে আর্থিকভাবে হচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্ত। মামলার খরচ জোগাতে গিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন অনেকে। আইনজীবীদের মতে, দেশে দেওয়ানি মামলার বিচার ব্যবস্থার পদ্ধতি এখনো যুগোপযোগী হয়নি। একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে ১৯০৮ সালের দেওয়ানি কার্যবিধি মামলা পরিচালনার অনুপযোগী। এ আইনের প্রয়োগ পদ্ধতিও আধুনিক নয়। আদালতের বাইরে বিকল্প পদ্ধতিতে মামলা নিষ্পত্তির উদ্যোগও উল্লেখ করার মতো নয়। যে কারণে মামলা নিষ্পত্তিতে এর প্রভাব পড়ছে। বিচারিক আদালত হয়ে উচ্চ আদালত পর্যন্ত জমিসংক্রান্ত মামলা ১০ বছরের মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে এমন নজির খুব বেশি নেই। কোনো কোনো মামলায় ২৫ বছর পর্যন্ত সময় পেরিয়ে যায়।
প্রবীণ আইনজীবী ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিচারপ্রার্থী সংবিধান অনুযায়ী ন্যায়বিচার ও দ্রুত বিচার পাচ্ছে কি না এর মাধ্যমে একটি দেশের উন্নয়ন, সভ্যতার অন্যতম মানদন্ড নির্ধারণ হয়। দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছি, যেভাবে এবং যে পদ্ধতিতে বিচারব্যবস্থা চলছে তা দিয়ে এ বিশাল মামলাজট নিরসন ও বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি লাঘব হবে না। ’
তিনি আরও বলেন, ‘পৃথিবীর অনেক দেশ মামলার চাপ কমাতে বিকল্প পদ্ধতির দিকে ঝুঁকছে। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি বা এডিআর ব্যবস্থা সে ধরনের একটি পদ্ধতি। দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে এটি বেশি প্রয়োগ করা যায়। স্থানীয়ভাবে জমিসংক্রান্ত বিরোধের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি একটি উত্তমপন্থা হিসেবে কাজ করবে। অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের সমন্বয়ে স্থানীয়ভাবে জমিসংক্রান্ত বিরোধগুলো সেখানেই মিটিয়ে আনা সম্ভব। এটি হলে অনেককেই মামলা করতে আদালতে আসতে হবে না। ’
শফিক আহমেদ বলেন, ‘বিচারকালীন ঘন ঘন শুনানি মুলতবির আবেদন ও তা মঞ্জুর বিচারের অন্তরায়। একবার শুনানি শুরু হলে কোনো মুলতবি ছাড়াই মামলা নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিলে বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ কমবে। ’
গত মধ্য জুলাইতে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের দেওয়া পরিসংখ্যান ও বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, দেশে উচ্চ ও বিচারিক আদালতে ৩৭ লাখ দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা বিচারাধীন। বিচারিক আদালতে প্রায় ৩২ লাখ ফৌজদারি ও ১৪ লাখের কাছাকাছি দেওয়ানি মামলা বিচারাধীন। যার বেশিরভাগই জমি কিংবা ভূমিসংক্রান্ত মামলা। উচ্চ ও অধস্তন আদালত মিলিয়ে বিচারাধীন দেওয়ানি মামলার সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ১৫ হাজার ৫৩৩টি দেওয়ানি মামলা বিচারাধীন। হাইকোর্ট বিভাগে বিচারাধীন দেওয়ানি মামলার সংখ্যা প্রায় ১ লাখ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শুধু ঢাকা জেলার বিভিন্ন দেওয়ানি আদালতে ১ লাখ ১৩ হাজার মামলা বিচারাধীন। যার বেশিরভাগ মামলাই জমির মালিকানা নিয়ে বিরোধসংক্রান্ত। এর মধ্যে জেলা জজ আদালতে বিচারাধীন প্রায় ৯৭ হাজার মামলা। নিষ্পত্তির হার উল্লেখযোগ্য না হলেও দেশে প্রতিটি জেলায় আদালতগুলোতে প্রতিদিন নতুন নতুন মামলা যুক্ত হচ্ছে।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘আসলে মামলার জট আদালতে নিষ্পত্তির ধীরগতির কারণে হয় না। এর জন্য দায়ী মামলার কারণ। মামলার কারণ উদ্ভবের জন্যই আদালতে মামলা আসে। আদালতের চাপ বাড়ে। নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হয়। ’ তিনি আরও বলেন, ‘মামলা কেন হয়, এর কারণ খুঁজে বের করে ওই কারণগুলো কমাতে হবে। প্রশাসন থেকে শুরু করে পুলিশ সবাই যদি তাদের দায়িত্বটুকু সঠিকভাবে পালন করে তাহলে মামলার কারণ ও মামলার চাপ কমবে। ’
সিলেটের গোয়াইনঘাটের ওই মামলায় উচ্চ আদালতে বাদীপক্ষের আইনজীবী চঞ্চল কুমার বিশ্বাস দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আদালতে দেওয়ানি মামলার পরিস্থিতি কী তা এই একটি মামলা দিয়েই বোঝানো যায়। আসলে এ ধরনের মামলায় একপক্ষ সবসময় দখলে থাকে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা প্রভাবশালী। যারা দখলে থাকে তারা দখলের এ সুবিধা নিতে মামলা দীর্ঘায়িত করতে সবসময় সচেষ্ট থাকে। সাধারণত দুর্বলপক্ষই আদালতের শরণাপন্ন হয়। বিচারপদ্ধতি ও অন্যান্য কারণ মিলিয়ে স্বভাবতই বিচারে দীর্ঘসূত্রতা বাড়ে। ’
১৯০৮ সালের দেওয়ানি কার্যবিধি গতানুগতিক করা উচিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘দেওয়ানি মামলায় একটি বিধান রয়েছে যে, সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হওয়ার আগে তিনবার সময় নেওয়া যায়। আবার সাক্ষ্য শুরু হলে ফের তিনবার সময় নেওয়া যায়। কিন্তু আইনে স্পষ্টভাবে বলা নেই যে, তিনবারের বেশি সময় নিলে কী হবে। এ ক্ষেত্রে বাদী তিনবারের বেশি সময় নিলে তার মামলা খারিজ হবে কিংবা বিবাদী তিনবারের বেশি সময় নিলে বাদীর পক্ষে চূড়ান্তভাবে একতরফা ডিক্রি হবে আর একবার যদি কারও মামলা খারিজ হয় কিংবা একতরফা ডিক্রি হয় তাহলে সংশ্লিষ্ট পক্ষ একবার শুধু আপিলের সুযোগ পাবে এরকম বিধান থাকলে সুফল পাওয়া যাবে। ’
জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘উচ্চ আদালতে দেওয়ানি মামলা খুব ধীরগতিতে হচ্ছে, এটি সত্যি। যদিও মামলা নিষ্পত্তির জন্য বেঞ্চ বাড়ানো হয়েছে। তবে বেঞ্চ আরও বাড়াতে হবে। নিম্ন আদালতেও একই অবস্থা। নথিপত্র যাচাই, সমন জারিসহ সবকিছুতে সময় বেশি লাগছে। আর এ সময়ে কভিড পরিস্থিতির কারণে আরও বেশি সময় লাগছে। ’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি মনে করি এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য দেওয়ানি আইনের কিছুটা পরিবর্তন আনতে হবে। সাক্ষ্য নেওয়ার ধরন পাল্টাতে হবে। বাদীপক্ষ এফিডেভিট (হলফনামা) দেওয়ার পর তাকে সঙ্গে সঙ্গে যদি জেরা করা হয় তাহলেও অনেকটা সময় বেঁচে যায়। এছাড়া সমন দিতে এবং তা কার্যকর করতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। তাহলে সময় যেমন বাঁচবে তেমনি বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগও কমবে। ’
সূত্র: দেশরূপান্তর