ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আইন ও আদালত

বিচারে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার: আইন থাকলেও সুফল মিলছে না

খাদেমুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩৯ ঘণ্টা, জুলাই ১২, ২০২১
বিচারে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার: আইন থাকলেও সুফল মিলছে না

ঢাকা: ক্রান্তিকালীন সময়ে বিচার কাজ সচল রাখতে ২০২০ সালে আদালত কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার আইন করা হয়। আইন হলেও বিচারপ্রার্থীরা এই আইনের সুফল পুরোপুরি পাচ্ছেন না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে একটি স্বতন্ত্র বিচারিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে স্থায়ী অবকাঠামোগত কোনো উন্নয়ন করা হয়নি। যে কারণে আইনের বিধান মতে ইতোপূর্বে ভার্চ্যুয়াল আদালত চালু হলেও নিম্ন আদালতে তা শুধু হাজতি আসামির জামিন শুনানির মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।

করোনা মাহামারির মধ্যে গত বছর ২৭ মার্চ প্রথম দফায় লকডাউনের সময় আদালত পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় দেড় মাস ‍বিচার ব্যবস্থা পুরোপুরি বন্ধ থাকার পর ২০২০ সালের ৯ মে আদালত কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ জারি করা হয়। সেই অধ্যাদেশের আওতায় ওই বছর ১২ মে ভার্চ্যুয়াল আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়।

২০২০ সালের ৯ জুলাই অধ্যাদেশটি আইন হিসেবে পাস করা হয়। এই আইনের ভূমিকায় বলা হয়, ‘মামলার বিচার, বিচারিক অনুসন্ধান বা দরখাস্ত বা আপিল শুনানি বা সাক্ষ্য গ্রহণ বা যুক্তিতর্ক গ্রহণ বা আদেশ বা রায় প্রদানকালে পক্ষগণের ভার্চ্যুয়াল উপস্থিতি নিশ্চিত করিবার উদ্দেশ্যে আদালতকে তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষমতা প্রদানের নিমিত্ত বিধান প্রণয়নকল্পে প্রণীত আইন। ’

আইনটিতে মামলার অনুসন্ধান থেকে রায় পর্যন্ত সর্বত্র তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কেবল সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগেই কিছুদিন সবধরনের শুনানি ভার্চ্যুয়ালি চালু ছিল। কিন্তু নিম্ন আদালতে তা প্রায় হাজতি আসামির জামিন শুনানির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তাই আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের বিরোধিতার মুখে গত বছর ৫ আগস্ট নিয়মিত আদালত খুলে দেওয়া হয়।

এরপর চলতি বছর দুই দফা লকডাউনে ফের আদালত বন্ধ হয়ে যায়। ২ এপ্রিল থেকে দ্বিতীয় দফা লকডাউন শুরুর পর গত ২০ জুন ফের নিয়মিত আদালত খুলে দেওয়া হয়। তবে ১ জুলাই থেকে তৃতীয় দফায় লকডাউনে ফের আদালত বন্ধ হয়ে যায়, যা এখনো বন্ধ আছে।

আইনজীবীরা মনে করেন, আদালত কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার আইন হলেও তা প্রয়োগে এখনো স্বতন্ত্র কোনো ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়নি। যে কারণে আইনের পুরোপুরি সুফল মিলছে না। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান বাংলানিউজকে বলেন, তড়িঘড়ি করে আইন করা হলেও সেই আইন প্রয়োগে কার্যকর কোনো পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি। যে কারণে মানুষের বিচার পাওয়ার সুযোগ সীমিত, ক্ষেত্রবিশেষে বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ অনেক দেশই বিচার বিভাগে তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারে নতুন পদ্ধতি গড়ে তুলেছে। যেমন, যুক্তরাজ্যে কোভিড পরিস্থিতিতে শুরুর দিকে কিছুদিন আদালত বন্ধ ছিল। এরপর তারা তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য ক্লাউড ভিডিও প্লাটফর্ম (সিভিপি) নামে একটি সফটওয়্যার ডেভেলপ করেছে। সেখানে এখন শারিরীক উপস্থিতিতে বিচারের পাশাপাশি সিভিপি প্লাটফর্ম ব্যবহার করেও বিচারকাজ চলছে। যেসব কাজে আমাদের দেশে আদালতের বিভিন্ন শাখায় দৌড়াতে হয়, যুক্তরাজ্যে সিভিপির মাধ্যমে সেই কাজগুলো করে থাকে। তাই আদালতে স্বাস্থ্যবিধি মানা তাদের জন্য অনেক সহজ।

সুপ্রিম কোর্টে এক বছরের বেশি সময় ভার্চ্যুয়ালি শুনানি হচ্ছে। তাই ক্রান্তিকালে সেই পদ্ধতি আরও কার্যকরভাবে ব্যবহার হবে বলে ধারণা ছিল আইনজীবীদের। তবে তৃতীয় দফা লকডাউনে ভার্চ্যুয়াল আদালতগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। হাইকোর্ট বিভাগে শুধু তিনটি বেঞ্চ চালু রাখা হয়। আর জরুরি মামলা শুনতে গত ৮ জুলাই থেকে সপ্তাহে দুইদিন বসছে আপিল বিভাগ।

জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী কুমার দেবুল দে বাংলানিউজকে বলেন, কোভিড পরিস্থিতি বেড়ে গেলে তখনই তো ক্রান্তিকাল ধরা হবে। অথচ সুপ্রিম কোর্টে স্বাভাবিক সময়ে নিজেদের মতো করে ভার্চ্যুয়াল ব্যবস্থা চালু রাখা হলো। আর দেশে যখন ক্রান্তিকাল বিবেচনায় কঠোর বিধিনিষেধ দেওয়া হলো, তখন আদালত প্রায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। জরুরি মামলা শুনানির জন্য যে তিনটি বেঞ্চ হাইকোর্টে রাখা হয়েছে তাতেও শুনানির পদ্ধতি অনেক জটিল।

বিচার ব্যবস্থা এভাবে প্রায় বন্ধের মাধ্যমে মানুষের বিচার পাওয়ার অধিকারকে খাটো করে দেখা হচ্ছে বলে মনে করেন কুমার দেবুল দে। তিনি বলেন, যেখানে মহল্লায় মুদি দোকান পর্যন্ত খোলা আছে, সেখানে বিচারালয় প্রায় বন্ধ। এটা আমাদের জন্য একটা দুর্ভাগ্য।

লকডাউনে নিম্ন আদালত সীমিত আকারে হলেও চালু রাখার পক্ষে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি আবদুল বাতেন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার সংক্রান্ত আইনটা ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে হয়েছিল। যেহেতু শিল্প কারখানা খোলা আছে, জরুরি বিবেচনায় এই আইনের আওতায় ভার্চুয়ালি জামিন শুনানির ব্যবস্থাটা অন্তত রাখা যেতো।

ঢাকার মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আব্দুল্লাহ আবু অবশ্য মনে করেন, সংক্রমণ এখন যে পর্যায়ে গেছে তাতে ভার্চ্যুয়াল আদালত চালু রাখাটাও ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আইনটা ভালো চিন্তা করে করা হয়েছিল। ই-জুডিশিয়ারিটা পুরোপুরি না করা পর্যন্ত এই আইনের সুফল পাওয়া কঠিন। এটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এ অবস্থায় ভার্চ্যুয়াল আদালত চালু রাখলে আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের আদালতে আসতেই হতো। সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় কোনো উপায় না থাকায় তাই আদালতও বন্ধ রাখা হয়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি হলে আশা করছি দ্রুতই নিয়মিত আদালত খুলে দেওয়া হবে।

তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার সংক্রান্ত আইন হওয়ায় একদিকে যেমন সুবিধা হয়েছে, অপরদিকে অসুবিধাও হয়েছে বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, এই আইনের সুবিধা হলো আদালতের দরজা একেবারে বন্ধ হয়ে যায় নাই। অসুবিধা হলো- তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে সবধরনের বিচারকাজ করা যায় না। যেমন, ভার্চ্যুয়াল আদালত হওয়ার কারণে প্রায় দেড় বছর হাইকোর্টে আগাম জামিন বন্ধ আছে। এরকম কিছু আইনি প্রতিকার একেবারেই বন্ধ, যা ন্যায়বিচার পরিপন্থি।

আইন থাকার পরও তিন মাসে দুইবার নিম্ন আদালতের কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, হয়তো সক্ষমতার অভাব, নয়তো সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। অথবা পরিস্থিতি খারাপ। সবই থাকতে পারে।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৭ ঘণ্টা, জুলাই ১০, ২০২১
কেআই/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।