ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

লাইফস্টাইল

এখন ডেঙ্গুর দিন : চাই সতর্কতা

জেসমিন নাহার লাকি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩১০ ঘণ্টা, জুলাই ৩১, ২০১০

ডেঙ্গুজ্বর

প্রচন্ড গরমে জনজীবন বিপর্যস্ত। মাঝে এক পশলা বৃষ্টি।

নাগরিক জীবনে স্বস্তি আসার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় অন্য সমস্যা। রাস্তাঘাটে জলাবদ্ধতা, সেই সাথে ভাঙ্গা টিনের পাত্র, টায়ারের খোল, এয়ারকন্ডিশনের জমা পানি, ফুলদানি, ডাব-নারকেলের খোসা অথবা কোমল পানীয়র ক্যানে ছোট্ট  জলাশয়ে জন্ম নেয় এডিস মশা, যা থেকে ছড়ায় মারাত্মক ডেঙ্গু।

ডেঙ্গু একটি ভাইরাসবাহিত জ্বর, যা উষ্ণম-লীয় অঞ্চলগুলোতে দেখা যায়। বিশেষ করে এশিয়া এবং আফ্রিকায়। বছরের একটি বিশেষ সময়ে এই জ্বরের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়, বিশেষ করে বর্ষাকালে। আমাদের দেশে সাধারণত মার্চ থেকে  সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত, যখন বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বছরের অন্য সময়ের চেয়ে বেশি থাকে।

ডেঙ্গুর ইতিহাস

চিকিৎসাবিজ্ঞানে ডেঙ্গু সম্পর্কে প্রথম জানা যায় ১৭৭৯-৮০ সালের দিকে। এশিয়া মহাদেশে এর প্রাদুর্ভাব শুরু ১৮৭১-৭২ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কিছু অঞ্চলে অনেক ধরনের ডেঙ্গু ভাইরাস মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে ক্যারিবিয়ান অঞ্চল (১৯৭৭-৮১), দণি আমেরিকা (১৯৮০), প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল (১৯৭৯) ও আফ্রিকায় (১৯৭৯)। ডেঙ্গু হেমেরেজিক এবং ডেঙ্গু শক সিনড্রোম প্রথম দেখা যায় ম্যানিলাতে ১৯৫৩-৫৪ সালের দিকে। ১৯৭৫ সালের পর থেকে দণি এশিয়ায় এটি একটি  নির্দিষ্ট সময় পর পর দেখা দিচ্ছে।

১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর মাঝামাঝি সময় থেকেই ডেঙ্গু জ্বর মহামারী আকারে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, চীন এসব দেশে ছড়িয়ে যায়।

ষাটের দশকে এই জ্বর বাংলাদেশে ‘ঢাকা ফিভার’ নামে পরিচিত ছিল, কারণ তখনও এ জ্বর সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা সম্ভব হয়নি।

বাংলাদেশে ১৯৯৯ সালের দিকে আবার এ জ্বর দেখা যায় এবং ২০০০ সালে এর আক্রমণ ছিল ভয়াবহ।

ডেঙ্গু জ্বরের বাহক

চার ধরনের ডেঙ্গু ভাইরাস দেখা যায়। এগুলো হলো DEN-১,২,৩,৪। এ ভারইরাসগুলো সাধারণত এডিস নামক মশার কামড়ের মাধ্যমে মানুষে ছড়ায়। এডিস মশার বৈজ্ঞানিক নাম Aedes aegypti.
এডিস মশা চেনা খুব সহজ। এটি অন্যান্য মশার চেয়ে তুলনামূলকভাবে ছোট। এর সারা গায়ে সাদাকালো ডোরাকাটা দাগ দেখে সহজে আমরা একে চিনে নিতে পারি।

এ মশার উৎপত্তিস্থল ইথিওপিয়ার জলাবদ্ধ এলাকায়। ধারণা করা হয়, দাস-বহনকারী একটি জাহাজের সাথে তারা ব্রাজিলে পৌঁছায়। দীর্ঘদিন মানুষের সাথে বসবাসের ফলে তারা একসময় মানুষের আচার-আচরণ ও অভ্যাসের সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেয় আর বংশবিস্তার করতে শেখে। মজার ব্যাপার হলো, অন্যান্য মশার চেয়ে এদের উড়বার সময় শব্দ কম হয়। তাই কামড়াতে আসার আগ পর্যন্ত আমরা এদের উপস্থিতি একটুও টের পাই না। এ মশা কখনও রাতে কামড়ায় না, দিনের বেলায় কামড়ায়।

এডিস মশার আবাসস্থল    

সাধারণত এডিস মশা ম্যালেরিয়ার মতো পচা, ভেজা, স্যাঁতসেঁতে জায়গা পছন্দ করে না। তারা পরিষ্কার, টলমলে, স্থির পানিতেই ডিম পাড়ে। ঢাকনাবিহীন পানির ট্যাংক, বালতি, ড্রাম, প্লাস্টিকের কৌটা, অ্যাকুরিয়াম, ফ্রিজ ও এসি থেকে নির্গত পানি, বাড়ির ছাদে জমা পানি, ডাব, নারকেল, তালের খোসা, টিনের কৌটা, পুরোনো টায়ার, মিনারেল ওয়াটারের বোতল, আইসক্রিমের কাপ, কোমল পানীয়র ক্যানে জমে থাকা পানি, এমনকি বৃষ্টির পানিতে রাস্তাঘাটে যে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়, সেখানেও জন্ম নিতে পারে এডিস মশা।

ডেঙ্গু জ্বরের ধরন ও লক্ষণ

দুই ধরনের ডেঙ্গু জ্বর দেখা যায় : ক্যাসিকাল এবং হেমোরেজিক। ডেঙ্গু ক্যাসিকাল জ্বরে উচ্চ শারীরিক তাপমাত্রার সাথে মাংসপেশী ব্যাথা, শরীরের গিঁটে ব্যাথা, চোখের পেছনে ও মাথায় ব্যাথা, প্রচ- শারীরিক অবসাদ, বমি আর শরীরের কিছু অংশে, বিশেষত চামড়ার নিচে রক্ত জমাট বাঁধা- এ লক্ষণগুলো দেখা যায়।   ক্যাসিকাল জ্বরে তিকর অবস্থা সাধারণত ৫-৭ দিন থাকে। তারপর ধীরে ধীরে রোগীর অবস্থার উন্নতি হতে থাকে।

ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বরে রোগীর অবস্থা খুব শোচনীয় হয়। এক্ষেত্রে ক্যাসিকাল জ্বরের লক্ষণগুলোর সাথে সাথে আরো যে জিনিসটি দেখা যায় তা হল রক্তক্ষরণ, শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে যেমন- নাক, কান, দাঁতের মাড়ি, খাদ্যনালি দিয়ে, মলমূত্রের সাথে, এমনকি হাত বা পায়ের চামড়া ফেটেও রক্ত বের হতে পারে। শরীরের রক্তচাপ অনেক কমে যায়। তখন এ অবস্থাকে বলে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। রক্তে অনুচক্রিকার সংখ্যা কমে যাওয়াতেই এই রক্তরণ হয়।

আক্রান্ত রোগীর পরিসংখ্যান

পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় ৫০ মিলিয়ন মানুষ ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে প্রায় ৫ লাখ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়, যাদের একটা বড় অংশ শিশু। আর আক্রান্ত রোগীর শতকরা ৫ ভাগের পরিণতি হচ্ছে মৃত্যু, সংখ্যাটি প্রায় ২৫ হাজার। বাংলাদেশে এক জরিপে দেখা গেছে, ২০০০ সালে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ৫৫৫ জন, আর মৃত্যু হয়েছে ৯৩ জনের। ২০০১ সালে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৪৩০ জন, মৃত্যু হয়েছে ৪৪ জনের। ২০০২ সালে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৬ হাজার ১০৪ জন, মৃত্যু হয়েছে ৫৮ জনের। ২০০৬ সালে আক্রান্তের সংখ্যা ১ হাজার ৪২৩ জন, মৃত্যু হয়েছে ৪ জনের। বাংলাদেশে প্রধানত ঢাকা শহরেই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি। এছাড়া চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা ও সিলেটের শহর অঞ্চলগুলোতেও এ জ্বর দেখা গেছে, যদিও সংখ্যায় কম।

ঢাকার যেসব জায়গায় এ জ্বরের প্রাদুর্ভাব বেশি তার মধ্যে ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী, মিরপুর, রামপুরা, সবুজবাগ, শান্তিনগর, যাত্রাবাড়ী, পল্টন, উত্তরা, ফার্মগেট উল্লেখযোগ্য।

চিকিৎসা

ডেঙ্গুজ্বরের কোনো ভ্যাক্সিন বা টিকা এখনও আবি®কৃত হয়নি। তবে এর টিকা আবিষ্কারের জন্য সিঙ্গাপুরে বেশ তোড়জোড় চলছে। ২০০৪ সালে ওষুধশিল্প প্রতিষ্ঠান নোভার্টিস সিঙ্গাপুরে ইনস্টিটিউট ফর ট্রপিক্যাল ডিজিজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান খুলেছে। ডেঙ্গুর চিকিৎসা উদ্ভাবনই এখন পর্যন্ত এর প্রধান কাজ।

চিকিৎসকদের মতে, ডেঙ্গু রোগীদের পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি ও  ফলের রস পান এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম প্রয়োজন। ডেঙ্গুজ্বরে অ্যাসপিরিন, স্টেরয়েড বা এন্টিবায়োটিকজাতীয় খাওয়া উচিত নয়। রোগী বেশি দুর্বল হয়ে পড়লে স্যালাইন দিতে হবে। প্লাটিলেট ১০ হাজারের নিচে না নামলে বাড়তি প্লাটিলেট দেওয়ার প্রয়োজন নেই। ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বরে প্লাটিলেট দিতে হয় আর ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে প্রয়োজন হয় রক্তরস। এক ব্যাগ প্লাটিলেটের জন্য পুরো চার ব্যাগ রক্ত প্রয়োজন।

প্রতিরোধ

ডেঙ্গুজ্বরের সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই বলে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধের দিকেই আমাদের নজর দিতে হবে। এডিস মশাদের আবাসস্থলগুলো নষ্ট করা উচিত। যেগুলো নষ্ট করা সম্ভব নয়, সেগুলোতে যেন ৫ দিনের বেশি সময় পানি জমে না থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে। এ মশা দিনের বেলায় কামড়ায়, তাই দিনে ঘুমালে, অন্তত বর্ষাকালে, মশারি টানিয়ে ঘুমানো উচিত।

এক জরিপে দেখা গেছে, আমাদের দেশে শতকরা ৯৩.৫ ভাগ মানুষ জানে এ মশা দিনে কামড়ায়, শতকরা ৫২.১ ভাগ মানুষ এই মশার আবাসস্থল সম্পর্কে জানে। কিন্তু শতকরা ৬০ ভাগ মানুষের মশা দূর করার জন্য অ্যারোসল বা মশার কয়েল কেনার মতো পর্যাপ্ত টাকা নেই।
 
সচেতনতাই সবচে বড় উপায়

ডেঙ্গু একটি মৌসুমি রোগ, বছরের বিশেষ একটি সময়ে এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। বাংলাদেশে এ রোগটি ল করা যাচ্ছে গত কয়েক বছর ধরেই। প্রথম দিকে এর রূপ ভয়াবহ হলেও ধীরে ধীরে এটি মোকাবিলা করা সহজ হয়ে উঠেছে। মানুষও আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। কিন্তু সমস্যা হলো, মশারাও আমাদের চেয়ে বেশি সচেতন হয়ে উঠছে, তারা তাদের বংশবৃদ্ধির জায়গা করে নিচ্ছে ঠিকই। কাজেই ডেঙ্গুজ্বর সম্পর্কে আরো বেশি জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত, এডিস মশাকে কোনোভাবেই আবাস গাড়তে না দেওয়া।  

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৪৩০, জুলাই ৩১, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।