ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

লাইফস্টাইল

জামদানি পল্লীতে

শারমীনা ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২০৮ ঘণ্টা, জুলাই ২৪, ২০১৩
জামদানি পল্লীতে

বাঙালি নারীর স্বপ্নের শাড়ি-জামদানি। আমরা ঠিক জানি, প্রিয়জনকে একটি জামদানি শাড়ি যদি এই ঈদে কেউ উপহার দেন তবে তিনি অন্য যে কোনো উপহারের চেয়ে অনেক বেশি খুশি হবেন।

সুন্দর, অভিজাত, এতিহ্যবাহী জামদানি শাড়ি পরেই আমরা গর্ব অনুভব করি দেশের পোশাক এতো উন্নত বলে। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না একটি শাড়ি তৈরির পেছনের ঘটনা।

যারা জামদানি শাড়ি পছন্দ করেন তাদের অনেকের মতো আমারও অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল জামদানি পল্লীতে গিয়ে শাড়ি তৈরি দেখব। আর জানবো সেই কারিগরদের জীবনের গল্প।

jamdaniবহু প্রতিক্ষার পরে সেই সুযোগ এলো, নারায়নগঞ্জে রূপগঞ্জের জামদানি পল্লীতে গিয়ে প্রথমে কিছুটা আশাহতই হলাম। জামদানি পল্লী যেমন হবে ভেবেছিলাম আসলে তেমন গোছানো কোনো গ্রাম মনে হলো না। যা হোক আমরা একটি বাড়িতে গেলাম যেখানে তাঁতীরা শাড়ি বুনছেন। নিজের চোখে দেখছি জামদানি শাড়ি তৈরি হচ্ছে! যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না।

সেখানে সবাই আমাদের ভেতরে নিয়ে গেলেন। বসতে দিলেন, যেন কোনো আপন আত্মীয়, কতো দিনের চেনা কেউ। আবারও মনে হলো আমরা বাঙালিরা কতোটা অতিথি পরায়ণ। সবাই যেন কাজ করছেন আপন মনে। তুলির আঁচড়ে শিল্পী যেমন ছবি আঁকেন, ঠিক তেমনি করে শাড়ি বুনছেন তারা। খুব বেশি শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ নেই তাদের, তারপরও প্রতিটি নকশা তৈরি হচ্ছে কতো যে নিপুন, নিখুঁত সত্যি অবাক হবার মতো।  

একটি শাড়ি তৈরি হয় দুজন কারিগরের অক্লান্ত শ্রমে। একই তালে একসঙ্গে এগিয়ে যায় শাড়ির বুনন। খুব অবাক হলাম একটি শাড়ি তৈরিতে কম হলেও ১২ দিন সময় লাগে। তারা প্রতিদিন ভোর ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কাজ করেন। আর ছুটি বলতে শুধু শুক্রবার একবেলা।

আমরা বড় বড় ফ্যাশন হাউসে গিয়ে পুতুলে পরানো যে জামদানি শাড়ির নকশা দেখে নজর সরাতে পারিনা, সেটি হয়তো তৈরি করেছে কোনো ১২-১৪ বছরের কিশোর। আসলেই তাই, বড়দের সঙ্গে ছোটরাও কাজ করে সমান তালে। এই বয়সে যে শিশুটির স্কুলে যাওয়ার কথা সংসারে অভাব মেটাতে সে কাজ করছে দিনের ১৪ ঘণ্টারও বেশি।

যে কারিগররা রাতদিন পরিশ্রম করে আমাদের দেশীয় ঐতিহ্য টিকিয়ে রেখেছেন, কেমন আছেন তারা? না তারা খুব বেশি ভালো নেই, এখানে আজও আছে সেই মহাজনী প্রথা। একটি শাড়ি তৈরিতে যে শ্রম দিতে হয়, পারিশ্রমিক কিন্তু সে তুলনায় খুবই কম। তারা বড়জোর মাসে ৪ থেকে ৬ হাজার টাকা আয় করেন। যা দিয়েই সংসার চালাতে হয় তাদের। সঞ্চয় করার কথা তারা ভাবতেই পারেন না। নিজের একটি তাঁত হবে এটাও দিবা স্বপ্নেরই মতো। কারণ তাদের টাকা নেই কোনো ধরনের ঋণও তারা পান না। এজন্য যতো ভালো শাড়িই তারা তৈরি করবেন তার পুরো লাভটাই যায় মহাজনের পকেটে।  

দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে শাড়ি বুনছেন হাবিব। কিন্তু তার প্রিয়তমা স্ত্রী হেনার জন্য একটি কালো জামদানি আজও করে দিতে পারেন নি। হেনার খুব ইচ্ছে একটি কালো জামদানির কিন্তু হাবিরের কাছে একটি শাড়ি আকাশের চাঁদের মতোই দূলর্ভ। পুরো মাস জুড়ে তিনি যে টাকা আয় করেন তার চেয়েও বেশি একটি শাড়ির মূল্য। কীভাবে সে হেনাকে শাড়ি করে দেবে?

jamdani2তাদের আরও হতাশার কথা জানা গেল, এখানকার জনপ্রতিনিধিরা কোনো দিনই তাদের খোঁজ রাখেন না। শুধুমাত্র ভোটের আগেই এই খেটে খাওয়া মানুষগুলোই যেন হয়ে যান অতিদামী। সবাই এসে হাত মেলান, অনেকে আবার বুকে টেনে নিয়ে অনেক আশ্বাসও দেন...কিন্তু ঐ পর্যন্তই।  

এতো কিছুর পরেও তাদের চোখে আগামি দিনের স্বপ্ন চকচক করছে। আরেক কারিগর বাদলের দুই ছেলে স্কুলে যায়। বাবার ইচ্ছা, তারা একদিন ইঞ্জিনিয়ার হবে। সমাজের সবাই তাদের সম্মান করবে...

খুব ইচ্ছে ছিল জামদানি হাটে গিয়ে শাড়ি কিনবো। কিন্তু আমরা সোমবারে গিয়েছি আর হাট হয় বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার ভোর পর্যন্ত। তবে এখানেই পেয়ে গেলাম সামনের হাটে তোলার জন্য, তুলে রাখা বেশ কিছু দারুণ ডিজাইনের শাড়ি আর টুপিস।

এবার ফিরতে হবে...

ফিরে আসতে আসতে একটি কথাই বারবার ভেবেছি, একদিন সব প্রতিবন্ধকতা পেছনে ফেলে উন্নত হবে কারিগরদের জীবন। আর উৎকর্ষতা, মান ও বৈচিত্র্যে বিকশিত হবে আমাদের জামদানি শিল্প।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।