সাতক্ষীরা: সুন্দরবনে নির্বিচারে হরিণ শিকারে মেতে উঠেছে চোরা শিকারিরা। ‘রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়’ তাদের একটি সিন্ডিকেটও গড়ে উঠেছে।
সুন্দরবনের কালির চর, আগ্রাকোনা বালীঝাকি, ফিরিঙ্গী, মেঘনা, পাতকোষ্টা, কাগা, পাগড়াতলি, তালতলী, ইলসেমারি, মানিক চোরা, কাছিকাটা ও খলিশাবুনিয়া এলাকায় হরিণের সংখ্যা বেশি হওয়ায় শিকারিদের তৎপরতাও ব্যাপক। বনে চিত্রা হরিণের সংখ্যা বেশি। তুলনামূলক মায়া হরিণও রয়েছে। সাম্বার, বারোশিঙা ও হগ হরিণ থাকলেও প্রায় বিলুপ্তির পথে।
জানা গেছে, শীতের তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে বাড়ে হরিণ শিকারি সিন্ডিকেট। প্রতিবছরই এ ঘটনা ঘটে। সুন্দরবনের গভীরে ফাঁদ পেতে বা চোরা বন্দুক ব্যবহার করে হরিণ শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। পেতে রাখা ফাঁদে অনেক সময় মৃত্যু ঘটে মায়াবী প্রাণীগুলোর।
সম্প্রতি সুন্দরবনের কালির চরে ফাঁদ পেতে হরিণ শিকারের ৩৬ সেকেন্ডের একটি ভিডিও চিত্র এ প্রতিবেদকের হাতে পৌঁছায়। ভিডিওতে একটি হরিণকে মৃত অবস্থায় দেখা যায়।
বিভিন্ন মাধ্যমে জানা গেছে, স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় হরিণ শিকারিদের একটি বড় সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে সুন্দরবনের শ্যামনগর উপকূল জুড়ে। শিকারিরা বনের ভেতর থেকে হরিণ শিকার করে এনে লোকালয়ে থাকা সহযোগীদের হাতে পৌঁছে দেয়। বিভিন্ন জায়গায় হাতবদল হয়ে হরিণ পৌঁছে যায় নির্দিষ্ট গন্তব্যে।
এমন দাবি করেন সুন্দরবন সুরক্ষা কমিটির সদস্য সচিব আহসান রাজীবও। তিনি বলেন, চোরা শিকারীরা স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় এ অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। তারা সবকিছুই হরিণের মাংস দিয়ে ম্যানেজ করে ফেলে।
গোপন সূত্রে থেকে জানা গেছে, দালালের মাধ্যমে বনবিভাগের কাছ থেকে বৈধ অনুমতি নিয়েই সুন্দরবনে প্রবেশ করে চোরা সিন্ডিকেটের শিকারিরা। বনবিভাগের সঙ্গে তাদের সখ্যও দীর্ঘদিনের। ফলে যেকোনো অভিযানের আগেই তারা খবর পেয়ে সতর্ক হয়ে যায়।
এ ব্যাপারে বুড়িগোয়ালীনি স্টেশন কর্মকর্তা নুরুল আলম দাবি করে বলেন, সুন্দরবনে প্রবেশের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র দেখে পাস দেওয়া হয়। অনেকের জাতীয় পরিচয়পত্র একজনে নিয়ে এসে পাস নিয়ে যায়। তাই কারা চোরা শিকারি তা ধরা কঠিন।
আবার, বনবিভাগের অভিযানে অনেক সময় হাতেনাতে আটক হয় শিকারিরা। কিন্তু আইনের ফাঁক-ফোকর গলে তারা বেরিয়েও যায়। কয়েকদিন শান্ত থাকলেও আবার শুরু করে এ অপরাধ। গত শনিবার-রোববার সুন্দরবনের খলিশাবুনিয়া, তেরকাটি, মহাসিন সাহেবের হুলা থেকে ষাটটি হরিণ মারা ফাঁদ উদ্ধার করেছে বনবিভাগ।
শ্যামনগরের গোলখালি, গাড়িলাল বাজার, নাপিতখালি, ৯ নম্বর সোরা, ডুমুরিয়া, ১৪রশি, দাতিনাখালির মহসিন সাহেবের হুলা, চেয়ারম্যান মোড়, মৌখালী, সরদার বাড়ি, হরিনগর বাজার, চুনকুড়ি, পার্শেখালি, টেংরাখালি, কালিঞ্চি, ভেটখালি ও কৈখালী এলাকা হরিণের মাংস পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এসব রুট দিয়ে মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কারে পাচার হয় হরিণের মাংস।
বনবিভাগের সাতক্ষীরা রেঞ্জের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সাল থেকে অদ্যাবধি হরিণ শিকারের অপরাধে ৩৩ জনের বিরুদ্ধে চৌদ্দটি মামলা হয়েছে। এসব ঘটনায় ৮৩ কেজি হরিণের মাংস ও ৬৯৯টি হরিণ মারার ফাঁদ জব্দ হয়।
সাতক্ষীরা রেঞ্জের আওতাধীন চার স্টেশনে ১০৮ হরিণ শিকারির তালিকা রয়েছে। এর মধ্যে কোবাদক স্টেশনের আওতায় ত্রিশজন, বুড়িগোয়ালিনী স্টেশনে ৪২ জন, কদমতলা স্টেশনে ২০ জন, কৈখালী স্টেশনে ১৬ জনের নাম রয়েছে। তালিকা ছাড়াও আরও অনেকে হরিণ শিকারের সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে।
তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, হরিণের মাংস চড়া দামে বিক্রি হয়। ক্রেতারাও অনেক সময় প্রতারণা ভেবে হরিণের মাংস কিনতে চান না। তাই তাদের প্রমাণ দেখাতে চোরা শিকারিরা জীবন্ত হরিণ লোকালয়ে এনে জবাই করে থাকে। এ নিয়েও কোনো উচ্চবাচ্য হয় না। অনেক সময় জবাই করা হরিণের ছবি তুলে বাইরের ক্রেতাদের কাছে পাঠানোর ঘটনাও ঘটে।
এ প্রসঙ্গে সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক ইকবাল হোসাইন চৌধুরী বাংলানিউজের কাছে দাবি করে বলেন, আমার সব সময় সজাগ আছি। বিশেষ করে হরিণ শিকারিদের কোনো ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। সম্প্রতি কয়েকজন হরিণ শিকারিকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ২০৫০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০২৩
এমজে