ফরিদপুর: তিন ফসলি জমির মাটি কেটে খাদ বানিয়ে ট্রাকে করে নেওয়া হচ্ছে পার্শ্ববর্তী 'কানাইপুর অটো ব্রিক' নামে এক ইটভাটায়। ফরিদপুরের সদর উপজেলার কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের নরসিংহদিয়া গ্রামের ফসলি ক্ষেতের জমি এভাবেই নষ্ট হচ্ছে।
এ ঘটনায় সংক্ষুব্ধ কৃষকেরা মাটি কাটার একটি ভেকু মেশিন জমি থেকে সরিয়ে দিয়েছেন।
তবে ইটভাটার মালিকের দাবি, ফরিদপুরের এসিল্যান্ড অফিস থেকে সরেজমিনে তদন্ত করে তাদের মাটি কাটার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু চাঁদা না দেওয়ায় তাকে মাটি কাটতে দিচ্ছে না একটি মহল।
অপরদিকে এসিল্যান্ড কর্মকর্তা বলছেন, ওই গ্রামে তদন্তে যাওয়া বা মাটি কাটার অনুমতি দেওয়ার কোনো তথ্য তার জানা নেই। তবে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ব্যবসা ও বাণিজ্য শাখা হতে সেখানে মাটি কাটার অনুমতি দেওয়া হয়েছে বলে জেনেছি।
ভেকু দিয়ে মাটি কাটার ঘটনায় মাথায় শতাধিক কৃষক তাদের জীবিকার অবলম্বন নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন। বিস্তীর্ণ ওই ফসলি মাঠের ভূগর্ভে রয়েছে সেচ প্রকল্পের পাইপ। জমির উপর দিয়ে ভেকু আর ট্রাক চলাচল করলে শুধু ফসলই নষ্ট হবে না, সেচের পাইপও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে পথে বসতে হবে কয়েক হাজার কৃষককে।
জানা গেছে, ভুয়ারকান্দি গ্রামের মৃত হাশেম শেখের স্ত্রী বিধবা ফাতেমা বেগমের ১২০ শতাংশ জমি থেকে মাটি কাটার জন্য ১০ হাজার টাকা অগ্রিমে চুক্তি করেছেন ইটভাটা মালিক বাশার মাল।
ফাতেমা বেগম বলেন, আমি বয়স্ক মানুষ। স্বামী নাই। ক্ষেতখামারি নিজে করতে পারি না। তাই মাটি বিক্রি করে পুকুর বানাইতেছি। প্রতি ট্রাক মাটি ৩৪০ টাকা কইর্যা বেচছি।
এভাবে মাটি কাটার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন দরিদ্র কৃষক পরিবারের গৃহবধূ রুপালী রানী (৩০)। তিনি বলেন,এই জায়গায় পুস্কুনি (পুকুর) কাটলে আমার জমিডাই বাতিল হয়ে যাবে। আমি গরিব মানুষ, নুন আনতি পান্তা ফুরায়। তিন চারডে ছাওয়াল মাইয়্যা নিয়্যা এইটুক জমিতে কাজ কইরা খাই। কি নিয়া বাঁচব তয়লে?
মিলন খান (৩৫) নামে এক কৃষকের অভিযোগ, একখন্ড জমিতে সরিষা বুনেছি। সকালে আমার জমির সরিষার উপর দিয়ে ভেকু এনে মাটি কাটা শুরু করে। এতে আমার অনেক ফসল নষ্ট হয়েছে।
আব্দুর রশীদ নামে অপর কৃষক জানান, এটি সরকারি স্কিম। প্রায় ৫০০ বিঘা জমিতে হাজার হাজার কৃষক জড়িত। আমরা নিষেধ করছি যে, এখানে মাটি কাটা যাবে না। কারণ জমির দুই ফুট নিচেই পাইপ।
তিনি অভিযোগ করেন, একই মালিক এর আগে হালট দখল করে একটি পুকুর খনন করেছেন। তাতে অনেক ক্ষতি হয়েছে। সেচের পাইপ বেরিয়ে ফেটে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
মো. আমজাদ শেখ বলেন, সরকার আমাগের জন্য বিনামূল্যে এই সেচ কইরা দিছে। এখন এই মাটি কাটলে সব নষ্ট হয়ে যাবে। হাজার হাজার কৃষক না খেয়ে মরবে।
ইলিয়াস কবিরাজ (৬০) নামে একজন কৃষক প্রতিবাদ জানান, বোরো ধান, রোপা আমন, সরিষা, পেঁয়াজসহ নানা ধরনের ফসল হয় এসব জমিতে। এখানে সেই ২০০০ সালে প্রথম মাটি কাটার উদ্যোগ নেয়। আমরা বাধা দেই। তারা অনেক নেতা মাস্তান দেখাইছে। ২ লাখ টাকার চাঁদাবাজি মামলাও আমি খাইছি। তারপরও আমরা পরাজিত হই নাই। আমরা এখানে জমি নষ্ট করে মাটি কাটতে দিব না।
এ ব্যাপারে বিএডিসির সেচ প্রকল্পের দায়িত্বরত কর্মকর্তা আব্দুর রশিদ বলেন, এর আগে একই মালিক পাশের আরেকটি জমিতে এভাবে মাটি কাটার ফলে সেচের আন্ডারগ্রাউন্ড পাইপ বের হয় গেছে। আমরা তাদের এভাবে মাটি কাটতে নিষেধ করেছি। ডিসি অফিস, ভূমি অফিস ও ইউএনও অফিসকেও জানিয়েছি যেন মাটি কাটা না হয়।
এ ব্যাপারে সরেজমিনে সেখানে তথ্য আনতে গেলে স্থানীয় মাটি সরবরাহকারী কামাল হোসেন কথা বলিয়ে দেন ভাটার মালিক আবুল বাশার মালের সঙ্গে।
বাশার মাল বলেন, ডিসি অফিসে মাটি কাটার আবেদন করার পর সেটি প্রথমে ইউএনও অফিসে এবং পরে এসিল্যান্ড অফিসে পাঠানো হয়। এরপর এসিল্যান্ড সাহেব সরেজমিনে তদন্ত করে শর্তসাপেক্ষে এই মাটি কাটার অনুমতি দেন। সেখানে যারা বাধা দিচ্ছে তাদের কারোরই জমি নাই। তারা চাঁদা চেয়েছিল। দেইনি বলে বাধা দিচ্ছে।
যারা বাধা দিচ্ছেন তাদের নামেও তিনি মামলার হুমকি দেন।
এ বিষয়ে ফরিদপুর সদর উপজলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) জিয়াউর রহমান বলেন, আমার জানা মতে সেখানে কাউকে মাটি কেটে পুকুর তৈরির অনুমতি দেওয়া হয়নি। এমনকি সরেজমিনে কোনো তদন্তেও কেউ যায়নি। তবে ইটভাটার মালিকেরা মাটি কাটার জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করে। খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।
সদর উপজলা নির্বাহী অফিসার লিটন ঢালী বলেন, ওই জমি থেকে মাটি কাটার অনুমতি দেওয়া হলেও সেটা জনস্বার্থ পরিপন্থী হলে বা জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেক্ষেত্রে তদন্ত সাপেক্ষে অনুমতি বাতিল করা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০২৩
এসএএইচ