ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

ভদ্রার বুকে বালুচর, হেঁটেই পারাপার!

মাহবুবুর রহমান মুন্না, ব্যুরো এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২৩
ভদ্রার বুকে বালুচর, হেঁটেই পারাপার!

খুলনা: শুষ্ক মৌসুমে ভদ্রা নদী যেন সমতল ভূমিতে পরিণত হয়েছে। বালু, পলি আর দখলে ক্রমশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদীর তলদেশ।

এক সময়কার প্রবল খরস্রোতা এই নদীতে নেই পানির প্রবাহ। নদীর বুকে জেগে উঠছে চর। মাঝ নদীতে হাঁটু পানি। ছোট, বড় অসংখ্য চর জেগে ওঠায় নৌকাও চলাচল করতে পারছে না। ফলে মানুষজন বাধ্য হয়ে হেঁটেই নদী পারাপার করছেন।

প্রায় তিন বছর আগে খনন করা খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার ভদ্রা নদীর বর্তমান চিত্র এমনই। ফলে নদী খননের যে আসল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিলো, তা ভেস্তে গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ভদ্রা নদীকে ঘিরেই চলতো হাজার হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা। জোয়ার-ভাটা, মাছ শিকার ও নৌযান চলাচল ছিল নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। অর্থনৈতিক উন্নয়নেও ছিল নদীটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কিন্তু কালের বিবর্তনে ও নানা প্রতিকূলতার মুখে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পলি পড়ে নাব্যতা হারিয়ে ভরাট হয়ে যায় সেই ভদ্রা নদী।  

জলাবদ্ধতা নিরসন, নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি, ফসলের জন্য পানির সমস্যার সমাধান, মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে ভদ্রা নদী খননের উদ্যোগ নিয়েছিল পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। কিন্তু খননের মাত্র তিন বছরের মধ্যেই আবার তা পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে। আর ভরাটের সঙ্গে সঙ্গে নদীর বুকজুড়ে শুরু হয় অবৈধ দখল। প্রভাবশালীরা যে যার মতো করে ভরাট হওয়া নদীর বুক দখল করে নিয়েছে।

নদী শুকিয়ে যাওয়ায় ভদ্রা পাড়ের অনেক মানুষের জীবিকায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। জেলেরা মাছ ধরে ও মাঝিরা নৌকা বেয়ে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু নদীর এই দুরাবস্থায় পূর্বপুরুষের পেশা ছেড়ে অনেকে ভিন্ন পেশায় ঝুঁকে পড়েছেন। ভরাটের মাত্রা এতই বেশি যে, কোনো কোনো স্থানে নদীর অস্তিত্বই নেই, নেই পানিপ্রবাহের কোনো চিহ্নও।

সোমবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) সকালে শোভনা ইউনিয়নের মলমলিয়া গ্রামের বাসিন্দা ২৬নং পোল্টার শাখা বাই খাল পানি ব্যবস্থাপনা অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কামাল হোসেন বাওয়ালী বাংলানিউজকে বলেন, ভদ্রা নদীর খর্ণিয়া থেকে গাবতলার ৩নং ওয়ার্ডের শেষ সীমানা পর্যন্ত ভরাট হয়ে গেছে। হেঁটেই নদী পার হওয়া যায়। ভরাট হওয়ার প্রধান কারণ হলো অপরিকল্পিত নদী খনন।

পাউবো সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালে নেওয়া নদী খনন প্রকল্পের আওতায় ভদ্রা ও শালতা নদীর খনন কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালে। দুই নদী মিলে খনন করা হয় ৩০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ভদ্রা খনন করা হয় ২১ কিলোমিটারের কিছু বেশি। ওই নদীর এক প্রান্তে সাহস ইউনিয়নের দিঘলিয়া এলাকার লোয়ার ভদ্রা নদীর সঙ্গে ও অন্য প্রান্ত শোভনা ইউনিয়নের তেলিগাতি এলাকার ঘ্যাংরাইল নদীর সঙ্গে সংযুক্ত করা ছিল। তেলিগাতি ও দিঘলিয়া এলাকার সংযোগস্থলে দুটি ১০ ভেন্টের স্লুইসগেট করার পরিকল্পনা ছিল ওই প্রকল্পে। ২০১৯ সালের জুনে খননকাজ শুরুর দিকে স্লুইসগেটসহ প্রকল্পের খরচ ধরা হয় ৭৬ কোটি টাকা।

নদীর মধ্যে স্লুইসগেট করা যাবে না, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এমন নির্দেশনার পর প্রকল্পের দুটি স্লুইসগেট তৈরির পরিকল্পনা বাতিল করা হয়। ওই খাতে করা ৩০ কোটি টাকাও আর বরাদ্দ দেওয়া হয়নি।  

অন্যদিকে, অন্যান্য খরচ কমিয়ে খনন বাবদ খরচ করা হয় প্রায় ৪৩ কোটি টাকা। নদীর তলদেশ খনন করা হয় ১৫ থেকে ২০ মিটার। আর গড় গভীরতা ছিল ৪ মিটার।

স্থানীয়দের অভিযোগ, ইস্টিমেট অনুযায়ী নদীর প্রস্থ ১২০ ফুট এবং গভীরতা ১২ থেকে ১৪ ফুট পর্যন্ত খননের কথা থাকলেও সব জায়গায় এ নিয়ম অনুসরণ করা হয়নি। এছাড়া মাটি উত্তোলন করে দুপাশে রেখে দেওয়া হয়। বর্ষা মৌসুমে নদীর দুই পাশের উঁচু করে রাখা ওই মাটি ধুয়ে ফের নদীতে এসে পড়েছে। এছাড়া প্রকল্পের অন্যতম অঙ্গ দিঘলিয়া ও তেলিগাতি প্রান্তে ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ের দুটি স্লুইসগেট নির্মাণের কথা থাকলেও ওই দুটি স্লুইসগেট নির্মাণ না করেই কাজ সমাপ্ত করা হয়। অন্যদিকে দুই প্রান্তের বাঁধ কেটে দেওয়ায় জোয়ার-ভাটায় মাত্র তিন বছরেই পলিতে নদী ফের ভরাট হয়ে গেছে।

খুলনা থেকে শোভনা বেড়াতে যাওয়া মো. এম এ সাদী বাংলানিউজকে বলেন, হেঁটে নদী পার হওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল না। কিন্তু ভদ্রা নদীর শরাফপুর বাজার ঘাট এলাকা দিয়ে হেঁটে নদী পার হয়েছি। নদীর দুই পারের মানুষ এভাবে হেঁটে প্রতিদিন নদী পার হন।

শোভনা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত কুমার বৈদ্য বাংলানিউজকে বলেন, ভদ্রা নদীর প্রায় জায়গায় হেঁটে পার হওয়া যায়। অপরিকল্পিত খনন কাজ করায় পুরো প্রকল্পের কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। আমরা বুঝতে পারিনি যে, এতো দ্রুত নদী ভরাট হয়ে যাবে। নদী না থাকলে আমাদের জীবন শেষ হয়ে যাবে।

অন্তত ২০ বছরে যাতে ভদ্রা ভরাট না হয়, এমন মাস্টার প্লান করে আবার নদী খননের দাবি জানান তিনি।

পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনার উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. মিজানুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ভদ্রা নদীর আংশিক ভরাট হয়েছে। গাবতলা থেকে তেলিগাতী পর্যন্ত ভরাট হয়েছে। ভদ্রার সঙ্গে হামকুড়া নদীও কাটার পরিকল্পনা রয়েছে।

খননের পর এতো দ্রুত কেনো নদী ভরাট হলো? জানতে চাইলে তিনি বলেন, নদীতে পলির মাত্রা বেশি হওয়ায় এতো দ্রুত ভরাট হয়ে গেছে।

বাংলাদেশ সময়: ১১০৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২৩
এমআরএম/এনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।