ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

প্রকল্পে হরিলুট, জেনেও নীরব কর্তারা!

 মো. আমান উল্লাহ আকন্দ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২৩
প্রকল্পে হরিলুট, জেনেও নীরব কর্তারা! ফাইল ফটো

ময়মনসিংহ: ময়মনসিংহে অতিদরিদ্রদের কর্মসৃজন প্রকল্পে সরকারের কোটি কোটি টাকা ভাগ-বাটোয়ারার মাধ্যমে হরিলুট চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। নিয়ম অনুযায়ী শ্রমিকদের নাম ও প্রকল্পের তালিকাসহ অন্যান্য সব তথ্য সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইট ও নিজ নিজ উপজেলায় প্রকাশের বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না।

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের এসব নির্দেশনা মানছেন না উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তারা (পিআইও)। সে সঙ্গে এসব অনিয়ম-দুর্নীতর খবর জেনেও রহস্যজনক কারণে নীরব প্রকল্পের জেলা সমন্বয়কসহ বাস্তবায়ন কমিটির কর্তারা। ফলে তথ্য অধিকার ফরমে আবেদন করেও কর্মসৃজন প্রকল্পের তথ্য সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন একাধিক ভুক্তভোগী সাংবাদিক।

তারা জানান, কর্মসৃজন প্রকল্পের হালনাগাদ তথ্য জানতে গত বছরের ৫ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসকের কাছে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জেলা ত্রাণ ও পুর্নবাসন কর্মকর্তা মুহাম্মদ সানোয়ার হোসেনের কাছে তথ্য অধিকার ‘ক’ ফরমে আবেদন করেন জেলায় কর্মরত এক সাংবাদিক। এরপর জেলা প্রশাসনের তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তা নাসরিন একটি চিঠিতে সংশ্লিষ্ট উপজেলায় আবেদন করার পরামর্শ দেন।  

ওই চিঠির প্রেক্ষিতে গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর ত্রিশাল উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কাছে তথ্য চেয়ে আবেদন করা হয়। কিন্তু দেড় মাস পেরিয়ে গেলেও কোনো তথ্য প্রদান করা হয়নি।

ত্রিশাল উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন (পিআইও) মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, এসব বিষয়ে মোবাইলে কথা বলতে চাই না। আসুন সামনে বসে কথা বলব।

জেলা ত্রাণ ও পুর্নবাসন কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে জেলায় মোট ৪৩৬টি প্রকল্পের বিপরীতে ৩০ কোটি ৯৮ লাখ ৮ হাজার টাকা বরাদ্দ রয়েছে। মোট ৪০ দিন কাজের এ প্রকল্পে জেলায় শ্রমিকের সংখ্যা ১৯৬৩ জন। এতে প্রত্যেক শ্রমিকের মজুরি দৈনিক ৪০০ টাকা বলেও জানায় ওই সূত্র।

জেলার গৌরীপুর, তারাকান্দা, ত্রিশাল, ঈশ্বরগঞ্জসহ বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দাদের অভিযোগ, গায়েবি নাম উল্লেখ করে তৈরি করা হচ্ছে এসব প্রকল্প। আর এসব প্রকল্পের কাগজপত্রে শ্রমিকদের নাম তালিকাসহ অন্যন্য সব প্রয়োজনীয় তথ্য লিপিবদ্ধ থাকলেও সরেজমিনে তা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর ও অসাধ্য বটে। অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিকরাও জানে না তারা এ প্রকল্পের কাগজপত্রে শ্রমিক। কারণ শ্রমিকের বদলে এসব প্রকল্পের প্রায় ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রে কাজ হচ্ছে ভেক্যু মেশিনে। তবে এ বছর জেলার ভালুকা উপজেলায় কর্মসৃজন প্রকল্পের কাজ বন্ধ রয়েছে।

অভিযোগ উঠেছে, অতিদরিদ্রদের কর্মসংস্থানের লক্ষে  সরকার এ প্রকল্প বরাদ্দ দিলেও প্রকল্পের সমন্বয়ক ও বাস্তবায়ন কর্মকর্তাদের গাফিলতি ও তদারকির অভাবে ব্যাহত হচ্ছে সরকারের উদ্দেশ্য। ফলে কাগজপত্রে সব কিছু ঠিকঠাক থাকলেও বাস্তবে কর্মসৃজন প্রকল্পে সরকারি বরাদ্দের প্রায় ৭০ ভাগ অর্থ নয়ছয় করে আত্মসাৎ করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এমন অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দা, একাধিক ইউপি সদস্য ও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তার।

ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার আওয়ামী লীগ নেতা মো. সিরাজুল ইসলাম জানান, অতীতে এ প্রকল্পে ব্যাপক লুটপাট হওয়ার কারণে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বর্তমানে শ্রমিকদের নিজ নিজ নামে মজুরি পরিশোধের জন্য মোবাইলের নগদ অ্যাকাউন্টের নিয়ম চালু করেছেন। কিন্তু এ নিয়মেও লুটপাট বন্ধ হচ্ছে না। কারণ শ্রমিকদের নামের বিপরীতে নগদ অ্যাকাউন্ট চালু করলেও তা জানে না শ্রমিকরা। এসব নাম্বারের সিম কার্ড থাকে সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যান, মেম্বার ও পিআইওদের হাতে।

সম্প্রতি ময়মনসিংহের গৌরীপুরে কর্মসৃজনসহ সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ১১০ প্রকল্পের টাকা, চাল ও গম আত্মসাতের ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ করেছেন উপজেলার মইলাকান্দা ইউনিয়নের মইলাকান্দা গ্রামের মো: ফাইজুল হক।

অভিযোগ উঠেছে, জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মুহাম্মদ সানোয়ার হোসেন এ কর্মসৃজন প্রকল্পের সমন্বয়ক। তিনি পিআইওদের সঙ্গে এসব প্রকল্পের সমন্বয় করে থাকেন। ফলে প্রত্যেক উপজেলার সঙ্গে নির্দিষ্ট কমিশনের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্টদের যোগসাজশে নয়ছয় করা হচ্ছে প্রকল্পের টাকা। এতে সরকারের উদ্দেশ্য ব্যাহত হলেও লাভবান হচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। আর এ কারণেই গত কয়েক বছর ধরে কর্মসৃজন প্রকল্পের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠলেও আজ পর্যন্ত জেলার কোনো অনিয়মের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন হয়নি বা কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।  

তবে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা ও কর্মসৃজন প্রকল্পের সমন্বয়ক মুহাম্মদ সানোয়ার হোসেন বলেন, কর্মসৃজনের কাজ বাস্তবায়ন করে উপজেলা বাস্তবায়ন কমিটি। এতে অবগত থাকা ছাড়া আমার সংশ্লিষ্টতা খুব একটা নেই।  

এ সময় তিনি আরও বলেন, কোথায় অনিয়মের অভিযোগ উঠলে তা খতিয়ে দেখা হয়। তবে গত কয়েক বছরে এ ধরনের অভিযোগের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন হয়নি বা কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি, বলেও স্বীকার করেন তিনি।  

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মো. মোস্তফিজার রহমান বলেন, প্রকল্পের তথ্য ওয়েবসাইট ও উপজেলায় প্রকাশ করা বাধ্যতামূলক। অবশ্যই এ বিষয়টি খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৩২৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২৩
জেএইচ 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।