ঢাকা: বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বঙ্গোপসাগরীয় কয়েকটি রাষ্ট্র মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়েছে। অতিমাত্রায় নদীবাহিত পলি জমে এসব দেশের বিভিন্ন সমুদ্রবন্দর সংলগ্ন নৌ চ্যানেল ও উপকূলীয় নৌপথের উপযুক্ততা (নাব্যতা) দ্রুত কমে আসছে।
এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে প্রবল বর্ষণে কিংবা সামান্য জলোচ্ছ্বাসে সমুদ্রসংলগ্ন সমতলভূমি তলিয়ে যাচ্ছে। যেমনটি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চট্টগ্রাম শহরে দেখা যাচ্ছে।
ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো হচ্ছে- বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ। তবে সংকটের এই মাত্রাটা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অনেকটাই বেশি। কারণ চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা- দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক সমুদ্রবন্দরই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
একই রকম ঝুঁকিতে রয়েছে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সমুদ্রবন্দরগুলোও। আন্তর্জাতিক একাধিক গবেষণা প্রতিবেদন ও দেশি-বিদেশী বিশেষজ্ঞদের মতামতে এমন আশঙ্কার আভাস পাওয়া গেছে। সংকট নিরসনে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে এসব সমুদ্রবন্দরের সক্ষমতা অনেকাংশে হ্রাস পাবে এবং ২০৩০ সাল নাগাদ অভ্যন্তরীণ নদীবন্দরে রূপ নিতে পারে বলেও বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন। সে ক্ষেত্রে বঙ্গোপসাগরীয় এই চার দেশের বাণিজ্যখাত স্বাভাবিক গতি হারাতে পারে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।
চট্টগ্রাম বন্দরকে বলা হয় ইকোনমিক লাইফলাইন। এ বন্দরকে ঘিরেই বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানির ৮০ শতাংশ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এই বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ প্রতি বছরই বাড়ছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (চবক) তথ্য মতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে এ বন্দর দিয়ে ১১ কোটি ৩৭ লাখ টনের অধিক পণ্য হ্যান্ডলিং হলেও, এক দশক আগে ২০১০-১১ অর্থবছরে এখান দিয়ে পরিবাহিত পণ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় সাড়ে চার কোটি টন। যা মাত্র এক দশকে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে যায়। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা আরও বেড়ে প্রায় ১১ কোটি ৮২ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে।
তবে চ্যানেলে প্রয়োজনীয় নাব্যতা না থাকায় চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে বেশি গভীরতার মাদার ভেসেল (বড় জাহাজ) ভিড়তে পারে না। বড় আয়তন ও বেশি গভীরতাসম্পন্ন জাহাজ প্রবেশের জন্য দরকার গভীর সমুদ্রবন্দর। মাতারবাড়িতে এই বন্দর নির্মাণের কাজ চলছে। তাই চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাস ও উত্তোলনের জন্য এখন বাধ্য হয়ে লাইটার জাহাজের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।
চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা- দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক সমুদ্রবন্দরই উপকূলীয় এলাকায় অবস্থিত। কিন্তু সমুদ্র উপকূলের নৌ চ্যানেলগুলোয় প্রতি বছর ১০ মিলিয়ন (এক কোটি) ঘনমিটারেরও বেশি নদীবাহিত পলি জমা হচ্ছে। এতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রধান মাধ্যম বা চালিকাশক্তি বিভিন্ন সমুদ্রবন্দরের নৌ চ্যানেলগুলো নাব্যতা হারাচ্ছে। এছাড়া বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে প্রতি বছর বাড়ছে সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা। এর ফলে বন্দরসংলগ্ন এলাকাসহ সমগ্র উপকূলীয় অঞ্চলের ভূমিক্ষয়ও বেড়ে চলেছে।
মোংলা সমুদ্রবন্দর গড়ে উঠেছে সুন্দরবন উপকূলীয় অঞ্চলে। এর কাছাকাছি গড়ে উঠেছে পায়রা সমুদ্রবন্দর। যা সুন্দরবন অঞ্চল থেকে খুব বেশি দূরে নয়। বিশেষজ্ঞরা এ উপকূলীয় এলাকাকে চিহ্নিত করেছেন জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে নাজুক এলাকা হিসেবে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, গত দুই দশকে সুন্দরবন উপকূলে সমুদ্রপৃষ্ঠের বার্ষিক উচ্চতা বেড়েছে গড়ে ৩০ মিলিমিটার। এর ফলে তটভূমির ক্ষয় হয়েছে প্রায় ১২ শতাংশ। ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল ফর ক্লাইমেট চেঞ্জের (আইপিসিসি) তথ্য বলছে, ২০০৬ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়েছে গড়ে ৩ দশমিক ৭ মিলিমিটার। বঙ্গোপসাগরের ক্ষেত্রে এ উচ্চতা বৃদ্ধির বার্ষিক গড় হার দেড় মিলিমিটার।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে সামান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগেই চট্টগ্রাম শহর তলিয়ে যায়। এই শহর সংলগ্ন চট্টগ্রাম বন্দর গড়ে উঠেছে কর্ণফুলী নদীর মোহনায়। নদীটির প্রশস্ততা ও গভীরতা- দুটোই এখন কমেছে। নিয়মিত প্রয়োজনীয় ড্রেজিংয়ের অভাবে জেটিমুখে পর্যাপ্ত পলি জমে বন্দরে জাহাজ চলাচলে মারাত্মক বিঘ্ন সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
শুধু বাংলাদেশ নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী সবকটি দেশই এখন নাজুক পরিস্থিতিতে আছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
এমন আশঙ্কার স্পষ্ট পূর্ভাভাস মিলেছে ‘নেদারল্যান্ডস ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস’ ও ভারতের নয়া দিল্লিভিত্তিক থিংকট্যাংক ‘ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজের (আইপিসিএস) এক যৌথ প্রতিবেদনে।
বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী দেশগুলোয় জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত সংক্রান্ত বিভিন্ন গবেষণার ফল তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বঙ্গোপসাগরকে কেন্দ্র করে এখন ব্যাপক নিরাপত্তামূলক কার্যক্রম ও শক্তির প্রতিযোগিতা জোরদার হয়েছে। এমন সময়ে এসব ঘটছে যখন জলবায়ু পরিবর্তন জনিত হুমকিগুলো এখানকার জাতীয় ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং পরিচালনা ব্যবস্থায় নানামুখী প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে বঙ্গোপসাগরীয় নিরাপত্তা ফ্রেমওয়ার্কে অঞ্চলের জলবায়ু নিরাপত্তাকে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি অপরিহার্য হয়ে পড়েছে বলেও যৌথ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
নয়া দিল্লিভিত্তিক অপর একটি থিংকট্যাংক ‘রিসার্চ এ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম ফর ডেভেলপিং কান্ট্রিজ (আরআইএস) এর আশিয়ান-ইন্ডিয়া সেন্টারের জ্যেষ্ঠ গবেষক অধ্যাপক প্রবীর দে বলেছেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী দেশগুলোয় জলবায়ু সংকট এখন তীব্র হয়ে উঠেছে। পলিপ্রবাহ ও চলাচলে সমস্যার কারণে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ সমুদ্রবন্দর অভ্যন্তরীণ নদীবন্দরে রূপ নেবে। এসব দেশের প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ভারতের প্রভাবশালী গণমাধ্যম দ্য হিন্দুস্তান টাইমসে সম্প্রতি প্রকাশিত এক নিবন্ধে তিনি আরও উল্লেখ করেন, এ সময়ের (২০৩০ সাল) মধ্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রয়োজনীয় সব সুযোগ-সুবিধাসহ গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তুলতে ব্যর্থ হলে বঙ্গোপসাগরীয় দেশগুলোর বাণিজ্যখাতের গতি মন্থর হয়ে যাবে।
বিশিষ্ট পরিবেশবিদ ও পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন জনিত সমস্যাটি এখন সমস্যা নেই, ভয়ানক সংকটে রূপ নিয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং নদীবাহিত বিপুল পরিমাণ পলি জমার কারণে আমাদের সমুদ্র বন্দরগুলোর নৌ-চ্যানেলসহ সমগ্র উপকূলীয় জনপদ এক ধরনের হুমকির মুখে রয়েছে। বাংলাদেশসহ বঙ্গোপসাগরীয় দেশগুলোর বেশ কয়েকটি সমুদ্রবন্দরের কার্যক্রম চালু রাখাই নিকট ভবিষ্যতে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকলে চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা বন্দরের কার্যকারীতা মারাত্মকভাবে কমে যেতে পারে। এমনকি এ তিনটিসহ মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি সমুদ্রবন্দর ২০৩০ সাল নাগাদ নাব্যতা ও সক্ষমতা হারিয়ে অভ্যন্তরীণ নৌবন্দরে রূপ নিতে পারে। তাই বিষয়টিকে পরিকল্পিতভাবে ও যথাযথ উপায়ে মোকাবেলা করতে না পারলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গতি থমকে দাঁড়াবে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করেন প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক।
বাংলাদেশ সময়: ১৫১৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২৩
টিএ/এনএস