ঢাকা: সরকারি ছুটির দিনে সাপ্তাহিক বাজার করতে কারওয়ান বাজার এসেছেন বেসরকারি চাকরিজীবী জাহিদুর রহমান (ছদ্দনাম)। স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে মাত্র তিনজনের পরিবার হলেও প্রায়শই বাজার করতে এসে হিমশিম খেতে হয় তাকে।
জাহিদুর রহমানের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাত্র পাঁচ কেজি চাল, আধা কেজি ডাল, এক লিটার সয়াবিন তেল, ২৫০ গ্রাম সরিষার তেল, দুইটি ব্রয়লার মুরগি, একটি রুই মাছ, কিছু সবজি আর মশলা কিনতেই তার সঙ্গে আনা টাকা ফুরিয়ে গেছে। এখনো খেঁজুর, ফলসহ অন্যান্য জিনিপত্র কেনা বাকি। কিন্তু কিছু করার নেই। বিকেলে হয়তো স্থানীয় বাজার থেকে বাকি জিনিসপত্র কিনবেন তিনি।
জাহিদুর রহমানের মতো আরও অনেককেই এই রমজানে বাজার করতে এসে ফিরতে হচ্ছে প্রয়োজনের তুলনায় কম পণ্য কিনে। কেউবা আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে কাট-ছাট করছেন জীবন-যাত্রার অন্য কোনো খাত থেকে। তারপরও কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। কারণ প্রতিবার রমজান এলেই বেড়ে যায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। এবার তো রমজান আসার আগে বেড়েছে প্রতিটি পণ্য। রমজানে গুটি কয়েকের দাম কমলেও সেটি স্বস্তিকর পর্যায়ে পৌঁছায়নি।
শুক্রবার (৩১ মার্চ) রাজধানীর কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা যায়, দুই-একটি ছাড়া কোনো সবজির দামই ৫০ টাকার নিচে নয়। বরং বেশ কয়েকটির দাম ১০০ টাকার উপরে। ব্রয়লার মুরগির দাম কিছুটা কমলেও এখনো ২০০ টাকার উপরে বিক্রি হচ্ছে এই পোল্ট্রি পণ্যটি। এছাড়া মাছ-মসলার বাজার চওড়া তো আছেই।
বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি পেঁপে ৩০-৩৫ টাকা, কচুর লতি ৭০-৭৫ টাকা, মিষ্টি কুমড়া ২৫-৩০ টাকা, মূলা ৪০-৫০ টাকা, বেগুন ৬০-৬৫ টাকা, কাঁচা আম ১২০-১৩০ টাকা, সজনে ডাটা ৮০-৯০ টাকা, খিরা ৫০-৬০ টাকা, চিচিঙ্গা ৬০ টাকা, উস্তা ৮০ টাকা, করলা ৮০ টাকা, গাজর ৪০-৪৫ টাকা, বরবটি ৭০-৭৫ টাকা, শিম ৬০ টাকা, কাকরোল ২০০ টাকা, সশা ৫০ টাকা, ঝিঙা ১০০ টাকা, পটল ৭০ টাকা, টমেটো ৩৫-৪৫ টাকা, ধুন্দুল ৮০ টাকা ও ক্যাপসিক্যাম ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া প্রতিটি ফুলকপি ৪০-৫০ টাকা, বাঁধাকপি ৩০-৩৫ টাকা, ব্রকলি ৪০ টাকা, লাউ ৭০ টাকা, চাল কুমড়া ৭০ টাকা, কাঁচা কাঁঠাল ৬০ টাকা ও প্রতি হালি কাঁচা কলা ২৫-৩০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
শাকের বাজারে গিয়ে দেখা যায়, মানভেদে প্রতি আঁটি লাল শাক বিক্রি হচ্ছে ১৫-২০ টাকা, পুঁই শাক ২৫-৫০ টাকা, পাট শাক ১৫-২০ টাকা, ডাটা শাক ১৫-২০ টাকা, কুমড়ার শাক ৪০ টাকা, মাইরার শাক ৩০-৫০ টাকা, কলমির শাক ১০-১৫ টাকা, লাউ শাক ৩০-৫০ টাকা ও পালং ১০-১৫ টাকায়।
রমজানের শুরু থেকে অপরিবর্তিত রয়েছে পেঁয়াজ, রসুন ও আদার দাম। বর্তমানে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩০-৩৪ টাকা, ভারতীয় পেঁয়াজ ৩০-৩৮ টাকা, দেশি রসুন ৯০ টাকা, চায়না রসুন ১২০-১৩০ টাকা, দেশি আদা ২০০ টাকা, মিয়ানমার থেকে আমদানি করা আদা ১৪০ টাকা ও চায়না আদা ২০০ টাকা। অপরিবর্তিত আছে আলুর দামও। প্রতি পাল্লা (৫ কেজি) ১০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
তবে দাম বেড়েছে মসলার। রমজানের আগে ৩৯০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া শুকনা মরিচ এখন বিক্রি হচ্ছে ৪৬০-৪৭০ টাকা, ৬০০ টাকার জিরা বিক্রি হচ্ছে ৭০০ টাকা, ২ হাজার ৪০০ টাকার এলাচ বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার টাকা, ৪০০ টাকার দারুচিনি ৭০০ টাকা, ৩০০ টাকার গুড়া মরিচ ৪০০ টাকা, ১৬০ টাকার গুড়া হলুদ ২৪০ টাকা।
ইফতারে সবার আগে যে পণ্যটির প্রয়োজন পড়ে সেটি হলো লেবু। কিন্তু বাজারে সেই লেবুর দামও আকাশ ছোঁয়া। বর্তমানে প্রতি হালি কলম্বো লেবু ৫০-৬০ টাকা, কাগজি লেবু ৬০ টাকা ও এলাচি লেবু ৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
আশরাফুল আলম নামের এক ক্রেতা বলেন, প্রতিটি জিনিসের দামই বেশি। রমজানে সেটা আরো বেড়েছে। খবরে দেখলাম ব্যবসায়ীরা বলছে এবার রমজানে নিত্যপণ্যের দাম বাড়েনি। কিন্তু আমার কাছে তো মনে হচ্ছে গত বছরের থেকে এবার রমজানে জিনিসপত্রের দাম বেশি। আগে বাজার করার পর বেতনের কিছু জমানো যেতো। কিন্তু এখন বেতনের পর বোনাস দিয়েও কুলানো যাচ্ছে না।
মো. সবুজ নামের এক বেসরকারি চাকরিজীবী বলেন, রমজানে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে, সাধারণ মানুষের ভোগান্তি হবে এটা তো নিয়ম হয়ে গেছে। তাই এসব নিয়ে কথা বলেও লাভ নেই। তদারকি সংস্থাগুলো যখন অভিযান চালায়, তখন দাম কমে। আবার তারা চলে গেলে, দাম বেড়ে যায়।
এদিকে প্রায় দুই মাস ধরে আকাশ ছোঁয়া দামে বিক্রি হওয়া ব্রয়লার মুরগির দাম রমজান মাসে এসে কিছুটা কমেছে। তবে এর উত্তপ এখনো পোড়াচ্ছে ক্রেতাদের। কারণ মাস দুয়েক আগেও ১৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া ব্রয়লার মুরগি এখনো বিক্রি হচ্ছে ২১৫-২২০ টাকায়। মধ্যে দুই-তিন দিনের জন্য দাম কমে আবার বেড়েছে লেয়ার ও সোনালী মুরগির দাম। বর্তমানে প্রতি কেজি সোনালী মুরগি ৩৫০ টাকা, লাল লেয়ার ৩৩০ টাকা, সাদা লেয়ার ২৯০ টাকা, সাদা কক ৩২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
বিক্রেতারা বলছেন, সরবরাহ না থাকায়, লেয়ার ও সোনালী মুরগির দাম কিছুটা বেড়েছে। তবে ব্রয়লার মুরগির দাম রমজানে কমেছে। তবে রমজানের শেষে আবার ব্রয়লার মুরগির দাম বাড়ার আশঙ্কা করছেন বিক্রেতারা।
মো. বিল্লাল হোসেন নামের এক বিক্রেতা বলেন, এখন রমজানে অনেক হোটেল-রেস্টুরেন্ট বন্ধ। তাই সরবরাহের ঘাটতি থাকলে দামে সমস্যা হচ্ছে না। তবে রমজানের পর আবার হোটেল রেস্টুরেন্টগুলো খুললে তখন চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না দিতে পারলে দাম বাড়বে।
এদিকে বর্তমানে বাজারে প্রতি হালি লাল ডিম বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা, সাদা ডিম বিক্রি হচ্ছে ৩৮ টাকা, হাঁসের ডিম বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়।
অপরিবর্তিত আছে চালের বাজার। বর্তমানে প্রতি কেজি মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে ৬৮-৭২ টাকা, নাজিরশাইল বিক্রি হচ্ছে ৭০-৮০ টাকা, পাইজাম বিক্রি হচ্ছে ৪৮ টাকা, স্বর্ণা বিক্রি হচ্ছে ৪৫-৪৬ টাকা, আটাশ বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫২ টাকা, পোলাও এর চাল বিক্রি হচ্ছে ১৪০-১৫০ টাকা। এছাড়া মসুর ডাল মানভেদে ১০০-১৫০ টাকা, ছোলা ৮০ টাকা, বুটের ডাল ১০০ টাকা, মুগের ডাল ১২০ টাকা, অ্যাঙ্কর ৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
রমজানে গরু ও খাসির মাংসের দাম আগের মতো থাকলেও বেড়েছে মাছের দাম। রমজানে প্রকার ভেদে প্রতি কেজি মাছে ৫০-৬০ টাকা বাড়তে দেখা গেছে। বর্তমানে কারওয়ান বাজারে প্রতি কেজি ফলি মাছ ৩০০ টাকা, পোয়া মাছ ৪৫০ টাকা, আইড় মাছ ৭০০ টাকা, পাবদা মাছ ৪০০-৬০০ টাকা, কোরাল মাছ ৬০০ টাকা, বাইলা মাছ ৪০০ টাকা, সুরমা মাছ ২০০ টাকা, কাঁচকি মাছ ৩০০ টাকা, রূপচাঁদা মাছ ৮০০ টাকা, চাপিলা মাছ ৪০০ টাকা, বোয়াল মাছ ৬০০ টাকা, সরপুঁটি ২৫০ টাকা, টেংরা ৮০০ টাকা, পুঁটি ২০০ টাকা, ইলিশ ৫০০-১৬০০ টাকা, শিং ৪০০ টাকা, কই ৬০০-৮০০ টাকা, শোল ৭০০ টাকা, গলদা চিংড়ি ৭০০-১২০০ টাকা, বাগদা ৬০০ টাকা, হরিণা চিংড়ি ৫৫০ টাকা, কুঁচো চিংড়ি ৪০০ টাকা, রুই ৩২০ টাকা, কাতলা ৩৫০ টাকা, মাগুর ৮০০ টাকা, তেলাপিয়া ২০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৮০৫ ঘণ্টা, মার্চ ৩১, ২০২৩
এসসি/এসএ