ঢাকা: অর্থ বিত্ত পদ পদবি পেলেই যেখানে মানুষ সামান্য অসুখ বিসুখে বিদেশে চিকিৎসা করাতে যান, সেখানে একেবারেই ব্যতিক্রম ছিলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বিনামূল্যে চিকিৎসার সুযোগ থাকার পরেও তিনি কখনো বিদেশে চিকিৎসা করাতে রাজি হননি।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর দুটো কিডনিই বিকল ছিল। বহুদিন থেকেই কিডনি ডায়ালাইসিস করে বেঁচে ছিলেন। তার নিজের প্রতিষ্ঠিত গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রেও তিনি কখনও বাড়তি সুবিধা নেননি। অন্যসব ডায়ালাইসিস রোগীর মতোই সাধারণ বেডে তিনি কিডনি ডায়ালাইসিস করাতেন। ডায়ালাইসিস চলাকালেও তিনি কাজ এবং চিকিৎসা বিষয়ে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দিতেন।
২০১৪ সালে তার কিডনিতে প্রথম সমস্যা শুরু হলে তার বন্ধুরা বিনামূল্যে বিদেশে তাকে কিডনি প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দিয়েছিলেন। সেই প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দিয়ে বলেছিলেন, দেশের সাধারণ মানুষ কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের সুযোগ পাবে না, আর আমি আমেরিকা থেকে করে আসব বা দেশে মিথ্যা কথা বলে করতে হবে, তা হয় না। আমি ট্রান্সপ্লান্ট করব না। ডায়ালাইসিস করব, যে সেবা গরিব মানুষকেও দিতে পারব।
তার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রধান সমন্বয়কারী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ডা. মামুন মোস্তাফী বলেন, দীর্ঘদিন ধরে গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকে অবস্থার উন্নতি না হলেও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী দেশের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা নিতে চাননি। গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালেই তিনি চিকিৎসা নিয়ে মরতে চেয়েছেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হলেও তিনি রাজি হননি।
করোনা আক্তান্ত হলে তার চিকিৎসায় দামি ওষুধ গ্রহণ করতে রাজি হননি। তার কথা ছিল, প্রথমত করোনা চিকিৎসায় এত দামি ওষুধ দরকার নেই। দ্বিতীয়ত, যে ওষুধ কেনার সামর্থ্য সাধারণ মানুষের নেই, সেই ওষুধ আমি খাব না। সেময় কোনো ডাক্তার তার মত পরিবর্তন করাতে পারেননি। এমনিভাবে নিজ বিশ্বাসে অবিচল ছিলেন মৃত্যুর মুখেও।
তিনি কোভিড আক্রান্ত হলে নিজের প্রতিষ্ঠিত গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলছিল। আরও ভালো চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেলের তার জন্য ভিআইপি রুমও প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। তিনি যেতে রাজি হননি। তখন তিনি বলেছিলেন, আমি যে হাসপাতাল তৈরি করলাম, সেখানে যদি নিজেই আস্থা না রাখি, সাধারণ মানুষ আস্থা রাখবে না। নিজের তৈরি হাসপাতালে নিজেই যদি চিকিৎসা না নিতে পারি, তাহলে এমন হাসপাতাল কেন বানাবো।
জানা যায়, তাকে যেন চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার কথা চিন্তা করা না হয়। জ্ঞান থাকাবস্থায় সেই নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। চোখের অপারেশনও তিনি নিজ প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালের চক্ষু সার্জনের কাছেই করেছিলেন।
এই বিষয়ে ডা. মামুন মোস্তাফী বাংলানিউজকে বলেন, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ব্যতিক্রমধর্মী একজন মানুষ ছিলেন। উনি নিজে রোগী হয়েও চিকিৎসকদের শেখানোর জন তৎপর থাকতেন। তিনি নিজেই স্যাম্পল হয়ে আমাদের চিকিৎসা শিখিয়েছে। তার আমাদের প্রতি সেই বিশ্বাস ছিল যে আমরা তাকে সর্বোচ্চ মানের চিকিৎসা দেব। উনি এটা বিশ্বাস করতেন তার হাসপাতালে যদি ভালো চিকিৎসা সম্ভব, তাহলে বাংলাদেশেও ভালো চিকিৎসা সম্ভব, তাহলেই আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা ফিরে আসবে। এসব কারণেই তিনি কখনও গণস্বাস্থ্য ছাড়তে চাননি।
তিনি আরও বলেন, কলকাতার অধ্যাপক পাহাড়ি ডা. জাফরুল্লাহকে বলেছিলেন তিনি কলকাতা গেলে কিডনি জোগাড় করে দেবেন। কিন্তু তিনি চাচ্ছিলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট চালু হবে, সেখানেই তিনি কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করবেন, উনার কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট দেখে অন্যরা যেন আস্থা পায় এখানেও ভালো মানের ট্রান্সপ্লান্ট হয়। এখানে ট্রান্সপ্লান্ট করলে কোনো সমস্যা হয় না। উনি মনে প্রাণে চাইতেন গণস্বাস্থ্যের মাধ্যমে দেশের কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট এগিয়ে যাবে।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে এক লাখ টাকায় কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করার ঘোষণাও দিয়েছিলেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৮১০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০২৩
আরকেআর/আরএ