ঝিনাইদহ: প্রবল ইচ্ছা শক্তির কাছে কোনো প্রতিবন্ধকতাই যেন বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না তার অনন্য দৃষ্টান্ত নাহিদ হাসান (২১)। স্বাভাবিক মানুষের থেকে কিছুটা আলাদা, আকারে ছোট শিশুর মতো হলেও বর্তমানে তিনি মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে এখন উচ্চ শিক্ষা নিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিচ্ছেন।
২১ বছর বয়সী নাহিদ হাসানের উচ্চতা ৪ ফিট। জন্ম হরিনাকুন্ডু উপজেলার ভেড়াখালী গ্রামে। তার বাবা আরিফ মালিথা একজন কৃষক ও মা পারভীনা বেগম একজন গৃহিণী।
নাহিদের বড় বোন রোকসানা খাতুন নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেছেন। পরে পরিবার থেকে তার লেখাপড়া চালাতে না পারায় বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। তার ছোট বোন আফসানা খাতুন পাশের গ্রামের একটি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়াশুনা করছে। নাহিদ হাসান হরিনাকুন্ডু উপজেলার জোড়াদহ কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় মানবিক বিভাগে জিপিএ-৪.০০ নিয়ে উত্তীর্ণ হন।
গত মঙ্গলবার (৩০ মে) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘এ’ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি তিনি শিশুদের সঙ্গে ফুটবল খেলতে ভালোবাসেন। অনেকেই ভালোবেসে তাকে ডাকে ক্যাপ্টেন বলে। আকারে ছোট থাকায় সামাজিকভাবে কিছুটা প্রতিবন্ধকতার স্বীকার হলেও এখন এলাকার মানুষ তাকে শান্ত ও ভদ্র ছেলে হিসেবেই জানেন।
নাহিদ হাসান কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমি প্রথমে গোবিন্দপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ও পরে ভেড়াখালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হই। ২০২০ সালে এসএসসি পাশ করে জোড়াদাহ কলেজে ভর্তি হই এবং ২০২২ সালে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে 'এ' গ্রেড পেয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার পরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছি। এখনও রেজালন্ট আসেনি। আমার লেখাপড়ার সময় বন্ধুরা অনেক সহযোগিতা করেছে। সরকার যদি আমার সহযোগিতা করে, তাহলে আমি লেখাপড়া করে যেতে পারতাম। সেই সঙ্গে আমার একটা চাকরি হলে ভালো হতো। আমি বাবা মার বোঝা হয়ে থাকতে চাই না।
নাহিদের মা পারভীনা বেগম জানান, আমার ছেলে ৮ বছর বয়স থেকে এমন হয়েছে। আমরা বুঝতে পারিনি। পরে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে জানতে পারি এটা হরমোনের সমস্যা। এর পর থেকে ছোট মানুষের মতো গোসল করানো, কাপড় পরানোসহ তার সব ধরনের কাজ করে দিতে হয়। এখনও অনেক মানুষ নানা ধরনের কথা বলে। মাঝে মধ্যে ওর সামনে এবং আমাকেও অনেকে বলেন যে, সবাই বড় হয়ে গেল কিন্তু নাহিদ বড় হল না। এসব কথা শুনলে বুক ফেটে কান্না পায়। আমার ছেলেকে অনেক দূর লেখাপড়া করিয়েছি। এখন অনেক কষ্ট হচ্ছে। সমাজের বৃত্তবানরা যদি একটু সহযোগিতা করেন তাহলে ভালো করে লেখাপড়া করাতে পারতাম। পড়া শেষ করে করে যদি সে একটা চাকরি পায় তাহলে সংসারটা একটু ভালো চলতো।
নাহিদের বাবা আরিফ মালিথা জানান, আমার ছেলে আমার কাছে কোনো বোঝা না। আমার মনে কোনো দুঃখ নেই। ৭ থেকে ৮ বছর বয়স থেকে তার এমন অবস্থা দেখছি। ওর থেকে যারা ছোট, তারাও বড় হয়ে যাচ্ছে। এমন দেখে ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে তাকে ডাক্তার দেখাই। তারা জানিয়েছেন এটা হরমন জনিত কারণে হয়েছে। এ সমস্যার চিকিৎসা করতে ১৪ লাখ টাকা লাগবে। কিন্তু তারপরও তারা কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না যে ঠিক হবে কিনা। পরে টাকা জোগাড় করা সম্ভব হলো না আর চিকিৎসাও করাতে পারলাম না।
তিনি আরও বলেন, নাহিদ এখন পড়ালেখা করে এগিয়ে যাচ্ছে। সমাজের কেউ যদি সহযোগিতা করে তাহলে সে আরও এগিয়ে যাবে। আমার দুই মেয়ে এক ছেলে। সে যদি কোনো সরকারি চাকরি পায় তাহলে তার একটা ভবিষ্যৎ হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪২২ ঘণ্টা, জুন ০৯, ২০২৩
এফআর