মৃত্যু অনিবার্য, সুনিশ্চিত। মৃত্যু থেকে রেহাই পাওয়ার কোনো পদ্ধতি মানুষের জানা নেই।
মৃত্যু অবধারিত না হলে জীবনকে মানুষ এত ভালোবাসত না। বেহেশতের সুখ-শান্তির কথা শুনেও মানুষ মরতে চায় না; যেকোনো মৃত্যুই বেদনার ও শোকের। তবে সে মৃত্যু মানুষ মেনে নিতে বাধ্য। কিন্তু আকস্মিক অস্বাভাবিক মৃত্যু বা অপমৃত্যু, যে মৃত্যুর জন্য মানুষের প্রস্তুতি নেই, যা মর্মান্তিক; সকল মৃত্যুই মর্মান্তিক। কিছু মৃত্যু বেশি কষ্ট দেয়। তা শোক নয়—কষ্ট। স্বাভাবিক মৃত্যুর শোক আর অপমৃত্যুর কষ্ট ভিন্ন। বিধাতার নিয়তি মেনেই স্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে প্রস্তুতি থাকলেও অস্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য আমরা কেউ প্রস্তুত নই। যেমনটা সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিম ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য তিনিও প্রস্তুত ছিলেন না, আমরাও প্রস্তুত ছিলাম না।
গোলাম রাব্বানী নাদিম, বাংলানিউজের জামালপুর ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট এবং ৭১ টিভির প্রতিনিধি হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছিলেন। বৃহস্পতিবার (১৫ জুন) বেলা পৌনে ৩টার দিকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। বুধবার অফিসের কাজ শেষে রাত ১০টার দিকে তিনি বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন ও সঙ্গে ছিলেন সহকর্মী আল মুজাহিদ বাবু।
জানা যায়, রাব্বানী অফিস থেকে বাড়িতে যাওয়ার পথে বকশিগঞ্জ পাথাটিয়ায় পৌঁছালে সামনে থেকে অতর্কিত আঘাত করে চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে ফেলে দেওয়া হয় নাদিমকে। এরপর ১০-১২ জন দেশীয় অস্ত্র নিয়ে সড়ক থেকে মারধর করতে করতে টেনে হিঁচড়ে এক অন্ধকার গলিতে নিয়ে এলোপাতাড়িভাবে আঘাত করেন তাকে। সেসময় সহকর্মী মুজাহিদ তাদের আটকাতে গেলে তাকেও মারধর করেন তারা। পরে স্থানীয় বাসিন্দাসহ মুজাহিদ তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু আঘাত গুরুতর হওয়ায় তাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয় উন্নত চিকিৎসার জন্য।
বুধবার রাত ১০টার দিকে বকশিগঞ্জের পাথাটিয়ায় ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের বুথের সামনে ঘটে যাওয়া এমন নৃশংস হামলার বর্ণনা দেন সাংবাদিক নাদিমের সহকর্মী আল মুজাহিদ বাবু।
তিনি বলেন, সাধুরপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাহমুদ আলম বাবুর বিরুদ্ধে নাদিমসহ আমরা কয়েকজন নিউজ করেছিলাম। তারপর থেকেই তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে আছেন আমাদের ওপর। পরে আমাদের নামে ডিজিটাল আইনে মামলাও করেন তিনি। সেই মামলা বুধবার (১৪ জুন) ময়মনসিংহের সাইবার ট্রাইব্যুনাল খারিজ করে দিয়েছেন। এ নিয়ে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেওয়া হয়েছিল। এর দুই তিন ঘণ্টা পর রাতে অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে নাদিমের ওপর হামলা হয়।
তিনি আরও বলেন, নাদিমকে চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে গলা ধরে ফেলে দিয়ে তারপর পাশের একটি অন্ধকার গলিতে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে মারধর করেন মাহমুদ আলম বাবুর লোকজন। ঘটনার সময় ওই গলিতে অন্ধকারে আড়ালে দাঁড়িয়েছিলেন চেয়ারম্যান মাহমুদ আলম বাবু। সেসময় তার ছেলে ফয়সাল, রিফাত, রেজাউল, মনির, সাইদসহ আরও কয়েকজন ছিলেন। মারধরের সময় আমি আটকাতে গেলে আমাকেও তারা মারেন। পরে স্থানীয়রা এগিয়ে এলে চেয়ারম্যানের সন্ত্রাসী বাহিনী চলে যায়। পরে নাদিমকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হয়।
প্রতিদিনের মতো রাতে রাব্বানী অফিসের কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরছিলেন স্বাভাবিকভাবেই, কিন্তু কে জানতো সন্ত্রাসীদের হাতে নির্মমভাবে মৃত্যু হবে? এটা স্বাভাবিক মৃত্যু বলা যাবে কি? নিশ্চয়ই এটা স্বাভাবিক মৃত্যু নয়; অস্বাভাবিক মৃত্যু। আর এ মৃত্যু কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আমার একজন সহকর্মী হিসেবে তো প্রশ্নই আসে না।
প্রতিনিয়ত অস্বাভাবিক মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেই সাথে সাংবাদিকদেরও এমন অস্বাভাবিক মৃত্যুর সংখ্যাও কম নয়। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে প্যারিসভিত্তিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের (আরএসএফ) একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২০ বছরে সারাবিশ্বে প্রায় ১ হাজার ৭০০ সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। সে হিসেবে প্রতি বছর গড়ে ৮০ জনের বেশি সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। ওই প্রতিবেদনে বিশেষ করে সংবাদকর্মীদের জন্য ২০০৩ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এই ২ দশককে অভিহিত করা হয়েছে ‘প্রাণঘাতী’ হিসেবে।
সহকর্মী হিসেবে অনেক স্মৃতি রয়েছে নাদিমের সঙ্গে। এইতো কিছুদিন আগেও বাংলানিউজের ফ্যামিলি ডে অনুষ্ঠানে কত আনন্দ করেছিলাম। প্রিয় গোলাম রাব্বানী চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তাও আবার ঘাতকদের নির্মম আঘাতে। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পুরস্কার আপনি দেখিয়ে গেছেন। আমাদের কাছে কিছুই দেওয়ার নেই, আছে শুধু প্রার্থনা আর ঘাতকদের প্রতি নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো।
লেখক: শফিকুল ইসলাম খোকন, বাংলানিউজের করেসপন্ডেন্ট ও গবেষক