ঢাকা, শনিবার, ১৩ পৌষ ১৪৩১, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে প্রতিবেদনেই খুন হন সাংবাদিক নাদিম

নিশাত বিজয়, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪৪ ঘণ্টা, জুন ১৬, ২০২৩
রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে প্রতিবেদনেই খুন হন সাংবাদিক নাদিম

জামালপুর থেকে: সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক প্রতিবেদন করার কারণেই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিম।

কয়েক মাস আগে বকশিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটি গঠিত হওয়ার পর সাংবাদিক নাদিম মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযোগের ভিত্তিতে ‘বকশীগঞ্জে আ.লীগের কমিটিতে রাজাকারের সন্তান, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিবাদ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করেন বাংলানিউজে।

গত বছরের ২৮ নভেম্বর কোনো সম্মেলন ছাড়াই প্রধানমন্ত্রীর নাম ব্যবহার করে বকশীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে শাহিনা বেগম ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ইসমাইল হোসেন বাবুল তালুকদারের নাম ঘোষণা করা হয়।

নাদিমের ছেলে আব্দুল্লাহ ও মেয়ে জান্নাতের অভিযোগ, এরপর থেকেই সাংবাদিক নাদিমকে ক্রমাগত হুমকি দিয়েছেন শাহিনা বেগম।

এ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে একাত্তর টেলিভিশনের জামালপুর জেলা প্রতিনিধি সুমন জানিয়েছেন, ওই ঘটনার মীমাংসা করার জন্যে সবাই মিলে শাহীনা বেগমের সঙ্গে বসা হয়। পরে শাহীনা বেগম সাংবাদিক নাদিমের ওপর কোনো রাগ নেই বলে জানান তখন।

কিন্তু ঘটনা এখানেই শেষ হয়নি। বকশিগঞ্জ আওয়ামী লীগের এক কর্মীসভায় যুবলীগের এক নেতা সাংবাদিক নাদিমকে ‘সাইজ’ করার ঘোষণা দেন বলে অভিযোগ করেন নাদিমের ছেলে আব্দুল্লাহ।

তারপর ১১ এপ্রিল রাত সাড়ে ১০টার দিকে বকশীগঞ্জ মধ্যবাজার এলাকায় হামলার পরদিন (১২ এপ্রিল) দুপুরে বকশীগঞ্জ থানায় লিখিত অভিযোগ দেন সাংবাদিক নাদিম।

সেই হামলার পরে নাদিম জানান, বকশিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহীনা বেগম দলীয় পদলাভের পর বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। এ নিয়ে একাধিক সংবাদ প্রকাশিত হলে শাহীনা বেগমের লোকজন ক্ষিপ্ত হয়ে হামলা চালায়।

এরপর সাংবাদিক নাদিমকে ‘সাইজ’ করার বিনিময়ে নৌকার নমিনেশন দিতে হবে, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহীনা বেগমের কাছে এমন আবদার জানান সাধুপাড়া ইউনিয়ন এলাকার মাহমুদ আলম বাবু।

সাংবাদিক নাদিমের ছেলের অভিযোগ, তার বাবাকে ‘সাইজ’ করতে চাওয়ায় নমিনেশন দেওয়া হয় বাবুকে।

এরপর নমিনেশন পেয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন বাবু। তারপর হয়ে যান সাধুপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।

চেয়ারম্যান বাবুর বহু অপকর্মের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক সংবাদ প্রকাশ করেন সাংবাদিক নাদিম। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে প্রথমে হামলার হুমকি দেন চেয়ারম্যান বাবু।  

তারপর ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা করা হয় সাংবাদিক নাদিমের বিরুদ্ধে। বুধবার (১৪ জুন) ময়মনসিংহ সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল সেই মামলা খারিজ করে দিলে, ফোনে হত্যার হুমকি দেন চেয়ারম্যান বাবুর ছেলে ফাহিম ফয়সাল রিফাত।

এসময় সাংবাদিক নাদিমের মেয়ে জান্নাত পিতার সঙ্গেই ছিলেন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, হুমকি দিয়ে ফাহিম বলে ‘বাপ মামলা করছে, আমি হলে মেরেই ফেলতাম’। সেদিনই (১৪ জুন) রাতে বাবা বাড়ি ফেরার পথে হামলার শিকার হন।

এসময় নাদিমের সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় সাংবাদিক আল মুজাহিদ।

প্রত্যক্ষদর্শী মুজাহিদ বাংলানিউজকে বলেন, অফিসের কাজ শেষে রাত ১০টার দিকে আমি ও গোলাম রাব্বানী নাদিম বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিই। পথে বকশিগঞ্জ পাথাটিয়ায় পৌঁছালে অতর্কিতভাবে সামনে থেকে আঘাত করে চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে ফেলে দেওয়া হয় নাদিমকে। এরপর ১০-১২ জন দেশীয় অস্ত্র নিয়ে সড়ক থেকে মারধর করতে করতে টেনেহিঁচড়ে এক অন্ধকার গলিতে নিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করা হয় তাকে।  

সেই সময় তিনি (মুজাহিদ) তাদের আটকাতে গেলে তাকেও মারধর করা হয় এবং হত্যার হুমকি দেওয়া হয় জানিয়ে স্থানীয় সাংবাদিক মুজাহিদ বলেন, এক পর্যায়ে লুঙ্গি পরা একটি ছেলে আমাকে মারধর করে।  

চেয়ারম্যানের ছেলে ফয়সালই সাংবাদিক নাদিমকে ইট দিয়ে আঘাত করেন জানিয়ে মুজাহিদ বলেন, সে সময় চেয়ারম্যান মাহমুদ আলম বাবুও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

পরে মুমূর্ষু অবস্থায় সহকর্মী মুজাহিদ ও স্থানীয়রা নাদিমকে হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু আঘাত গুরুতর হওয়ায় সেখানকার চিকিৎসক তাকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন।

পরে বৃহস্পতিবার (১৫ জুন) বেলা পৌনে ৩টার দিকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিমের মৃত্যু হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বকশিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহীনা বেগম বাংলানিউজকে বলেন, সাংবাদিক নাদিমের ওপর হামলায় ঘটনায় তার দায় নেই। তার কোনো কর্মী হামলার সঙ্গে জড়িত নয়।

চেয়ারম্যান বাবু আপনার সঙ্গে রাজনীতি করেন, বাংলানিউজ প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নের জবাবে শাহীনা বেগম বলেন, বাবুর বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।  

আপনার বাবা রাজাকার ছিলেন- এমন সংবাদ প্রকাশে আপনি ক্ষিপ্ত ছিলেন কি-না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, সে ঘটনা মিটে গেছে।

এসময় নিজের বিরুদ্ধে সব ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করে সবটা বানোয়াট ও অপপ্রচার বলে দাবি করেন বকশিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের এই শীর্ষ নেতা।

বাংলাদেশ সময়: ১৫২১ ঘণ্টা, জুন ১৬, ২০২৩
এনবি/এনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।