ফরিদপুর: দিন দিন ফরিদপুরের ডেঙ্গু পরিস্থিতি চরম ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। প্রতিদিনই হু হু করে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা।
খবর নিয়ে জানা গেছে, জেলা-উপজেলার বিভিন্ন হাসপাতালের পাশাপাশি শিরায় দেওয়া স্যালাইনের সংকট দেখা দিয়েছে ওষুধের দোকানগুলোতেও। অধিকাংশ ফার্মেসিতে মিলছে না কোনো স্যালাইন। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে একটা দুইটা মিললেও গোপনে বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে। আবার স্যালাইন না পেয়ে অনেকেই ফিরছেন খালি হাতে।
জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গত ২৪ ঘণ্টায় জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ২৫০ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। বর্তমানে জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৭৮২ জন। জেলায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আট হাজার ৭১৪ জন। এর মধ্যে সাত হাজার ৩৩১ জন রোগী সুস্থ হয়েছেন। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এ পর্যন্ত মারা গেছেন ৩১ জন রোগী।
ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ডায়াবেটিস হাসপাতাল, বিভিন্ন উপজেলার হাসপাতালের সামনে অন্তত বিশটি ওষুধের দোকানে খোঁজ নিয়ে ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত শিরায় দেওয়া স্যালাইন পাওয়া যায়নি। দোকানদারেরা জানিয়েছেন, গত প্রায় মাস খানেক ধরে ওই স্যালাইনের প্রচুর চাহিদা দেখা দিয়েছে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় একেবারেই সরবরাহ নেই। তাই রোগীদের ফেরত দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে রক্তের জলীয় অংশ কমে যায়। এতে রক্তের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি রক্তচাপ কমে যায়। রক্তের তারল্য ঠিক রাখতে ও রক্তচাপ স্থিতিশীল রাখতে রোগীকে স্যালাইন দিতে হয়। একজন রোগীকে দিনে এক থেকে দুই লিটার, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর বেশি স্যালাইন দেওয়া প্রয়োজন হয়। ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় সাধারণত দশমিক ৯ শতাংশ সোডিয়াম ক্লোরাইড স্যালাইন রোগীর শরীরে পুশ করতে হয়। এটাকে ‘নরমাল স্যালাইন’ বলা হয়।
ফরিদপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকায় ফার্মেসিতে স্যালাইন কিনতে আসা নজরুল ইসলাম বলেন, তার চাচা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। হাসপাতালে স্যালাইন নেই। বাইরে থেকে কিনতেও পারছি না। অন্তত ১৫টি ফার্মেসি ঘুরে এক ব্যাগ স্যালাইন পেয়েছি। এরপরও যদি স্যালাইন দরকার হয় তাহলে কোথায় পাবো সেটা নিয়ে চিন্তিত।
এ ব্যাপারে একটি সামাজিক সংগঠনের সদস্য সুমন রাফি বলেন, হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগী ভরা। ডেঙ্গু রোগীর জন্য স্যালাইন সংকট ও রক্তের চাহিদা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। রোগী ও স্বজনদের মধ্যে হাহাকার চলছে।
এ ব্যপারে ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকার ওষুধ ব্যবসায়ী পাংশা ড্রাগ অ্যান্ড সার্জিক্যালের মালিক আকবর বিশ্বাস রাজু বলেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি খুবই খারাপ। গত প্রায় একমাস ধরে স্যালাইন সংকট দেখা দিয়েছে। ডেঙ্গু রোগীর জন্য ১০০০ এমএল স্যালাইনের দাম মাত্র ৮৭ টাকা। এমন পরিস্থিতিতে টাকায়ও মিলছে না স্যালাইন। কোম্পানির লোকজন চাহিদা মতো ডেঙ্গু রোগীর জন্য স্যালাইন দিতে পারছে না।
এ বিষয়ে জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. সোহেল শেখ বলেন, ডেঙ্গু রোগীর জন্য ডিএনএস স্যালাইনের দাম নিয়ন্ত্রণে ফার্মেসি সমূহে নিয়মিত তদারকি করা হচ্ছে। গত দুইদিন আগে দাম বেশি নেওয়ায় কয়েক ফার্মেসি মালিককে জরিমানা করা হয়েছে। ফার্মেসি মালিকরা স্যালাইনের সরবরাহ ও সংকটের কথা জানিয়েছেন। তবে অভিযান পরিচালনা করা হলেও স্যালাইনের দাম বেশি নেওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে ওপসো স্যালাইন কোম্পানির রিজিওনাল ম্যানেজার অজয় চন্দ্র রায় বলেন, আসলে এটা সংকট না। ডেঙ্গু রোগীর চাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্যালাইনের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে চাপের সৃষ্টি হয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে সাপ্লাই বেড়েছে। চেষ্টা করা হচ্ছে রোগীর চাহিদা অনুযায়ী স্যালাইন সাপ্লাই দেওয়ার।
ফরিদপুর জেলা ফার্মাসিউটিক্যালস রিপ্রেজেন্টটেটিভ অ্যাসোসিয়েশনের (ফারিয়া) সভাপতি মৃধা তারিকুল ইসলাম তারেক বলেন, গত প্রায় দুই মাস ধরে স্যালাইনের ব্যাপক সংকট ছিল। টাকা হলেও স্যালাইন পাওয়া যেতো না। খুবই খারাপ পরিস্থিতি ছিল। তবে দুই একদিন ধরে কিছুটা পাওয়া যাচ্ছে। তারপরও সংকট রয়েছে।
এ বিষয়ে ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. এনামুল হক বলেন, হঠাৎ করে ডেঙ্গুর রোগীর চাপ বেড়েছে। আমরা চেষ্টা করছি রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে। তবে এখন পর্যন্ত হাসপাতালে স্যালাইন রয়েছে। তবে রোগীর যে চাপ তাতে স্যালাইনও শেষের দিকে। এমন পরিস্থিতি থাকলে শীঘ্রই বেশি বরাদ্দ না পাওয়া গেলে সংকট তৈরি হবে। হাসপাতালের বাইরে ফার্মেসিতে স্যালাইন সংকট আছে কি-না জানা নেই।
ফরিদপুরের সিভিল সার্জন ডা. মো. ছিদ্দীকুর রহমান বলেন, ডেঙ্গু রোগীর চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। হাসপাতালগুলোতে পুরোপুরি স্যালাইনের সংকট নেই। একটু সমস্যা হয়েছিল। একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে থেকে অতিরিক্ত স্যালাইন দিয়ে তা সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছে। নতুন করে বরাদ্দের জন্য চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গু হলেই যে সব রোগীর স্যালাইন প্রয়োজন তা কিন্তু নয়। রোগী ও স্বজনরা মনে করেন ডেঙ্গু হলেই স্যালাইন লাগবে। যে কারণে তারা স্যালাইনের জন্য ছুটাছুটি করেন। আবার রোগীর চাপ ও চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণেও স্যালাইনের চাহিদা বেড়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২৩
এসএম