ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৪ আষাঢ় ১৪৩১, ০৯ জুলাই ২০২৪, ০১ মহররম ১৪৪৬

জাতীয়

সড়কে কাজ না করেই বিল উত্তোলন, এমপি বললেন টাকা মেরে দিয়েছে 

নাসির উদ্দিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮১৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২৩
সড়কে কাজ না করেই বিল উত্তোলন, এমপি বললেন টাকা মেরে দিয়েছে 

সিলেট: সড়ক সংস্কারের নামে অর্থ লোপাটের অভিযোগ উঠেছে সিলেটের সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। কাজ না করেই বিল উত্তোলন করেছে এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

 

এ নিয়ে খোদ সিলেট-২ আসনের সংসদ সদস্য মোকাব্বির খান ক্ষোভ ঝেড়েছেন। সওজ সিলেটের কর্মকর্তারা সংস্কারের নামে যথারীতি ডাকাতি করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন তিনি।

অনুসন্ধানেও এমপির অভিযোগের সত্যতা দৃশ্যমান। সম্প্রতি সওজের বিভিন্ন সড়কে অনিয়মের চিত্র ধরা পড়ে। এ যেন সরকারের এই দপ্তরের কর্মকর্তাদের ও ঠিকাদারের মিলেমিশে অর্থ লোপাট।  

সিলেট সওজের আওতাধীন রশিদপুর-বিশ্বনাথ-রামপাশা-লামাকাজি সড়কের ১১ থেকে ১২ কিলোমিটার এবং ১৫ থেকে ১৬ কিলোমিটার অংশে জরুরি রাস্তা মেরামত কাজে অনিয়ম ধরা পড়েছে। এসব সড়কে কাজ না করেই আগে বিল তুলে নেওয়া হয়।

এ বিষয়ে সিলেট-২ আসনের সংসদ সদস্য মোকাব্বির খান বলেছেন, সওজের কর্মকর্তারা জনগুরুত্বপূর্ণ রাস্তাটি সংস্কার না করে টাকা মেরে দিয়েছেন। তারা সংস্কারের নামে আমার নির্বাচনী এলাকার মানুষের সঙ্গে তামাশা করেছে। এই সড়কে ২১ লাখ টাকা ব্যয়ে সংস্কারের কথা থাকলেও এক লাখ টাকাও খরচ করা হয়নি।

গত ১৩ জুন ঠিকাদারি সড়কটি সংস্কারে কার্যাদেশ দেওয়া হয় প্রতিষ্ঠান আবিদ মনসুর কনস্ট্রাকশনকে। যার আইডি নাম্বার-৮৩৫৪৩৯ এবং প্রাক্কলিক মূল্য ২১ লাখ ২৮ হাজার ৩৯৬ টাকা।

কার্যাদেশ অনুযায়ী, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এ সড়কের নির্ধারিত চারটি এলাকায় আনুমানিক দেড় লাখ ১ নম্বর ইট দিয়ে দুই স্তরে ইট সলিং করার কথা। যারমধ্যে একটি ফ্ল্যাট সলিং এবং অপরটি এইচবিবি সলিং দিয়ে সংস্কার করার কথা। কাজটির ক্যাটাগরি হলো পিরিয়ডিক, মেইনটেন্যান্স প্রোগাম (পিএমপি)। যার মানে কাজটি সম্পাদনের পরবর্তী এক বছর পুরোপুরি দৃশ্যমান থাকতে হবে।  

অথচ সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সড়কটির কোনো কাজই করা হয়নি। আগের মতো ভাঙা ও গর্তে ভরা। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যে শর্তে কাজটি নিয়েছিল, তা বাস্তবায়নের কোনো অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায়নি। তদারকির দায়িত্বে থাকা সওজ কর্তৃপক্ষও কোনো গরজ দেখায়নি।  

কিন্তু জানা গেছে, সওজ সিলেট ও সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পরস্পর যোগসাজশে গত ২২ জুন কাজটি পুরোপুরি সমাপ্ত দেখিয়ে বিল উত্তোলন করেছে এবং যথারীতি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ সমাপ্তকরণ সনদ দিয়েছে সওজ।  

অর্থাৎ পুরো টাকাটাই ঠিকাদার-সওজ কর্তৃপক্ষ মিলেমিশে ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়েছে।

অনুসন্ধানে এর সত্যতা নিশ্চিত করা গেছে।  

দেখা গেছে, কার্যাদেশের ৯ দিনের মাথায় চূড়ান্ত বিল এবং কাজ সমাপ্তকরণ সনদ দেন সওজ সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোস্তাফিজুর রহমান। বাস্তবে রাস্তার সংস্কার কাজের এতোদিন কোনো চিহ্নই ছিল না।

সম্প্রতি সিলেট-ফেঞ্চুগঞ্জ সড়কে সংস্কার কাজ না করিয়ে ৬ কোটি ১২ লাখ টাকা লোপাটের বিষয়টি বাংলানিউজের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে। একই রকম দুর্নীতি ও সরকারি টাকা আত্মসাতের চিত্র পরিলক্ষিত হয়েছে রশিদপুর-বিশ্বনাথ-রামপাশা-লামাকাজি সড়ক সংস্কারে।

সরজমিনে দেখা যায়, খানাখন্দে ভরপুর সড়কের কয়েকটি স্থানের গর্তে এলোপাতাড়ি কিছু সংখ্যক ইট ফেলা হয়েছে। সম্প্রতি কে বা কারা কয়েকটি গর্তে কিছু ইট ফেলে গেছে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এলাকার লোকজন জানান, অপরিকল্পিতভাবে ইট ফেলার কারণে খানাখন্দে ভরপুর সড়কটিতে জনদুর্ভোগ আরও বেড়েছে।

স্থানীয় বিশ্বনাথ উপজেলার নরশিংপুর গ্রামের আওলাদ হোসেন ও শামীম আহমদ বলেন, এই রাস্তার কারণে অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে। রাস্তা দিয়ে লোকজন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে গেছে।  

এ ব্যাপারে সড়ক ও জনপথ সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোস্তাফিজুর রহমানে সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি চায়ের দাওয়াত দিয়ে দেখা করতে বলেন। সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে কাজ না করেই বিল উত্তোলন এবং কাজ সমাপ্তিকরণ সনদ কীভাবে দিলেন-এমন প্রশ্ন এড়িয়ে যান তিনি।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আবিদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের স্বত্বাধিকারী আবেদ মনসুরের মোবাইলফোনে একাধিক নম্বর থেকে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

বিশ্বনাথ সড়ক উপ-বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. মাহমুদুল হাসান দাবি করেন, সড়কটিতে হেয়ারিং বন্ড ব্রিকসের কাজ হয়েছে। কাজ না করিয়ে বিল তুলে নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা কিছু কাজ করিয়েছিলাম। আরো কিছু বিল উত্তোলনের পরে করেছি।

সংস্কারের নামে টাকা আত্মসাতের বিষয়টি সঠিক নয় বলে দাবি করেছেন সড়কটির দায়িত্বে থাকা সওজ সিলেটের উপ সহকারী প্রকৌশলী মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল কবির। তিনি বলেন, জুনে সড়কটি নির্ধারিত চারটি এলাকার বদলে পুরোটিতে কাজ করিয়েছি।

তবে সড়ক সংস্কার না করে বিল উত্তোলনের ঘটনায় পরোক্ষভাবে বর্তমান এমপিকেই দুষলেন ওই আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি শফিকুর রহমান।

তিনি বলেন, বর্তমান সংসদ সদস্য এসব কাজের তদারকি করেন না। তিনি সঠিকভাবে তদারকি করলে সড়কে এমন অনিয়ম হতো না। তিনি কেবল রাস্তার উদ্বোধনের নেমপ্লেট লাগিয়ে দায় সেরেছেন।

তিনি আরও বলেন, দুর্নীতিবাজ, ধান্দাবাজদের প্রতিহত করেন প্রধানমন্ত্রী। আমার নির্বাচনী এলাকার এই সড়কটির সংস্কারে অনিয়ম খতিয়ে দেখা দরকার। সরকারি বরাদ্দের অর্থ সঠিকভাবে যাতে কাজে লাগে- সেটা মাঠ পর্যায়ে তদারকি করা প্রয়োজন।

কাজ না সওজ কর্মকর্তারা টাকা মেরে দিয়েছেন বলে দাবি করেছেনা বিশ্বনাথ পৌরসভার মেয়র মুহিবুর রহমান।

তিনি বলেন, সড়কটি সওজের হলেও কয়েক কিলোমিটার ইট ফেলে সংস্কার করিয়েছি আমি। আর টাকা খেয়েছে সওজ। ওই সড়কে কাদিপুর পর্যন্ত পৌর এলাকায় পড়েছে। সওজ কাজ না করানোয় ভুক্তভোগীরা আমার কাছে আসেন। আমি পৌর এলাকার মধ্যে পড়া সড়কের কাজ করিয়েছি।  

বাংলাদেশ সময়: ০৮০৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২৩
এনইউ/এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।