ঢাকা: ৬৮ বছরের বৃদ্ধ সামছু, থাকেন নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে। সেখান থেকে গামছা কিনে এনে বিক্রি করেন রাজধানীর সচিবালয়ের সামনের ফুটপাত ও গুলিস্তান মোড়ে।
সোমবার (৬ নভেম্বর) দুপুরে সচিবালয়ের সামনে ক্লান্ত শরীরে ক্রেতার আশায় গামছা নিয়ে বসে থাকতে দেখা যায় বৃদ্ধ সামছুকে। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, সাধারণ সময়ে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৩৫টি গামছা বিক্রি করেন তিনি। কিন্তু হরতাল ও অবরোধের এ সময়ে ১৫ থেকে ২০টির বেশি বিক্রি করতে পারছেন না।
কথা বলে জানা যায়, ১২০ ও ৯০ টাকা দরে দুই ধরনের গামছা বিক্রি করেন তিনি। প্রতিটি গামছায় লাভ থাকে ২০ টাকা করে। সেই হিসাবে অবরোধের আগে প্রতিদিন ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা লাভ থাকত তার। কিন্তু অবরোধের কারণে লাভ নেমে এসেছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়।
সামছু জানান, নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রতিদিন ঢাকায় আসা-যাওয়ায় ১২০ থেকে ১৩০ টাকা গাড়ি ভাড়া লেগে যায়। সকালে বাড়ি থেকে ভাত খেয়ে বের হন, আবার রাতে বাড়ি গিয়ে ভাত খান। সারাদিনে বাইরে আর কিছু খান না তিনি। হাড়ভাঙা খাটুনির পরও বাড়িতে ১৭০ থেকে ২৮০ টাকার বেশি নিতে পারেন না। বর্তমানে বাজারের যে অবস্থা, তাতে তার জীবন চালানোই দায় হয়ে পড়েছে। এর ওপর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আসা তো আছেই।
অবরোধ দিয়ে কী হয়- প্রশ্ন করে তিনি বলেন, এতে শুধু আমার মতো গরিব মানুষের কষ্টই বাড়ছে। আমাদের কথা কেউ ভাবে না।
সামছুর মতোই অনেকের আয় কমে গেছে, নেমে এসেছে স্থবিরতা। কেউ কেউ তো নিজের দুই বেলা খাওয়ার খরচই তুলতে পারছেন না। টাকা পাঠাতে পারছেন না পরিবারের জন্য। চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় অনেকেই আবার রাজধানী ছেড়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার চিন্তা করছেন। বিশেষ করে সিগন্যালগুলোতে পণ্য বা খাবার বিক্রি করা হকারদের জীবন যেন থমকে গেছে।
রাজধানীর পল্টন মোড়ে বাসে বাসে বাদাম, বুট, চিপস ও পানি বিক্রি করেন হকার হামিদুল। বাড়ি বরিশালে, থাকেন পল্টনে একটি দোকানে। হামিদুল বলেন, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মাত্র ৬০ টাকার জিনিস বিক্রি করেছি। এর মধ্যে খরচ বাদ দিয়ে নিজের থাকবে মাত্র ২৫ টাকা। অন্য সময় এতক্ষণে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা বিক্রি করতে পারতাম। লাভ থাকতো অন্তত ১৫০ থেকে ১৭০ টাকা। অবরোধের এ কয়দিন খাবারের টাকাই উঠছে না। ধার করে চলছি। এভাবে চলতে থাকলে বাড়ি চলে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।
বিক্রি কমার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, অবরোধের কারণে রাস্তায় যানবাহন কম, মানুষও কম। তা ছাড়া সিগনালগুলোতেও গাড়ি দাঁড়াচ্ছে না। তাই বেচাবিক্রি নেই।
হামিদুলের মতো বাসে ফেরি করে টুথব্রাশ বিক্রি করেন ইদ্রিসুর রহমান। তার বাড়িও বরিশালে। থাকেন রাজধানীর শনির আখড়ায়। তিনি বলেন, সাধারণ সময়ে ৭০০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত ব্রাশ বিক্রি করে আয় হয়। কিন্তু অবরোধে রাস্তায় মানুষ না থাকায় ২০০ টাকাও বিক্রি করতে পারছেন না। সকাল থেকে ৩০ টাকা দরে মাত্র চার জোড়া ব্রাশ বিক্রি করে আয় করেছেন ১২০ টাকা। সন্ধ্যা পর্যন্ত হয়তো আর ৬০-৯০ টাকা বিক্রি হবে। এতে খরচ বাদ দিলে দুই বেলা খাবার টাকাই থাকে না।
সচিবালয়ের সামনে শসা বিক্রি করা শফিউল্লাহর আয়ও কমেছে। আগে যেখানে প্রতিদিন ১ হাজার ৮০০ থেকে দুই হাজার টাকার শসা বিক্রি করতেন, সেখানে এখন হাজার টাকার বেশি বিক্রি হচ্ছে না। তারপরও আল্লাহর রহমতে কোনোভাবে জীবন চালিয়ে নিচ্ছেন তিনি।
বাড়িতে এ কদিন টাকা পয়সা পাঠাতে পারেননি বলেও আক্ষেপ করেন তিনি। বাড়িতে তার বাবা, মা, ভাই, বোন, স্ত্রী, সন্তান রয়েছেন। শফিউল্লাহ বলেন, নিজের খরচ তুলতেই হিমশিম খাচ্ছি। বাড়িতে কী পাঠাব?
গুলিস্তান জিরো পয়েন্টের মোড়ে পেঁপে বিক্রি করেন বাদশা শরীফ। তিনি বলেন, অবরোধের কারণে ঢাকার বাইরে থেকে মানুষ আসছে না। মানুষ না এলে কার কাছে পেঁপে বিক্রি করব? রাস্তায়ও মানুষ নেই। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাসা থেকে কেউ বের হচ্ছে না। আমরা পেটের দায়ে বের হয়েছি। কিন্তু পেটের দায় তো মিটছে না। অবরোধে আয় অর্ধেক কমে গেছে। আগে যেখানে দেড়-দুই হাজার টাকা বিক্রি করতাম, সেখানে এখন হাজার- হাজার ২০০ টাকা বিক্রি করি।
তিনি আরও বলেন, এমনিতেই জিনিসপত্রের দামের কারণে জীবন চালাতে কষ্ট হচ্ছে, তার ওপর এ অবরোধে কষ্ট আরো বাড়ছে, সেটা কেউ বোঝে না। আমরা কারো কাছে হাত পাততে পারি না, খেতে পারি না। সব কষ্ট আমাদেরই।
পুরানা পল্টন মোড়ে ব্যাগ, মানিব্যাগ বিক্রি করেন নোয়াখালীর বাসিন্দা আবু তাহের। সোমবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মাত্র একটি ব্যাগ বিক্রি করেছেন। তিনি বলেন, মানুষের কাছে টাকা-পয়সা নেই। এমনিতেই ব্যবসায় মন্দা চলছে। আগে দৈনিক ৫-৬ হাজার টাকার ব্যাগ বিক্রি করতাম। এখন এক-দুই হাজারের বেশি বিক্রি করতে পারি না। অবরোধের কারণে তো কখনো কখনো এক টাকাও বিক্রি করতে পারিনি। রাস্তায় মানুষ নেই। অবরোধ যেন আমাদের জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।
সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মাত্র ৪০ টাকা আয় করেছেন মুচি স্বপন। জাতীয় প্রেস ক্লাবের উল্টোপাশে বসেন তিনি। স্বপন বলেন, দৈনিক তিন-চারশ টাকা আয় করেও জীবন চলে না। সেখানে অবরোধের কারণে এক-দেড়শও আয় হয় না। আজ সকাল থেকে কাজ করে মাত্র ৪০ টাকা আয় হয়েছে। বৃদ্ধ বয়সে আর কিছু করারও নেই। চোখে ছানি পড়ে স্পষ্ট কিছু দেখি না। প্রায় অন্ধ।
আয় কমেছে খাবার হোটেলগুলোরও। সেগুনবাগিচার তোপখানা রোডের শিশু কল্যাণ পরিষদের গলিতে নিউ আয়োজন রেস্তোরা নামের একটি খাবার হোটেল পরিচালনা করেন সৈয়দ হোসেন সাগর। মূলত সচিবালয় ও প্রেস ক্লাব এলাকায় কাজে আসা নিম্ন আয়ের লোকেরা দুপুরের খাওয়া সেরে নেন এ হোটেলে।
সাগর বলেন, যেখানে দুপুরে মানুষকে বসার জায়গা দিতে পারতাম না, সেখানে এখন অর্ধেক মানুষও নেই৷ অবরোধের কারণে মানুষ তেমন বের হচ্ছে না। আগে আড়াই-তিনশ মানুষ দৈনিক আমার হোটেলে খেতে আসতেন। অবরোধের এ কদিন ১৫০-১৮০ জন মানুষ আসছে। আড়াই-তিন হাজার টাকার জায়গায় আয় নেমে এসেছে হাজার- হাজার ২০০ তে। বাবুর্চিসহ আট স্টাফের খরচ তুলতেই পারছি না।
সরকার পতনের এক দফা দাবিতে দেশজুড়ে চলছে বিএনপিসহ অন্যান্য দলের দ্বিতীয় দফার ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ। রোববার ভোর ৬টা থেকে শুরু হওয়া এই অবরোধ চলবে মঙ্গলবার ভোর ৬টা পর্যন্ত। অবরোধে বিভিন্ন স্কুল-কলেজ বন্ধ রয়েছে। রাস্তায় যানবাহনও চলাচল করছে কম। বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে বিভিন্ন স্থানে। এতে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া তেমন একটা বাইরে বের হচ্ছে না মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে বেচা-বিক্রি না থাকায় আয় কমেছে নিম্ন আয়ের মানুষের।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ৬, ২০২৩
এসসি/আরএইচ