ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

ঘন ঘন ভূমিকম্প: পূর্বাভাসের প্রযুক্তি নেই, মোকাবিলার প্রস্তুতিতে জোর

গৌতম ঘোষ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩, ২০২৩
ঘন ঘন ভূমিকম্প: পূর্বাভাসের প্রযুক্তি নেই, মোকাবিলার প্রস্তুতিতে জোর

ঢাকা: আবার ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকাকে ঝাঁকিয়ে দিল ভূমিকম্প। গত শনিবার (২ ডিসেম্বর) সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে এ ভূমিকম্প অনুভূত হয়।

এই প্রেক্ষাপটে আবার আলোচনা চলছে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস ও মোকাবিলার প্রস্তুতি নিয়ে। সরকারের সংশ্লিষ্টদের মতে, ভূমিকম্প হলে মোকাবিলা করতে প্রস্তুতি রয়েছে। কিন্তু ৪০ সেকেন্ডের আগে পূর্বাভাস দেওয়ার প্রযুক্তি নেই সরকারের। একই সঙ্গে ভূমিকম্পের পরবর্তী উদ্ধারকাজের জন্য সরকার স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করছে৷ অবশ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্ষতি যেন না হয়, তার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।  

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিত নগরায়ণের জন্য ভূমিকম্পে ঢাকা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। কারণ ঢাকায় জনবসতি বেশি, নগরায়ণ অপরিকল্পিত, সরকারেরও প্রস্তুতি কম। সে কারণে ঢাকার ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি বেশি। এখনই পরিকল্পনা নিতে হবে। বিল্ডিং কোড মেনে ভবনগুলো নির্মাণ করতে হবে। বিল্ডিংয়ের চারপাশে যথেষ্ট জায়গা রাখতে হবে। উদ্ধারকাজের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আমদানি করতে হবে।

মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থার (ইউএসজিএস) তথ্য অনুযায়ী, শনিবারের ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৫। এর উৎপত্তিস্থল লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ। গভীরতা ছিল ১০ কিলোমিটার। চট্টগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, নরসিংদী, সিলেট, খুলনা, চাঁদপুর, মাদারীপুর, রাজশাহী, বাগেরহাট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। যদিও ভূমিকম্পে কোনো ধরনের ক্ষয়ক্ষতি বা কেউ হতাহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসান বাংলানিউজকে বলেন, ভূমিকম্পের কোনো আগাম পূর্বাভাস দেওয়া যায় না। যেটা করা যায়, সেটা হলো ৪০ সেকেন্ড আগে। এর বাইরে কেউ আগাম পূর্বাভাস দিতে পারে না। আমাদের দুইটা টেকটনিক প্লেট রয়েছে, একটি ডাউকি ও অপরটা মধুপুরে। এই দুইটি প্লেটের অভ্যন্তরে মুভমেন্ট হয়, এতে যে শক্তি সঞ্চয় হয় সেটার জন্য ভূমিকম্প হয়ে থাকে বলে ভূতাত্ত্বিকরা বলে থাকেন। পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকে বাংলাদেশ অনেকটা সেইফজোনে রয়েছে। জাপান, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। জাপানে যখন বিল্ডিং তৈরি করা হয় তখন বেইজমেন্টে একটি প্রযুক্তি ব্যবহার করে, যার ফলে ভূমিকম্প হলে ভবনগুলো দুলে কিন্তু ভেঙে যায় না। আমাদের দেশে সে প্রযুক্তি এখনো আসেনি।  

দেশে এরকম প্রযুক্তি ব্যবহার করার কোনো চিন্তা-ভাবনা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের দেশে এখন যেটা আছে সেটা হলো পুরাতন ভবনগুলোকে রেট্রোফিটিং করে অনেকগুলো ভবন থেকে সাপোর্ট দেওয়া হচ্ছে। তবে ওই টেকনোলজি আমদানি করার বিষয়টি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় বলতে পারবে। আমরা যেটা করতে পারি সেটা হলো বিল্ডিং কোড মেনে ভবন তৈরিতে জনগণকে সচেতন করতে৷ ঘূর্ণিঝড় হলে ৮-১০ দিন আগে পূর্বাভাস দেওয়া যায়। কিন্তু ভূমিকম্পের ৩০ মিনিট আগে পূর্বাভাস দেওয়ার মতো কোনো প্রযুক্তি আবিষ্কার হয়নি।  

ভূমিকম্পের প্রস্তুতির বিষয়ে সচিব বলেন, আমাদের সচেতনতা বাড়াতে হবে। বিল্ডিং কোড মেনে আমাদের ভবনগুলো নির্মাণ করতে হবে। বিল্ডিংয়ের চারপাশে যথেষ্ট জায়গা রাখতে হবে। উদ্ধারকাজের জন্য আমাদের কিছু যন্ত্রপাতি কেনা আছে, আরও কিছু কেনা হবে। তবে আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো স্বেচ্ছাসেবক। সারা বিশ্বে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ঘূর্ণিঝড়, বন্যাসহ অন্যান্য যে দুর্যোগ হয় সেগুলো মোকাবিলায় আমরা রোল মডেল। আর ভূমিকম্পের জন্য সবচেয়ে বেশি যেটা প্রয়োজন সেটা হলো বিল্ডিং কোড মেনে চলা ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা। সরকার এ কাজটি গত ২০ বছর ধরে করে যাচ্ছে। ভূমিকম্প হলে মোকাবিলা করতে প্রস্তুতি আমাদের রয়েছে। কিন্তু ৪০ সেকেন্ডের আগে পূর্বাভাস দেওয়ার প্রযুক্তি আমাদের নেই।  

বাংলাদেশের কোন কোন জেলা ভূমিকম্পের সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন,  বাংলাদেশের সিলেট জেলার জৈন্তাপুর, মধুপুরের কিছু অংশ এবং চট্টগ্রামের কিছু এলাকা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে। আর ঢাকাতে যে ঝুঁকির কথা বলা হচ্ছে সেটা আসলে ভূমিকম্পের অবস্থাগত কারণে যে ঝুঁকি সে অর্থে নয়। মূলত ঢাকাতে অপরিকল্পিতভাবে নগরায়ণ হয়েছে, পাশাপাশি অনেক পুরাতন ভবন রয়েছে, একইসঙ্গে বহু মানুষের বসবাস, সে অর্থে ঝুঁকিপূর্ণ। এজন্য ঢাকায় আমরা রেট্রোফিটিং করে পুরাতন ভবনগুলোতে সুরক্ষার ব্যবস্থা করছি। যেটা করতে হচ্ছে সেটা হলো ভবনটি ঠিক রেখে ভূমিকম্প সহনশীলে রূপান্তর করা।  

এ বিষয়ে ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, আমাদের অঞ্চলটিতে সব সময় এমন ভূমিকম্প হয় না। কয়েক বছর ধরে আমরা দেখছি, এখানে হালকা থেকে মাঝারি ধরনের ভূমিকম্প হচ্ছে। এটা বড় ভূমিকম্প হওয়ার পূর্বলক্ষণ। এখন এ ভূমিকম্প ঢাকার জন্য কতটা ঝুঁকির, সেটা সেভাবে বলা মুশকিল। বড় ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল হতে পারে সিলেট থেকে কক্সবাজার জোনের যেকোনো জায়গায়। যদি ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়, তবে উৎপত্তিস্থলের কাছের এলাকার চেয়েও ঢাকায় ক্ষয়ক্ষতি বেশি হতে পারে। কারণ ঢাকায় জনবসতি বেশি, নগরায়ণ খারাপ, সরকারেরও প্রস্তুতি কম। সে কারণে ঢাকার ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি বেশি।

তিনি বলেন, আমাদের এখনো সময় আছে পরিকল্পনা নেওয়ার। সরকারকে স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিতে হবে। তবে সরকার যে পরিকল্পনা নিচ্ছে, সেটা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। সেটাতেও কিছুটা ভুল আছে। এ ক্ষেত্রে ভূমিকম্পের পরবর্তী উদ্ধারকাজের জন্য পরিকল্পনা করা হচ্ছে। কিন্তু ক্ষতি যেন না হয়, তার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। ভূমিকম্প হলে কোথায় ক্ষয়ক্ষতি বেশি হতে পারে, কোথায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উদ্ধারকারী দল ও চিকিৎসক দল দ্রুত পাঠাতে হবে, কোন জায়গাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, সেগুলো নিয়ে সরকারের কোনো পরিকল্পনা দেখছি না।  

সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, জনগণকে সচেতন করতে মোবাইল ফোনে টেক্সট পাঠিয়ে ভূমিকম্পের আগে কী করা উচিত, নিজেদের কীভাবে নিরাপদ রাখব এবং পরে তাদের করণীয় কী হবে সে বিষয়ে জানাতে পারি আমরা। একই সঙ্গে যে অংশগুলো নিরাপদ, সেটা যদি আমরা জনগণকে আগে বলে দিতে পারি যে এ অংশ নিরাপদ, তাহলে তারা ভূমিকম্পের সময়ে সেখানে সরে যেতে পারবে।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান ড. জিল্লুর রহমান বলেন, এ ধরনের ভূমিকম্প দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায়ই হতে পারে। অবকাঠামো নির্মাণে যথাযথ পরিকল্পনা, প্রকৌশলীদের কার্যকরী প্রশিক্ষণ ও জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা তৈরির মাধ্যমে ঝুঁকি অনেকটাই কমানো সম্ভব।  

যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা রামগঞ্জে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলকে সাবডাকশন জোন (সিলেট থেকে কক্সবাজার অঞ্চল) হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আর সাবডাকশন জোন সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ হাওর হয়ে মেঘনা নদী দিয়ে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে চলে গেছে। এই রেখা ইন্ডিয়া প্লেট, যেটা পশ্চিমে অবস্থিত, সেটি পুবের যে পাহাড়ি অঞ্চল, তার নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। এই জোনে বিপুল শক্তি প্রায় হাজার বছর ধরে সঞ্চিত হয়ে আছে। এতে ৮ দশমিক ২ থেকে ৮ দশমিক ৯ মাত্রা পর্যন্ত ভূমিকম্প হতে পারে। এই জোনের মধ্যে আবার দুটি ভাগ আছে। একটা হলো লক জোন, যেটি আমাদেরই অংশ। সেখানে ইন্ডিয়া (ভারত)ও বার্মা (মিয়ানমার) প্লেট আটকে আছে, একটির সঙ্গে আরেকটি। আরেকটি জোন হলো আমাদের পূর্ব দিকের অঞ্চল যেটি মিয়ানমার ও মিজোরাম অঞ্চলে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৩, ২০২৩
জিসিজি/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।